ডিজিটাল মার্কেটিং এবং পুঁজিবাজার ডিজিটালাইজেশন প্রসঙ্গে...

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:৩৬

ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ

তথাগত মার্কেটিং থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং বর্তমানে বিশাল একটা রূপ ধারণ করেছে। তথাগত মার্কেটিংয়ে কাস্টমারদের কাছে যাওয়াটা খুবই ব্যয়বহুল ছিল, কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানো সহজ হয়েছে এবং এটা কম খরচে করা যাচ্ছে। করপোরেট হাউসগুলো এই ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করছে ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর জন্য। এটার মাধ্যমে  ক্রেতার চাহিদা, ক্রেতা কখন কিনে, কোথায় কেনে,  কীভাবে কেনে সবকিছু বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে একটি তথ্য জানাতে চাই তা হচ্ছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় ৭ কোটি। এই বিশাল সংখ্যা প্রমাণ করছে যে, দেশে মানুষজন ফিজিক্যালের পাশাপাশি ডিজিটাল বা তথ্যপ্রযুক্তিকে নিচ্ছে।  প্রতিটি করপোরেট হাউস তাদের ডিজিটাল কনটেন্ট, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বাড়ানোতে মনোযোগ দিচ্ছে এবং তারা এর ফল পাচ্ছে। এই ইন্ডাস্ট্রি ইতোমধ্যে কয়েক বিলিয়ন টাকায় রূপান্তরিত হয়েছে। তার পাশাপাশি তৈরি হয়েছে অনেক ডিজিটাল এজেন্সি, যারা সকল প্রকারের সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞাপন বানানো থেকে শুরু করে, বিজ্ঞাপন গবেষণা এবং সেটার আউটপুট নিয়ে তারা অবদান রাখছে। দিন দিন এ খাতের পরিধি বাড়বে এবং অচিরেই কয়েক শ কোটি টাকার শিল্পে রূপান্তর হবে। এখানে অনেক মানুষের আনাগোনা বাড়ছে, অনেক ডিজিটাল কনটেন্ট মেকারের চাহিদা বাড়ছে, প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে এবং এখানে অনেক গ্র্যাজুয়েট দরকার হচ্ছে। মোদ্দাকথা, এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে সামনে।

আমরা এখন ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের যুগে আছি। কাজেই ভবিষ্যতে এটাকে এড়িয়ে চলার কোনো কারণ দেখছি না। খেয়াল করে দেখেন, ডিজিটাল কনটেন্টগুলো দ্রুত  আরওওয়াই রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট দিচ্ছে বা রিটার্ন অব মার্কেটিং ইনভেস্টমেন্ট দিচ্ছে। এটা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে এবং বাড়বে।  প্রতিটি করপোরেট হাউস বুঝে গেছে যে, এটাকে কাজে লাগাতে হবে এবং তারা সেভাবে তাদের কর্মপন্থা, মার্কেটিং, মার্কেটিং অ্যানালাইসিস, ডেটা অ্যানালাইসিস বা  ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অনেক কোম্পানি ইতোমধ্যে মাইক্রোসফট পাওয়ার বিয়াই, সেলসফোরস, ট্যাব্লু, হুটসুইটের মতো সফটওয়্যার ব্যবহার করছে এবং সামনে আরও বাড়বে। কাজেই এটা বলা যায়, ক্ষেত্র অনেক বড় হবে অচিরেই।

