পূর্বসূরি ভিসিকে কি হারিয়ে দেবেন ফরিদ উদ্দিন?

মেসবাহ শিমুল
| আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ২০:০৫ | প্রকাশিত : ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ১৯:৫৩

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি সবার জানা। ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেটের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠে এখন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একজন উপাচার্যের লজ্জাহীনতার কাছে হাজার-হাজার শিক্ষার্থী-অভিভাবক, শিক্ষক-কর্মচারীর প্রতিবাদ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আদৌ তাদের এই আন্দোলন কোনো সফল সমাপ্তি হবে কি না সেটি এখনো ধোঁয়াশাই রয়ে গেছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে প্রশাসনের নতুন খেলা। ইতঃপূর্বে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে যেসব সাবেক সাস্টিয়ান বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে, খাদ্য-চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তাদের মানবিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছে, তাদের ওপর পুলিশি হয়রানি শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে রাজধানীর উত্তরা থেকে সাবেক দুই সাস্টিয়ানকে পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে গেছে বলে জানতে পেরেছি। এছাড়া বিভিন্নজনের বাড়িতে গিয়ে, কাউকে ফোনে কিংবা অন্যভাবে শাসানো হচ্ছে। মেডিকেল সেবায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে। সব মিলে একটি অপশক্তি আন্দোলনের দুই সপ্তাহের মাথায় অপতৎপরতার মাধ্যমে ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনের গদি ঠিক রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিট লিস্টে থেকেও আমি টিলাঘেরা নান্দনিক এই ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়েছিলাম প্রায় দেড় দশক আগে। মনে অন্যরকম একটা পরিকল্পনা ছিল। যদিও মানুষের সব পরিকল্পনা সবসময় বাস্তবে ধরা দেয় না। সে সময় ভর্তি হওয়ার কিছু দিনের মধেই আমরা ভিসিবিরোধী একটি আন্দোলন পেয়েছিলাম। তখনকার ভিসি ছিলেন অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ। সে সময়ও শিক্ষার্থীরা তার বাসভবন (এখন যেখানে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বন্দি রয়েছেন) ঘেরাও করে রেখেছিল। আন্দোলনে উত্তাল ছিল পুরো সিলেট। ক্যাম্পাসের অলিগলি সে সময় ভালো করে চিনতাম না। কিন্তু ভিসির বাস ভবনটা খুব ভালো করেই চিনতাম। প্রতিদিন নিয়ম করে আন্দোলনের মাঠে থাকতাম। তারপর একদিন তার পতন হলো। বাসভবন ভাঙচুর হলো। আগুন জ্বালানো হলো বাসভবনের বিভিন্ন স্থানে। আমার চোখে ভিসি ভবনের আগুনের সেই দৃশ্য, সাদা রঙের দেয়ালে কালো ধোঁয়ার দাগ, দরজা-জানালাসহ অসংখ্য স্থানের ভাঙাচোরা দৃশ্য ভাসে। আমি চোখ না বুজলেও যেন স্পষ্ট দেখতে পাই, আগুনের লেলিহান শিখার সামনে বন্ধু হিমেল ও জহিরের সেই উড়ন্ত ছবিগুলো। যে ছবি দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছিল।

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা চলছে। জাতীয় সংসদ থেকে রাজপথে। আলোচনা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে, ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ পরিসরে। অবশ্য যতটা না আলোচনা তার চেয়ে শতগুণ বেশি সমালোচনা। নিজ ক্যাম্পাসে এক প্রকার অস্পৃশ্য, অপায়া, অবান্তর হিসেবে লজ্জাজনক দিন পার করছেন তিনি। তিনি তার বাসভবনে বন্দী হয়ে আছেন। বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না প্রায় দুই দিন। পানির সরবরাহও ছিল না। চুলায় গ্যাস ছিল না। তোষামোদকারীরা পাশে নেই। তার জন্য কারো মনে ঘৃণার কমতি নেই। এতসব নেই’র মাঝে কেবল তিনিই এখন পর্যন্ত স্বপদে বহাল রয়েছেন। তার এই স্বপদে বহাল থাকা নিয়ে আমাদেরও বিস্ময়ের শেষ নেই। আফসোস আর অনুশোচনা আছে তবে, তার জন্য করুণা কিংবা মায়া দেখানোর সুযোগটুকুও নেই। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তিনি যে রেকর্ড গড়েছেন সেই রেকর্ডই বলে দেয় যে, ভিসি হিসেবে ক্যাম্পাসে এক মুহূর্তও তার থাকার অধিকার নেই।

