বিতর্কিত অমি ফের মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেটে থাকছেন আগের মতোই?

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২২, ১৯:৩৩ | আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২২, ১৯:৩৫

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস

তুহিন সিদ্দিকী অমি। জনশক্তি রপ্তানিখাতের এক সময়ের খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি। গত বছর ঢাকার বোটক্লাব কেলেঙ্কারির ঘটনায় নতুন করে উঠে আসে তার নাম। ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা, পাসপোর্ট জালিয়াতি, মানিলন্ডারিং, মাদক, প্রতারণাসহ মোট পাঁচটির বেশি মামলার আসামি তিনি। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলায় আদালতে জমা হয়েছে চার্জশিট।। বাকিগুলোর তদন্ত চলছে। অমিও আছেন কারাগারে। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, কারাগারে থেকেও জনশক্তি খাতে নিজের আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠাতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে সিন্ডিকেট গড়ার চলছে তোড়জোড়। জনশক্তি রপ্তানিখাতের একাধিক সূত্র বলছে, এই সিন্ডিকেটে ঢুকতে তৎপর অমি ও প্রতিষ্ঠান।

দুর্নীতি আর সিন্ডিকেটের অভিযোগে ২০১৮ সালে বন্ধ হওয়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সম্প্রতি খুলে দিয়েছে দেশটি। সই হয়েছে সমঝোতা স্মারকও। তবে এবার কোনো সিন্ডিকেট গড়ার পক্ষে নয় বাংলাদেশ। তবে মুষ্টিমেয় রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা চাচ্ছেন সিন্ডিকেট গড়তে। এজন্য তারা মালয়েশিয়া সরকারের বিভিন্ন দপ্তরেও তদবির চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তাদের দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ সরকার বরাবরই কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়াটি সবার জন্য খোলা রাখতে চায় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতীতে যে চক্র মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বিষয়ে একক আধিপত্য বিস্তার করেছিল তুহিন সিদ্দিকী অমি তাদের একজন। এর আগে সিন্ডিকেট করে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে তারা। যে কারণে বেড়ে গিয়েছিল কর্মীদের অভিবাসন ব্যয়। তৈরি হয়েছিল বিশৃঙ্খলা। এসব কারণেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই শ্রমবাজারটি। দুই দেশের সরকার পর্যায়ে একাধিক বৈঠক ও চেষ্টার পর যখন ফের মালয়েশিয়ার পথ খুলছে তখন আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন অতীতের সুবিধাভোগীরা। সরাসরি সিন্ডিকেট না বললেও ওই আদলেই বলয় গড়তে চাচ্ছে। কারাগারে বসেই নিজের লোকজনদের দিয়ে এই বলয়ে ঢোকার চেষ্টা চালাচ্ছেন অমি।  

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকার তরফে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। যেখানে কর্মী পাঠাতে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি ও ২৫০টি সাব এজেন্ট কাজ করবে বলে জানানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। জবাবে সরকারি নিবন্ধিত প্রায় সাড়ে চোদ্দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকা মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে। এখান থেকে মালয়েশিয়া সরকারকে এজেন্সি বেছে নিতে বলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, এই ঘটনার পর এখন অমিসহ সিন্ডিকেটে আগ্রহীরা বিভিন্নভাবে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে লেঁয়াজো করার চেষ্টা করছে। বেশ কয়েকটি এজেন্সির কর্ণধাররা মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে।

বোটক্লাব কাণ্ডে অভিযুক্ত অমির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এসব মামলা তদন্তে অবশ্য খুব বেশি অগ্রগতি নেই। সিআইডি বলছে, অমির বিরুদ্ধে  তাদের কাছে অনেক অভিযোগ আছে। বিশেষ করে বিদেশে ভালো চাকরির আশ্বাসে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়া হলেও বিদেশে পাঠানো হয়নি। আবার যেসব দেশে পাঠানোর কথা বলে টাকা নেওয়া হয়েছিল, সেই কাঙ্ক্ষিত দেশেও অনেককে পাঠানো হয়নি। অমির মাধ্যমে অনেকে বিদেশ গিয়ে কারাগারে ছিলেন। তার নানা অপরাধের অনেক তথ্য-প্রমাণও মিলেছে ইতিমধ্যে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি- বায়রা'র সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আগে যারা সিন্ডিকেট করে কর্মী পাঠাতেন তারা পুনরায় সিন্ডিকেট তৈরির করতে পারবে না। কারণ মন্ত্রী ও সচিব এবার খুবই সক্রিয়ভাবে বিষয়গুলো দেখছেন। আমরাও শুরু থেকেই এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছি।’

জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এবার তো কোথাও সিন্ডিকেট হচ্ছে না। এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। কেউ যাতে সিন্ডিকেট করতে না পারে এর জন্য যা করার আমরা সব প্রকাশ্যে করছি।’

কর্মী পাঠিয়ে অনেক এজেন্সি প্রতারণা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলাও আছে। এমন এজেন্সি এবার মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর সুযোগ পাবে কিনা এমন প্রশ্নে আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, ‘এমন এজেন্সির বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় গত দশ বছরে মোট তিন লাখ ৫৬ হাজার ৮১২ জন কর্মী পাঠানো গেছে। কিন্তু দুর্নীতি আর সিন্ডিকেটে ২০১৮ সালের পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ দেয় মালয়েশিয়া সরকার। এরপরও নানা উপায়ে ২০১৯ সালে ৫৪৫ জন মালয়েশিয়ায় গেছেন। ২০২০ সালে গেছেন ১২৫ জন এবং বিদায়ী বছর ২০২১ সালে মাত্র ২৮ জন কর্মী যান দেশটিতে। অতীতের নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে আবারও মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সই হয়েছে সমঝোতা স্মারকও। সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে এই চুক্তি করেন। অভিবাসন ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরে সব ধরনের সিন্ডিকেট দুর্নীতি বন্ধ করে কর্মী পাঠানোই এবার লক্ষ্য।