অনলাইনে কেনাকাটা বাংলাদেশে এক দশক ধরে খুব বেড়েছে এবং মহামারি বা করোনা এসে সেটা আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। গত দুই বছরে দেখা গেছে এটা একটা মানুষকে অনেক বেশি ফ্লেক্সিবিলিটি দিচ্ছে। কাজেই  মানুষজন ঘরে বসেই কেনাকাটা করতে পারছে। যদিও ডেলিভারি নিয়ে মানুষের কিছু প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দেখা যায়, তারা একটা পণ্য কিনেছে এবং ডেলিভারি পেয়েছে আরেকটা, যা খুবই অসহনীয়। ক্রেতাদের পণ্য কেনার সময় রিভিউ দেখা উচিত। এতে কিছুটা হলেও প্রতারণা কমানো যাবে। আশার কথা হচ্ছে, ভবিষ্যতে যারা এক রকম পণ্য দেখাবে এবং ভিন্ন রকমের পণ্য ডেলিভারি দেবে তারা আসলে টিকে থাকতে পারবে না, কারণ ক্রেতারা তাদের নামে নানা বিপরীত রিভিউ  দেবে, যাতে সাবধান হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, যেসব কোম্পানি গুণগত মান বজায় রাখবে, সঠিক সময় ডেলিভারি দেবে এবং অক্ষত অবস্থায় পণ্য ডেলিভারি দেবে তারাই ভবিষ্যতে মার্কেটে টিকে থাকবে, বাকিরা হারিয়ে যাবে। ক্রেতাদেরও কোনো পণ্য কেনার আগে তাদেরকে রিভিউ দেখতে হবে, ফিডব্যাক দেখতে হবে, কমেন্টগুলো পড়তে হবে এবং পারলে তাদের বন্ধুবান্ধব থেকে রিভিউ নিতে হবে, তারপর কিনলে সেখান থেকে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। সরকারের উচিত এসব ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করা এবং যারা বিভিন্ন রকমের লোভনীয় স্কিমের মাধ্যমে মানুষকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে, তাদেরকে কঠোরভাবে নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

পুঁজিবাজার অনেক দিন আগে থেকেই ডিজিটালাইজড করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং হয়েছেও অনেক দূর। তবে আরও নতুন কিছু কাজ হাতে নেওয়া যেতে পারে। পুঁজিবাজারে যেহেতু আর্থিক লেনদেন অনেক হয়, সে ক্ষেত্রে সাইবার সিকিউরিটি, ডেটা প্রাইভেসি, ব্লকচেইন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং যারা পুঁজিবাজারে লেনদেন করবে, তাদের ডিজিটাল লিটারেসি,  ডিজিটাল বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ডিজিটাল অ্যাটিটিউড বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।

যেহেতু ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের প্রচুর কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে কাজেই এখানে অনেক মানুষ লাগবে সামনে। বিশেষ করে যারা ছাত্র তাদের উচিত পড়াশোনার পাশাপাশি ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে নানা কোর্স করে ফেলা, ট্রেনিং নিয়ে ফেলা (দেশি এবং বিদেশি প্ল্যাটফর্ম থেকে)। যেহেতু করপোরেট হাউসগুলো ডিজিটাল মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট চালু করছে। দিন দিন অনেক মানুষের দরকার হচ্ছে তার কাজকর্মগুলো সামাল দেওয়ার জন্য, কাজেই এটা একটা পেশা হতে পারে। আমাদের ছাত্রদের উচিত এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া, যাতে তারা চাকরিগুলো নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে যেহেতু দক্ষ জনবলের অভাব কাজেই এই স্কিলস শিখে স্কিলস-বেজড সেক্টরে জব করতে পারে। আমাদের বর্তমান বিজনেস গ্র্যাজুয়েট অথবা যারা এই স্কিলস শিখবে তাদের এই সেক্টরে এখনই নজর দেওয়া উচিত। কারণ, আগামী দিনগুলো হবে ডিজিটাল ট্রান্সফরমারদের।

যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেটিং বিভাগের এমবিএ ছাত্রদের জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং নামে একটি কোর্স চালু করেছে এবং আমরাই তার প্রথম ব্যাচ বের করেছি। আমি এই কোর্সটা পড়াচ্ছি শুরু থেকেই (২০২১)। আমরা ২০০ ছাত্র ইতিমধ্যে বের করেছি।  আমি মনে করি প্রত্যেক বিজনেস গ্র্যাজুয়েটের ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্স করা উচিত এবং আমি আহ্বান জানাব বিজনেস স্কুলের অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের সবারই এই কোর্সটি চালু করতে, তা না হলে আমাদের ছাত্ররা বাজারে পিছিয়ে পড়বে অন্যদের থেকে। একটা বিশাল সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।

আমাদের বিভাগ থেকে শুধু ডিজিটাল মার্কেটিং নয়, আমরা ডিপার্টমেন্ট থেকে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন, ব্লকচেইন ফর বিজনেস, ডেটা অ্যানালিটিকস এসব নিয়ে আমরা নতুন নতুন কোর্স শুরু করব। এতে ডিপার্টমেন্ট এবং ডিপার্টমেন্টের বাইরে অন্য ছাত্রছাত্রীরা এই কোর্সগুলো করতে পারবে এবং করপোরেটদের জন্য আমরা ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের ওপর ট্রেনিংও শুরু করব।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়