বর্তমান ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ একজন উচ্চালিভাসী প্রশাসক। তার সময়ে ক্যাম্পাসে অনেক দৃশ্যমান উন্নতি সাধিত হয়েছে। সুরম্য অট্টালিকায় শাবি পেয়েছে পূর্ণাঙ্গ রূপ। শুনেছি তিনি ১২০০ কোটি টাকার বিদেশি প্রকল্প নিয়েও কাজ করছেন বেশ জোরেশোরে। তাইতো ক্যাম্পাসের অনেক শিক্ষকই তাকে চান। তিনি চলে গেলে এই প্রকল্পগুলোর কী হবে- এই ভেবে ভেবে অস্থির সময় কাটছে সেইসব শিক্ষকেরও। এসময় শিক্ষকদের কাউকে কাউকে দেখেছি প্রকাশ্যে এই টাকার মায়ায় হাপিত্তেশ করতে। মনে হয়েছে এই টাকা দিয়ে কোনো প্রকল্প নয়, তাদের অবস্থারই উন্নতি ঘটানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

ভিসি ফরিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলন করছেন। তাদের সেই আন্দোলনে একাত্ম হয়ে সাবেক অনেক শিক্ষার্থীই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালসহ দেশের প্রায় সবগুলো ক্যাম্পাসে। অনেকে আবার ক্যাম্পাসের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সিলেটে ছুটে গিয়েছেন। তার পদত্যাগের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে সেখানকার শিক্ষক সমিতিও। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ন্যায্য স্বীকৃতি দিয়ে ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় সংসদের আলোচনায় সংসদ সদস্যরা তার আত্মমর্যাদা বোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একজন উপাচার্য কী করে তার মান-সম্মানের গোষ্ঠী বিনাশ করতে পারেন তা নিয়ে তারা রীতিমত হতবাক হয়েছেন।

তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এসব আহ্বান, বিক্ষোভ কিংবা সংহতি কোনো কাজে আসছে না। তিনি তার পদ টিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাইরে তার বিরুদ্ধে গণঅনশন চলছে। হাসপাতালের বিছানায় নিস্তেজ কতগুলো প্রাণ মৃত্যুর প্রহর গুণছে। হাজারো মানুষ ছি ছি করছে। তবুও তিনি অপেক্ষায় আছেন ‘পৃথিবী আবার শান্ত হবে, পশ্চাদদেশে আবারো ফিরবে গদি/ আন্দোলন থেমে যায় যদি, এই কষ্ট-গ্লানি নাহি রবে’-টাইপের মনো বাসনা নিয়ে।

দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় এ ধরনের আন্দোলন হয়ে থাকে। বিগত দুই বছর করোনা আমাদের দমিয়ে রেখেছে। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিবেশ প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সেই পরিবেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। ভিসির এমন নির্লজ্জ আকড়ে থাকার রেকর্ড থেকে মনে হচ্ছে তিনি অতীতের সব রেকর্ড মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। তার কাছে জাহাঙ্গীনগর, চট্টগ্রাম বরিশাল, রংপুরের বেগম রোকেয়া, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নিকট অতীতের সব ভিসিবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। সেখানকার ভিসিদের চাইতে তার মান মর্যাদার ভীত এত শক্ত যে, দুই সপ্তাহের টানা আন্দোলন, জাতীয় সংসদ থেকে চায়ের দোকানে হওয়া যাবতীয় ভর্ৎসনা-তিরস্কারেও তার বিন্দুমাত্র ঘাটতি হচ্ছে না।

ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ইতঃপূর্বে আন্দোলনের মুখে পতন হওয়া দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের আইডল। তিনি সবাইকে যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন কী করে শত বঞ্চনার মধ্যেও নিজের গদি ঠিক রাখা যায়। কী করে হাজারো গালি হজম করেও নিজের ‘সম্মান অক্ষুণ্ন’ রাখা যায় সে বিষয়টি তিনি অন্যদের যেন হাতে-কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। হয়তো তিনি তার পূর্বসূরি ভিসি মোসলেহ উদ্দিনকেও টপকে যেতে পারেন। কেননা ভিসি মোসলেহ উদ্দিনের পতন হয়েছিল মাত্র এটি লাশের বিনিময়ে। আর ভিসি ফরিদ উদ্দিনের সামনে এখন অনেকগুলো অনশনরত শিক্ষার্থী। চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্য বলছে- এই শিক্ষার্থীদের অনেকের অবস্থা খুবই নাজুক। যেকোনো পরিস্থিতিতে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, শাবিপ্রবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :