দেশছাড়া ১/১১’র ক্ষমতাধর জেনারেল মইন আজও ঢাকায় ফেরেননি কেন?

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২২, ১৬:১০ | আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২২, ১৮:২৩

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

সেই যে গেলেন, আর তো এলেন না জেনারেল মইন ইউ আহমেদ! আর কি দেশে ফিরবেন না তিনি? দেশে ফিরতে কোথায় বাধা তার? এক-এগারোর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রবল ক্ষমতাধর এই সাবেক সেনাপ্রধানকে নিয়ে রাজনীতিসহ বিভিন্ন অঙ্গনে প্রায়ই শোনা যায় এমন গুঞ্জন।

২০০৯ সালের ১৪ জুন সেনাপ্রধান পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পরপরই দেশ ছাড়েন মইন ইউ আহমেদ। পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার কয়েক বছর পর একবার হজ করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন মইন। কিন্তু দেশমুখো হননি। এখনো আছেন যুক্তরাষ্ট্রেই। তবে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে দুই কক্ষের এক অ্যাপার্টমেন্টে দিন কাটছে এক-এগারোর অন্যতম এই কুশীলবের। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই মিলেছে।

সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে দেশ ছেড়ে সোজা গিয়ে উঠেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। সেখানে ছিলেন তার ছোট ভাই ও ছেলে নিহাত আহমেদ। কয়েক বছর সেখানেই দিন কাটছিল মইনের। কিন্তু হঠাৎ শরীরে বাসা বাঁধে কর্কট রোগ (ক্যানসার)। চলে আসেন নিউইয়র্কের কুইন্সে, চিকিৎসার জন্য। এর মধ্যে পেয়ে যান গ্রিনকার্ড অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব।

নাগরিক হিসেবে কর্কট রোগের চিকিৎসাও পেয়েছেন তিনি স্থানীয় হাসপাতালে। কেমোথেরাপি, বোনম্যারু ট্রান্সপ্লান্টের পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার কিছুদিন পরই দেখা দেয় কিডনির জটিলতা। রোগে-শোকে কাবু হয়ে পড়েছেন এক-এগারোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

সেই সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে মইন ইউ আহমেদ ছিলেন ছায়ার মতো। তার অঙ্গুলিহেলনে ঘটে যেত কত ঘটন-অঘটন। ওই সময় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সব অঘটনের মূলেও আছে তার নাম। প্রবল ক্ষমতাধর মইন এখন বিস্মৃতপ্রায়।

ফ্লোরিডার প্রবাসীরা জানান, ২০০৯ সালে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর আত্মগোপনের মতো আড়ালে ছিলেন মইন। বছর পাঁচেক পর ২০১৫ সালে ফ্লোরিডায়ায় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের এক মঞ্চে দেখা যায় তাকে। তবে আগের মতো সেই দাপুটে অভিব্যক্তি কিংবা দেহভাষা কিছুই ছিল না। চেহারায় ভেসে ছিল ধসে যাওয়া মনোবল আর দম্ভচূর্ণের ছাপ। শরীরেও স্পষ্ট ভাঙন। খুব বেশি লোকের জন্য কথা বলতে চাননি। যতটা সম্ভব এড়িয়ে গেছেন বাংলাদেশিদের। তারপর আবার বছরখানেক দেখা ছিল না তার। পরের বছরের শেষদিকে হঠাৎ আবির্ভূত হয়েছিলেন স্থানীয় এক বাঙালির বিয়েতে।

২০০৫ সালের ১৫ জুন সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন মইন। তার বছর দুই পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা পদ থেকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সরে গেলে প্রধান উপদেষ্ট হন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। এক-এগারো পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সেনাবাহিনী সরাসরি না থাকলেও সবখানেই যে তাদের প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপ ছিল এ কথা সর্বজনবিদিত, যে কারণে দেশে-বিদেশে ওই সরকার 'সেনাসমর্থিত সরকার' বলেই পরিচিত।

রাজনীতিতে জোর আলোচনা আছে, এক-এগারোর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার পরিবর্তে ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার অপ্রচেষ্টা করেছিল। তারই অংশ হিসেবে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রধানকে কারান্তরীণ করা হয়েছিল। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’, অর্থাৎ দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া। আর এই মূলে অন্যতম কুশীলব হিসেবে ছিলেন জেনারেল মইন।

পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ রাজনৈতকি দলগুলো এক-এগারোর কুশীলবদের বিচারের দাবিতে একাট্টা হয়। মামলাও হয় তাদের বিরুদ্ধে। যদিও  এখন নিষ্পত্তি হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে এলে বিচারের মুখোমুখি এমনকি এক-এগারোর ক্ষতিগ্রস্তদের হামলার মুখে পড়তে হতে পারে, এই শঙ্কা থেকেও দেশমুখো হচ্ছেন না তৎকালীন কুশীলবরা। 

১৯৫৩ সালের ২৩ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মইন ইউ আহমেদ। কিন্তু স্কুল সার্টিফিকেটে তার জন্মতারিখ লেখা হয়েছে ২১ জানুয়ারি। পারিবারিকভাবে তার নাম রাখা হয় মইন উদ্দিন আহমেদ। পরে তিনি মইন ইউ আহমেদ নামে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর পদাতিক কোরে কমিশন পান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক মেয়ে ও এক ছেলের জনক। মেয়ে সাবরিনা আহমেদ, ছেলে নিহাত আহমেদ। স্ত্রী বেগম নাজনীন মইন।

বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে শঙ্কিত ছিলেন মইন?

