প্রাকৃতিক ‘এনার্জি ড্রিংক’ খেজুরের রস

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫৩ | আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২২, ১৩:৫৮

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

হাঁড় কাপানো ঠান্ডার মধ্যে কাঁচা খেজুরের রসে গলা ভেজাননি এমন বাঙালি কমই আছেন। শীতকালে খেজুরের রস শহরে পাওয়া সত্যি বিরল। গ্রামাঞ্চলেও আজকাল সহজে দেখা মেলে না এ রসের। গ্রাম বাংলা বা অধুনা শহরের শীতকালীন কৈশোরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে খেঁজুরের রসের মাদকতা। শীতের কুয়াশামাখা সকালে গাছ থেকে নামানো সদ্য তাজা এক গ্লাস খেজুরের রসের আস্বাদন যিনি করেছেন, তিনিই জানেন এর তুলনা অন্য কোনো পানীয়ের সঙ্গেই করা বৃথা।

খেজুরের রস হলো খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহকৃত রস। সাধারণত মাটির হাড়ি দিয়ে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। তবে বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে মাটির বদলে প্লাস্টিক দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। খেজুরের রস দিয়ে ফিরনি, পায়েস এবং খেজুরের রস থেকে উৎপন্ন গুড় দিয়ে ভাঁপা পিঠা এবং গাঢ় রস দিয়ে তৈরি করা হয় মুড়ি, চিড়া, খই ও চিতই পিঠাসহ হরেক রকম পিঠাপুলি।

খেজুরের রস পান করলে শরীরের দুর্বলতা দূর হয়। এতে উচ্চ প্রাকৃতিক চিনি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে খেজুরের রস পান করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হয়। পুষ্টিগত দিক থেকে খেজুর রসের উপকারিতা অনেক।

খেজুরের রসে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি রয়েছে। এতে জলীয় অংশও বেশি। এই রসকে প্রাকৃতিক ‘এনার্জি ড্রিংক’ বলা যেতে পারে। এতে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে।

খেজুরের রস কাঁচা খাওয়া যায়, আবার জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করেও খাওয়া যায়। গুড়ে আয়রন বা লৌহ বেশি থাকে এবং হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। যারা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, কাজকর্মে জোর পান না, খেজুরের রস তাদের জন্য দারুণ উপকারী।

খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এতে ১৫-২০% দ্রবীভূত শর্করা থাকে। খেজুরের গুড় আখের গুড় থেকেও বেশি মিষ্টি, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। খেজুরের গুড়ে প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেল সবই রয়েছে।

খেজুরের রসে দ্রবীভূত শর্করা বা গ্লুকোজের পরিমান কমবেশি ১৫% থেকে ২০% এবং এতে আছে প্রচুর প্রোটিন, সহজপাচ্য ফ্যাট এবং খনিজ বা মিনারেল। এত পুষ্টিগুণসম্পন্ন এবং জলীয় অংশ বেশি হওয়ার কারণে খেজুরের রসকে প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিংকও বলা হয়ে থাকে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড়ে প্রচুর পরিমাণ লৌহ বা আয়রন থাকে। ফলে খেজুরের রস খেলে বা প্রতিদিন অল্প পরিমাণে খেজুরের গুড় খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক থাকে, অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ হয়। খেজুরের রসে প্রচুর পরিমানে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম থাকায়, খেজুরের রস বা গুড় পেশীকে শক্তিশালী করতে বিশেষ কার্যকরী। তাছাড়া এতে রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম, যার ঘাটতির কারণে আমাদের অবসন্ন বা ক্লান্তি ভাব আসে।

তাই খেজুরের রস বা গুড় সেবনে শারীরিক দুর্বলতা দূর হয়ে কর্মস্পৃহা ফিরে আসে। প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ হওয়ায় খেজুরের রস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শীতের দিনে শরীর গরম রাখে। ফলে সর্দিকাশির হাত থেকে বাঁচায়। অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে বা ওজন কমাতে চিনির পরিবর্তে খেজুরের রস বা গুড় খাওয়া যেতে পারে – এক্ষেত্রে এর পরিবর্ত হিসাবে অন্য কিছু ভাবা যায় না। পর্যাপ্ত পটাশিয়াম থাকায় শরীরের মেটাবলিজম বৃদ্ধি পায়, ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও খেজুরের রসের কার্যকরী ভূমিকা আছে। খেজুরের রস থেকে উৎপাদিত গুড় অনিদ্রা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। খেজুরের রস হজমে সাহায্যকারী উৎসেচকগুলির কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়। আপনি যদি প্রতিদিন খাওয়ার পর সামান্য পরিমাণ খেজুরের গুড় খান তাহলে হজম তাড়াতাড়ি হবে।

সাধারণত চার বছর বয়সের পর থেকে খেজুর গাছের রস আহরণ শুরু হয় যখন গাছে ১২-১৫টি পাতা থাকে। খেজুরের চিনি, গুণমান ইত্যাদির পরিমাণ মাটি, জলবায়ু এবং খেজুরের প্রকারের উপর নির্ভর করে। পুরুষ গাছ স্ত্রী গাছের চেয়ে বেশি রস দেয় এবং রসও তুলনায় বেশি মিষ্টি হয়। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে খেজুর গাছের মাথার অংশকে ভালো করে পরিষ্কার করা হয়। এরপর পরিষ্কার সাদা অংশ কেটে বিশেষ কায়দায় ছোট-বড় কলসিতে রস সংগ্রহ করা হয়। শীতের মৌসুমে প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে গাছের মাথার সাদা অংশ পরিষ্কার করে গাছে হাড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সকাল হলে সেই হাড়ি নামিয়ে আনা হয়। রস দিয়ে পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করে সাধারণত বিক্রি করে দেওয়া হয়। তবে গাছিরা যে হাড়ি ঝুলিয়ে রাখে তাতে অনেক সময় কীট পতঙ্গ প্রবেশ করে অস্বাস্থ্যকর রসে পরিণত করতে পারে।

খেজুরের রস ভোর বা সকালে খাওয়াই ভালো। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি ক্রমশ গেঁজে ওঠে এবং অম্লত্ব বৃদ্ধি পায়, তা পান করলে বমি হতে পারে এবং শরীরের জন্যও ক্ষতিকর। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা খেজুরের রস বা গুড় না খাওয়াই ভালো। তবে এ ব্যাপারে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন। খেজুরের রসের কলসি বাঁধার সময় কলসির মুখ জাল দিয়ে ঢেকে দেওয়া উচিত। অনেক সময় বাদুড় কলসির ভিতর মুখ ঢুকিয়ে রস খায়। এ থেকে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই খেজুরের রস ফুটিয়ে খাওয়া বেশি নিরাপদ। বাদুড় যখন খেজুরের রসে মুখ দেয়। তখন তাদের মুখ থেকে নিঃসৃত লালা এমনকি তাদের মলমূত্র খেজুরের রসের সাথে মিশে যায়। এই দূষিত রস কাঁচা অবস্থায় খেলে নিপাহ ভাইরাস সরাসরি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। এর ফলে জ্বর, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, কাশি, বমি, ডায়রিয়া নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। যা মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে।

(ঢাকাটাইমস/২২জানুয়ারি/আরজেড/জেবি)