আমিরাতকে যেভাবে মহাকাশে পৌঁছে দিলেন সারাহ আমিরি

প্রকাশ | ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ১০:৪৮ | আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ১০:৫০

নির্ঝর দেবনাথ

২০ জুলাই ২০২০।  স্থান জাপানের স্পেস সেন্টার থ্যানগাশিমা।  একদল বিজ্ঞানী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কন্ট্রোল রুমে  দাঁড়িয়ে আছে।  প্রত্যেকের দৃষ্টি  কন্ট্রোল রুমের বড় ডিসপ্লেতে ভেসে থাকা একটি রকেটে দিকে। কেননা, কিছুসময় পরই এই রকেট মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। যেটি হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রথম মঙ্গল অভিযান। এই মিশনের নাম দেয়া হয়েছে 'মিশন হোপ'।  চলছে তারই কাউন্টডাউন- থ্রি... টু...ওয়ান।  কাউন্টডাউন শেষ হতে না হতেই চালু হল ইঞ্জিন, তীব্রবেগে ছুটে যেতে থাকল উর্ধ্বাকাশের দিকে। কন্ট্রোল রুমে থাকা সকলেই বুঝতে পারলেন যাত্রা সঠিক ভাবেই শুরু হয়েছে। করতালির মুখরতায় নীরবতা ভাঙলে আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন সকলেই।

এই সফলতম মুহূর্তের যিনি আসল কারিগর, তিনি একটু বেশি উচ্ছ্বসিত। তিনি হলেন-সারাহ আল-আমিরি।  আরব আমিরাতের প্রথম মঙ্গল অভিযান মিশন হোপের টিম লিডার। ২০১৬ সালে টিম লিডার পদে নিয়োগ পাওয়ার পর এই মুহূর্তটিই ছিল তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য।

ওনার যখন ১২ বছর বয়স, তখন এক অদ্ভুত কারণে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রেমে পড়েন। কোনো এক রাতের পরিষ্কার আকাশে একবার অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি দেখেন। আকাশ, তারা, মহাশূন্য এসবের প্রতি আগ্রহের শুরু। আর এগুলোই জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রধান বিষয়বস্তু তখনও সারাহ তা জানতেন না।

স্কুল-কলেজের সীমানা পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার পাঠ শেষ করলেন একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। ক্যারিয়ারও শুরু করলেন এই বিষয়েই। কিন্তু এই তিনিই যে একদিন দেশের হয়ে ঐতিহাসিক এই অর্জনের নেপথ্যে কাজ করবেন তা কে জানত।

দুবাইয়ের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব শারজাহ থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতক এবং মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করেন সারাহ আমিরি। কম্পিউটার প্রকৌশল নিয়ে স্নাতক অর্জন করলেও আগ্রহের কমতি আসেনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে। হঠাৎ একটা  চাকরির সুযোগ আসে এমিরেটস ইনস্টিটিউশন ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধীনে মুহাম্মদ বিন রশিদ স্পেস সেন্টার থেকে। সেখানে কাজ করবেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আর তার সঙ্গে আবার মহাকাশ বিজ্ঞানচর্চার সুযোগও রয়েছে। তাই আর কিছু না ভেবে যোগ দেন।

তিনি যে সময়টাতে এই স্পেস সেন্টারে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন, তখন আরব আমিরাতের প্রথম স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম দুবাইস্যাট-১ এর কাজ চলছিল। যেখানে তিনি চমৎকারভাবে নিজের দক্ষতার পরিচয় দেন। পরবর্তীতে দুবাইস্যাট-২ প্রোগ্রাম, খলিফাস্যাটে এ কাজ করেন। সেই মিশনগুলোও সফল হয় এবং প্রশংসিত হয়।

মহাকাশ গবেষণায় সারাহ আমিরির ছিল প্রবল আগ্রহ, কাজের প্রতিও ছিলেন খুব দায়িত্বশীল। ক্যারিয়ারে দ্রুত সফলতা অর্জনের মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যেই মুহাম্মদ বিন রশিদ স্পেস সেন্টার ও দুবাইয়ে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন।

২০০৯ সালে ক্যারিয়ার শুরু করার মাত্র ৫ বছর পরেই আরব আমিরাত সরকার তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করেন। ২০১৪ সালে আরব আমিরাতের অ্যাডভান্সড এরিয়াল সিস্টেমস প্রোগ্রাম স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি তার কাজ শুরু করেন। আর সফলভাবে একটি এইচএপিএস স্যাটেলাইট নির্মাণ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেন।

এইচপিএস স্যাটেলাইট মূলত ড্রোন এবং স্যাটেলাইটের মাঝামাঝি এক ধরনের আকাশযান। এইচএপিএস স্যাটেলাইট পৃথিবীর বায়ুমন্ডলেই অবস্থান করে আর এটি ড্রোনের চেয়ে অধিক উচ্চতায় উড়তেও সক্ষম। ফলে রাডারে ধরা পরে না এবং একে ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রিয়েল টাইম আপডেট পাওয়া যায়।