২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় সাবেক জেনারেল মইন ইউ আহমেদের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ  'শান্তির স্বপ্নে'। বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে মইন ইউ আহমেদ নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন তার বইতে। লিখেছেন, তিনি এমন কিছু প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছিলেন, যার কারণে তৎক্ষণাৎ রাষ্ট্রপতি তাদের বরখাস্ত করতে পারেন, গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারেন, এমনকি হত্যার নির্দেশও দিতে পারেন।’

বঙ্গভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্ভেদ্য উল্লেখ করে মইন লিখেছেন, ‘...তারা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হলেও তাদের কর্মপদ্ধতি ভিন্ন। বঙ্গভবনে তাদের কাছে প্রেসিডেন্টই একমাত্র ভিভিআইপি যাকে রক্ষা করতে তারা নিয়োজিত। এমনকি প্রেসিডেন্টের জীবনের উপর হুমকি মনে করলে তারা যে কাউকে হত্যা করতে পারে। পিজিআর কিংবা এসএসএফ, সেনাবাহিনী কিংবা অন্য কোনো বাহিনীর চেইন অব কমান্ডের আওতাধীন নয়। এমন নিরাপত্তা বলয়ে আমরা কজন যাচ্ছি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায়। আমি জানতাম হতে পারে এ যাত্রাই সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আমার শেষ যাত্রা কিংবা কে জানে হয়তো জীবনের শেষ যাত্রা।’

বঙ্গভবনে রওয়ানা হওয়ার আগে মেজর জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়াকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি না ফিরলে পরবর্তী পরিস্থিতি সিজিএস হিসেবে প্রাথমিকভাবে তাকেই সামাল দিতে হবে।’

কী ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি

'শান্তির স্বপ্নে'বইতে মইন লিখেছেন, তিনি-সহ সশস্ত্র বাহিনীর অন্যান্য প্রধান ও ডিজিএফআইয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্তা সেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন। তারা আড়াইটার সময় বঙ্গভবনে ঢোকেন। ভেতরে গিয়ে শোনেন, প্রেসিডেন্ট মধ্যাহ্নভোজ করছেন। তাদের একটি কামরায় অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়। ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষা করার পর প্রেসিডেন্টের দেখা মেলে। প্রেসিডেন্টকে তারা 'মহা-সংকটময় পরিস্থিতি' থেকে দেশকে উদ্ধার করার অনুরোধ জানান। প্রেসিডেন্ট বিষয়টি ভেবে দেখার সময় নেন।

জেনারেল মইন তার বইতে লেখেন, ‘আমি জানতাম ইতোপূর্বে উপদেষ্টা পরিষদের অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত অজানা কোনো কারণে ও প্রভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে। যার কারণে আমরা কোনো দুষ্টচক্রকে আবার নতুন কোনো খেলা শুরু করার সুযোগ দিতে চাচ্ছিলাম না। কক্ষে নেমে এলো সুনসান নীরবতা... আমার মনে হলো আমাদের চোখ দিয়ে পুরো দেশ যেন তাকিয়ে আছে প্রেসিডেন্টের দিকে।’

দীর্ঘ নীরবতার পর প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা জারির পক্ষে মত দেন। সেই সাথে তিনি নিজে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেবেন বলে জানান। বইতে ছটার সময় বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসার কথা লিখেছেন জেনারেল মইন, অর্থাৎ দুই ঘণ্টার মতো তারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিলেন।

মইন ইউ আহমেদের বই পড়ে জানা যায়, বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের মূল কাজ হয় প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজি এমন একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি খুঁজে বের করা। মইন লেখেন, বঙ্গভবনেই প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন তাদের দুটো নাম প্রস্তাব করেছিলেন, একজন শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, অপরজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদ। প্রফেসর ইউনূসকে প্রথম ফোনটি করেন জেনারেল আহমেদ। প্রফেসর ইউনূস অস্বীকৃতি জানান।

মইন লেখেন, ‘তিনি বললেন, বাংলাদেশকে তিনি যেমন দেখতে চান সেরকম বাংলাদেশ গড়তে খণ্ডকালীন সময় যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশকে আরো দীর্ঘ সময় ধরে সেবা দিতে আগ্রহী। সেই মুহূর্তে ড. ইউনূসের কথার মর্মার্থ বুঝিনি... পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি তিনি একটি রাজনৈতিক দল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যদিও পরিস্থিতির কারণে তাকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছিল।’

ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে ফোন করে ঘুম থেকে জাগানো হয় গভীর রাতে। প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য সময় চান তিনি। আধ ঘণ্টা পর ফিরতি ফোনে সম্মতি জানান।

মইন আরও লেখেন, ওই দিনটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাবহুল দিন নাইন-ইলেভেনের মতো করে এক-এগারো হিসেবে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত নেন তারা।

(ঢাকাটাইমস/২২ জানুয়ারি/এইচএফ/মোআ)