নতুন চুক্তি অনুযায়ী— বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়া প্রান্তের সব ব্যয় বহন করবেন নিয়োগকর্তা। এই খরচে রয়েছে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি নিয়োগ, মালয়েশিয়ায় আনা, আবাসন, কাজে যোগদান এবং ওই কর্মীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর খরচ।

অমির যত প্রতিষ্ঠান: রাজধানীর দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকায় বিদেশে কর্মী পাঠানোর একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেন অমি। এর মাধ্যমেই ভাগ্য বদলে যায় তার পরিবারের। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে নারী পাচার করেন অমি। আর সেখান থেকেই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান অমি।

অমির অর্ধ ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছয়টি প্রতিষ্ঠান দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকার মেডিক্যাল রোডের একই ভবনে। একটি উত্তরখানে এবং অপর একটি প্রতিষ্ঠান উত্তরা এলাকাতেই।

প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘জান্নাহ প্রোপার্টিজ লিমিটেড’, ‘আয়াত ট্যুর অ্যান্ড ট্র্যাভেল সার্ভিস’, ‘জান্নাহ এগ্রো পোল্ট্রি অ্যান্ড ফিসারিজ’, ‘জান্নাহ ট্রেডিং’, ‘জান্নাহ মেডিকেল সার্ভিস’ এর স্বত্ত্বধিকারী তিনি। এছাড়া ‘আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স ডেভলপমেন্ট লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অমি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন ‘ইন্সটিটিউট অব সিঙ্গাপুর মেরিন টেকনোলজি লিমিটেড’ এবং ‘বিএসএম ওয়েডিং ট্রেনিং সেন্টার লিমিটেড’ নামের আরও দুটি প্রতিষ্ঠান।

এরমধ্যে ‘আয়াত ট্যুর অ্যান্ড ট্র্যাভেল সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠানটি বিদেশে লোক পাঠানোর প্রতিষ্ঠান। ধারণা করা হচ্ছে, বিদেশে লোক পাঠানের আড়ালে মানব পাচারের কাজও এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করেছেন তুহিন সিদ্দিকী অমি। দক্ষিণখানে একটি রিসোর্টের আড়ালে প্রায় প্রতিদিন মদ-জুয়ার আসর বসাতেন অমি। রিসোর্টটি তার ‘রঙশালা’ নামে পরিচিত।

আলোচনায় যেভাবে অমি:

গত ১৪ জুন চিত্রনায়িকা পরীমনির দায়ের করা হত্যা-ধর্ষণচেষ্টা ও মারধরের অভিযোগে মামলায় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমির নাম উল্লেখ করে মোট ছয়জনকে আসামি করা হয়। পরীমনির অভিযোগ, গত ৮ জুন রাতে তাকে বোট ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিলেন অমি, সেখানে নাসির তাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান। মামলার পর ঢাকার উত্তরার এক নম্বর সেক্টরের একটি বাসা থেকে নাসির ও অমিকে মদ-ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। সেই মামলায় তাদের দুজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

এ ছাড়া বিমানবন্দর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে আরেকটি মামলায় অমিকে আসামি করা হয়। গত ১৫ জুন রাতে দক্ষিণখান থানা এলাকায় অমির একটি অফিস থেকে ১০২টি পাসপোর্ট ও ১৭ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। এতগুলো পাসপোর্ট রাখায় অমির বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইনেও দক্ষিণখান থানায় মামলা হয়। গত ১৭ জুন আব্দুল কাদের নামের এক ব্যক্তি অমির বিরুদ্ধে মামলা করেন।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, আশকোনা হজ ক্যাম্প এলাকার আয়াত আরাফাত ট্রাভেল ট্যুর সার্ভিস নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তার পরিচিত দুজনকে দুবাই পাঠানো হয়। কিন্তু যে চাকরি ও বেতনের কথা বলা হয়েছিল, তার বদলে ভ্রমণ ভিসায় পাঠানোর ফলে তারা সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন, ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি আরও দুজনকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে প্রতারণা করেছে বলেও মামলায় অভিযোগ করা হয়।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, অমির সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার নাগরিক কি না, পাশাপাশি ৭-৮টি দেশের পাসপোর্টে ভিসা লাগানো- এসব বিষয়েও খোঁজ চলছে। তাছাড়া অল্পসময়ে কীভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন, এসব কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। অমির মাধ্যমে কারা কারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন, মানিলন্ডারিং অপরাধ করেছেন কি না এসব যাচাই-বাছাই ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

শত শত কর্মী বিদেশে পাঠিয়ে এবং বিদেশে পাঠানোর নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। বিদেশে কর্মী পাঠানোর সূত্র ধরে সাবেক এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল অমির। তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। সেখানেও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। দেশে বিলাসী জীবনযাপন করা অমি সেকেন্ড হোম গড়েছেন মালয়েশিয়ায়।

অমির মানবপাচার আর পাসপোর্টের পৃথক দুটি মামলার তদারকি কর্মকর্তা এসপি খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, অমির দুটি মামলার তদন্ত চলছে। তবে এখনি দেওয়ার মতো কোনো তথ্য নেই। মানবপাচারের প্রাথমিক কোনো প্রমাণ পেয়েছিন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে।’

(ঢাকাটাইমস/২২জানুয়ারি/এসএস/এইচএফ)