মরুর খেজুর চাষে সফলতার মুখ দেখছেন হাজারো তরুণ

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫৪ | আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ১০:০৪

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ফল খেজুর। তালজাতীয় শাখাবিহীন খেজুর গাছ প্রধানতঃ মরু এলাকায় ভাল জন্মে। পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকা দেশগুলোতে খেজুরের চাষ প্রচলন বেশি। অনেকের মতে ইরাক অথবা মিসর খেজুর ফলের আদি স্থান। প্রাচীনকাল থেকে খেজুর ফলের বাগান সৃষ্টি করা এবং তা থেকে প্রাপ্ত খাদ্য ও ফলের উৎস হিসেবে খেজুর মানুষের জীবন ধারণের অন্যতম অবলম্বন ছিল।

 

আরব দেশগুলোর মরুভূমি এলাকায় যেখানে অন্য কোনো গাছপালা জন্মানো সহজ হয় না সেখানে খেজুর বাগান সৃষ্টি করে মরুদ্যান সৃষ্টি করা হতো। খেজুর যেসব দেশে বেশি চাষ হয় তার মধ্যে মিসর, সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, ওমান, লিবিয়া ও তিউনেশিয়া অন্যতম। অধুনা চীন, ভারত ও আমেরিকার কিছু অংশে সফলভাবে খেজুর চাষ করা হচ্ছে।

 

তবে বাংলাদেশে রোজার মাসে ইফতারে খেজুরের জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা বিপুল। সেখানে একটা সময় পর্যন্ত দেশি খেজুরের চেয়ে বেশি আদরণীয় ছিল বিদেশি খেজুর, বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে আসা খেজুর। কেবল রোজার মাসকে উপলক্ষ করে টনকে টন খেজুর আমদানি হত প্রতি বছর। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সেই সৌদি আরবের বিভিন্ন জাতের খেজুর বাংলাদেশেই চাষ হচ্ছে। মরুর খেজুর চাষে সফলতার মুখ দেখছেন হাজারো তরুণ।

 

পৃথিবীতে প্রায় এক হাজারের বেশি খেজুরের জাত রয়েছে, এর মধ্যে সৌদি আরবে চারশো'র বেশি জাতের খেজুর উৎপাদন হয়। বাংলাদেশে জনপ্রিয় জাতের মধ্যে আজওয়া, বেরহি, সামরান, জাহেদি, মরিয়ম, আনবারাহ, আসমাউলহাসনা, ইয়াবনি অন্যতম। এর মধ্যে আজওয়া, বেরহি এবং মরিয়ম জাতের খেজুর বেশি চাষ হচ্ছে।

 

পুষ্টিগুণের দিক থেকে খেজুর সমৃদ্ধ ফল। খাদ্য হিসেবে খেজুরের জুড়ি নেই। খেজুর ফলের ঔষধিগুণ খুব বেশি। খেজুর ফ্রুকটোজ ও গ্লাইসেমিক সমৃদ্ধ ফল। এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায়। খেজুর ফলকে চিনির বিকল্প হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। খেজুরের পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে বলা হয় চারটি বা ৩০ গ্রাম পরিমাণ খেজুরে আছে ৯০ ক্যালোরি, এক গ্রাম প্রোটিন, ১৩ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম, ২.৮ গ্রাম ফাইবার এবং আরও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ছাড়াও খেজুরে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সালফার, প্রোটিন, ফাইবার এবং আয়রন।

 

আহারে হজম শক্তি বাড়ায়, রক্ত স্বল্পতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, এলার্জি ও ক্যানসার রোধক হিসেবে কাজ করে। খেজুর দেহে শক্তি জোগায়, হার্টকে সুস্থ রাখে, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে, দেহের হাড় ও দাঁতকে মজবুত রাখে। রক্তশূন্যতা, গলাব্যথা, ডায়রিয়া, সুস্থ গর্ভধারণে এ ফল অতি উপকারী।

কৃষি গবেষকেরা বলছেন, মূলত মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাত ধরেই দেশে সৌদি খেজুরের উৎপাদন শুরু। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ যারা শুরু করেছেন শুরুর দিকে তাদের প্রায় সবাই সৌদি আরব থেকে বীজ এবং চারা এনে গাছ লাগিয়েছিলেন। বাংলাদেশে কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৩-১৪ সালের দিকেই বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সৌদি খেজুরের চাষ শুরু হয়।

 