এইচএপিএস প্রোগ্রামের ১ বছর পর সারাহ উল্লেখযোগ্য মাইলফলক স্পর্শ করেন। ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের বর্ষসেরা ৫০ তরুণ বিজ্ঞানীর একজন

নির্বাচিত হন। কাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা তাকে একের পর এক সফলতা এনে দেয়। ২০১৬ সালে তিনি এমিরেটস সায়েন্স কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ক্যারিয়ার শুরুর পর তার উপর যে দায়িত্বই এসেছে, সবগুলোই তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। ফলে রাষ্ট্রীয় ভাবেও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। সেজন্য তাকে মঙ্গল স্যাটেলাইট 'মিশন হোপ' এর  টিম লিডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

ফলে সারাহ আমিরির জীবনে নতুন আরেকটি অধ্যায় শুরু হয়। বিগত বছর গুলোতে সফল কাজের অভিজ্ঞতা আছে ঠিকই কিন্তু এবারের লক্ষ্যটা যে ৬২ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরের মঙ্গল গ্রহ। তাই সমস্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কেন্দ্রবিন্দু এখন একটিই- 'মিশন হোপ'।

মিশন হোপ

মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী রাষ্ট্রগুলোর একটি সংযুক্ত আরব আমিরাত। পৃথক ৭টি আমিরাত নিয়ে গঠিত এই দেশটির সম্পূর্ণ অর্থনীতি তেল নির্ভর। যদিও আমিরাতে যথেষ্ট তেলের মজুদ রয়েছে তবুও শুধুমাত্র একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে সচ্ছ্বল ভাবে টিকে থাকা যায় না।

তাই প্রযুক্তি খাতকে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হয়েছে আরব আমিরাত যাতে তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা যায়। তৈরি হচ্ছে প্রযুক্তিখাত, যে গুলো হয়ে উঠবে পরবর্তী প্রজন্মের কর্মক্ষেত্র। দেশটির ২০১৪ সালে মঙ্গল গ্রহের অরবিটে স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা, ২০১৭ সালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মন্ত্রণালয় গড়ে তোলা। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগরি সহায়তায়  ও দেশীয় প্রযুক্তি, প্রকৌশলীদের নিয়ে সারাহ আল-আমিরির নেতৃত্বে গড়ে তৈরি হয়েছে 'মিশন হোপ' এর বিজ্ঞানী দল।

এই দলটির নেতৃত্বে ২০২০ সালের ২০ জুলাই প্রথমবারের মতো জাপানের থ্যানগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে আরব বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। প্রথম থেকেই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির সাথে যুক্ত থাকা এবং দলটির নেতৃত্বে থাকা 'সারাহ্ আল-আমিরির' কাছে এই বিষয়টি অনেকটা আমেরিকার চন্দ্র অভিযানের মতোই আনন্দের।

স্যাটেলাইটটি মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছাবে আনুমানিক ৭ মাস পর। যাত্রাটি সম্পন্ন করতে রকেটটির প্রায় ৬২ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। স্যাটেলাইটটি দীর্ঘ এই যাত্রাপথে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে চালু থাকবে। একটি ইনফ্রারেড স্পেক্ট্রোমিটার ও একটি আল্ট্রাভায়োলেট স্পেক্ট্রোমিটারের সঙ্গে এতে রয়েছে একটি ক্যামেরা।

এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মঙ্গলের আবহাওয়া,  জলবায়ু, ধূলিঝড় ও বায়ুমণ্ডলের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। পুরো এক মঙ্গল বর্ষের (পৃথিবীর প্রায় ২ বছরের সমান মঙ্গলের এক বর্ষ) আবহাওয়া কীভাবে পরিবর্তিত হয় সেই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা মিলবে।

নিঃসন্দেহে এই মিশনটি পুরো বিশ্বের কাছে মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে নতুন ধারণা ও অনেক অজানা বিষয় তুলে ধরবে, যেগুলো হয়তো পরবর্তী মঙ্গল মিশন গুলোতে বেশ কাজে লাগবে।

মঙ্গলে জনবসতি গড়ে উঠুক বা না উঠুক, আরব আমিরাতের প্রথম এই মঙ্গল যাত্রা নিশ্চয়ই দেশটির নতুন প্রজন্মকে মহাকাশ বিজ্ঞানে উৎসাহী করে তুলবে। সারাহ আল-আমিরির মতোই যার হাত ধরে উন্মোচিত হবে নতুন কোনো সম্ভাবনার দুয়ার।  দেশটির হয়ে প্রথম মঙ্গল অভিযানের সফল কারিগর হিসেবে ইতিহাসে আজীবন সম্মানিত হয়ে থাকবেন সারাহ আল-আমিরিও।

(ঢাকাটাইমস/২৫জানুয়ারি/এজেড)