বীজ থেকে চারা উৎপাদনের জন্য মাটির তিন ভাগের একভাগ বালি, ছাই, গোবর ও কম্পোস্ট সার এক সাথে মিশাতে হবে। ১০০ কেজি মাটির জন্য ৫০০ গ্রাম রুটোন সার মিলিয়ে তৈরি করতে হবে। বীজ ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর মাটির আধা ইঞ্চি গর্তে বপন করতে হবে। তারপর অল্প পানি দিতে হবে যাতে কাদা না হয়। ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পানি দেবার পর ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পর চারা গজাবে। এরপর ৩ মাস পর পর ১ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া গুলিয়ে স্প্রে করতে হবে।

 

একটি গাছ থেকে আরেকটি গাছের দূরত্ব হবে ১৫ থেকে ২০ ফুট। দিনে কমপক্ষে ৫ থেকে ৮ ঘণ্টা যাতে রোদ থাকে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। তাতে গাছের বৃদ্ধি ও রোগ-বালাই কম হবে। একর প্রতি ১০০ থেকে ১২১টির বেশি গাছ রোপণ করা যাবে না।

 

খেজুরের চারা রোপণ করতে হলে ৩ ফুট গভীর ও ৩ ফুট লম্বা এবং ৩ ফুট আড়াআড়ি গর্ত করে মাদা বানাতে হবে। উপরের মাটি নিচে এবং নিচের মাটি উপরে দিতে হবে। সম্ভব হলে গর্তের মাটিতে ১/২ দিন রোদ লাগিয়ে নিলে ভাল হবে। পোকা-মাকড়ের আক্রমণ যাতে না হয় তার জন্য মাটির সাথে গুঁড়ো বিষ মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে।

 

প্রতিটি গাছের গোড়ায় সামান্য পরিমাণে হাড়ের গুঁড়া, প্রতি গর্তে ৮ থেকে ১০ কেজি গোবর সার মেশাতে হবে। চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিন পরে মিশ্র সার গাছের কমপক্ষে ২ থেকে ৩ ফুট দূরে মাটিতে প্রয়োগ করে পানি স্প্রে করতে হবে। চারা রোপণের পর চারার গোড়া যেন শুকিয়ে না যায় আবার অতিরিক্ত পানিতে যেন কাদা না জমে যায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

মজার বিষয় হচ্ছে, খেজুর গাছে নারী ও পুরুষ ভেদ আছে, পুরুষ গাছে ফল হয় না। কিন্তু পরাগায়ণের জন্য পুরুষ গাছ দরকার হয়। খেজুর গাছের পরাগায়ণ পোকা-মাকড়, মৌমাছি কিংবা বাতাসের মাধ্যমে কমই হয়ে থাকে।

 

খেজুর গাছের পরাগায়ণ পোকা-মাকড়, মৌমাছি কিংবা বাতাসের মাধ্যমে খুব কমই হয়ে থাকে। হাত দিয়ে অথবা মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে পরাগায়ণ করতে হবে। বাগানে ১০০টি স্ত্রী গাছের সাথে মাত্র ১টি পুরুষ গাছ থাকলেই পরাগায়ণের জন্য যথেষ্ট। পরাগায়ণ করতে হলে স্ত্রী গাছের ফুল চুরমি ফেটে বাইরে আসার পর পুরুষ গাছের পরাগরেণু পাউডার নিয়ে স্ত্রী গাছের পুষ্পমঞ্জুরিতে লাগিয়ে দিয়ে চুরমির অগ্রভাগ রশি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। ২/৩ দিন পর পর পুনরায় ২/৩ বার পরাগায়ণ করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। প্রয়োজনে পুরুষ গাছের পাউডার সৌদি থেকে আমদানি করে ফ্রিজে -৪ থেকে -১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ থেকে ৩ বছর সংরক্ষণ করা যায়।

 

খেজুর গাছ অনুর্বর এমনকি অধিক লবণাক্ত অঞ্চলে হয়ে থাকে। লাগানোর পর ৪-৫ বছর পর থেকে খেজুর দেয়া শুরু হলে এক নাগাড়ে ১৫০ বছর অর্থাৎ বাঁচার আগ পর্যন্ত খেজুর দিয়ে থাকে। খেজুর খুবই পুষ্টিমান হওয়ার কারণে ১ কেজি খেজুর দেহকে ৩ হাজার ৪৭০ ক্যালরি শক্তি যোগান দেয়। খেজুর গাছ থেকে যেমন রস পাওয়া যায় তেমনি জ্বালানি হিসেবে পাওয়া যায় গাছের কাঠ। খেজুর গাছ লবণাক্ত এলাকা, নদী ভাঙন, কৃষি কাজের উপযোগী আবহাওয়া তৈরিতে সাহায্য করে।

 

(ঢাকাটাইমস/২৪জানুয়ারি/আরজেড/এজেড)