জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন, তবে নির্বাচনী রাজনীতিতে কোনো সাফল্য নেই মান্নার

প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:২৪ | আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২২, ১০:৫৭

​বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস

ছিলেন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। একজন সুবক্তা ও দক্ষ সংগঠক হিসেবেও পরিচিতি ছিল মাহমুদুর রহমান মান্নার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরপর দুইবার ভিপি নির্বাচিত হওয়ার সৌভাগ্য তিনি ছাড়া আর কারো হয়নি। এই নেতা একসময় পালন করেছেন আওয়ামী লীগের মতো দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব। তবে নির্বাচনী রাজনীতিতে তার নেই কোনো সাফল্য।

নৌকার হয়ে দুইবার, আর ধানের শীষ নিয়ে একবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও জয়ের দেখা পাননি মান্না। সবশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রতীক নিয়ে দলটির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়া-২ থেকে ভোটের লড়াইয়ে হেরেছেন এক লাখের বেশি ব্যবধানে। ২০১৫ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যান মান্না।

অবশ্য এসব নিয়ে তেমন আক্ষেপ নেই নাগরিক ঐক্যের প্রতিষ্ঠাতা ও আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খুব ভালো যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দল পরিচালনায় আর্থিক টানাপোড়েন আছে জানালেও হতাশ নন এই রাজনীতিক। ৫০ বছরের বেশি সময় রাজনীতিতে সময় পার করা মান্না ক্যারিয়ারে এমপি বা মন্ত্রী হতে না পারা নিয়ে আফসোস নেই বলে দাবি করেন ঘরোয়া বৈঠকে।

২০১৫ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে তাকে প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়েছিল নাগরিক ঐক্য। তখন তিনি কারাগারে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পিছিয়ে যান। এর আগে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নিজ এলাকা বগুড়া-২ আসন থেকে নির্বাচনে হেরে যান। সবশেষ ২০১৮ সালে ওই আসনেই ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করে মহাজোটের প্রার্থীর কাছে  এক লাখ ১৫ হাজার ৭৬৩ ভোটে পরাজিত হন মান্না।

রাজনীতির বর্ণাঢ্য জীবনে একাধিকবার কারাগারেও গেছেন মান্না। বিএনপির আমলে ২৬ মাস, এরশাদ সরকারের সময় আট মাস এবং আওয়ামী লীগের সময় ২২ মাস কারাভোগ করেছেন তিনি।

ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ার সময় ১৯৬৮ সালে মান্না বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে তিনি ছাত্রলীগের একটি প্যানেল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। পরে জাসদ গঠিত হলে মান্না চলে যান ওই দলে। ছাত্র রাজনীতিতে মান্নার প্রতিভা দেখে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন জাসদ নেতা আ স ম রব তাকে ঢাকায় কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেন। ওই বছরই মাত্র ২২ বছর বয়সে মান্না জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৭৯ সালে জাসদ ছাত্রলীগ ও ১৯৮০ সালে বাসদ ছাত্রলীগ থেকে পর পর দুই মেয়াদে ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হন মান্না। দুইবারই তার সঙ্গে জিএস নির্বাচিত হন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক এমপি আখতারুজ্জামান। ডাকসুর ওই দুই নির্বাচনে মান্নার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।  তারা দুজন বন্ধুও বটে।

আশির দশকে মান্না বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শরিক হন। এরপর একসময়ের জাসদ নেতা মির্জা সুলতান রাজার নেতৃত্বে জনতা মুক্তি পার্টিতে যোগ দেন তিনি। ওই দল ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে বিলুপ্ত হলে মান্নাও আওয়ামী লীগে চলে আসেন।

আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার নেপথ্যের কথা বলতে গিয়ে আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মান্না বলেন- ‘শেখ হাসিনাই আমাকে ডেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে বলেছিলেন। সে সময় আমার মনে হয়েছে, আওয়ামী লীগই ভালো দল।’ এরপর মান্না আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকও হন।

তবে এক-এগারোর সময় ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে তার নামও আলোচনায় আসে। ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি কোনো পদ পাননি।

২০১২ সালে মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্য নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। বিএনপিনির্ভর ওই জোট গঠনে মান্না গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনের পর থেকে ঐক্যফ্রন্ট অকার্যকর।

২০১৯ সালের মে মাসে মির্জা ফখরুলের শপথ না নেওয়া বগুড়া-৬ আসনে মনোনয়ন দিয়ে মান্নাকে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে আদর্শিক ঐক্য না থাকায় দলবদলে রাজি হননি তিনি।

রাজনীতির এই দীর্ঘ সময়ে মান্নার ভাগ্য খুলতে খুলতে আর খুলেনি। তার সঙ্গে রাজনীতি করা ব্যক্তিরা যখন একাধিকবারের মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন তিনি একবারও সেই সুযোগ পাননি। এমনকি ঢাকার মেয়র হওয়ার আশাও পূরণ হয়নি তার।

অবশ্য অভ্যন্তরীণ আলোচনায় মান্না একাধিকবার মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পাওয়ার কথা বলেছেন। মান্নার ভাষ্য- ‘মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ জীবনে একাধিকবার পেয়েও গ্রহণ করিনি। ছাত্ররাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমল থেকে পরপর তিনটি সরকার আমাকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তখন একটি আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ ছিলাম, যার সঙ্গে মন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি বেমানান ছিল বলে মনে করেছি।’

আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাদ পড়া নিয়ে মান্নার বক্তব্য ছিল- আমি মনে করেছি আওয়ামী লীগ আমার সঙ্গে অন্যায় করছে। ফলে তাদের সঙ্গে থাকিনি।

ফোনালাপ ফাঁসে পড়তে হয় বেকায়দায়

বিএনপি জোটে যাওয়ার আগে নিউইয়র্কে অবস্থান করা দলটির প্রয়াত নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে মান্নার টেলিফোন আলাপের অডিও ক্লিপ প্রকাশ হলে চারিদিকে হইচই পড়ে যায়। কথোপকথনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস অবরূদ্ধ করার জন্য খোকাকে পরামর্শ দেন। তিনি অন্য একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির সঙ্গেও কথা বলেছিলেন, যিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক হয়ে সরকারের পরিবর্তন করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মান্না গ্রেপ্তার হন। রাষ্ট্রদ্রোহ ও সেনা বিদ্রোহে উসকানির অভিযোগে ওই বছরের ৫ মার্চ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি গুলশান থানায় পৃথক মামলা হয়। ২২ মাস কারাভোগের পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে তিনি মুক্তি পান।

ব্যবসা আয়ের উৎসেও ভাটা!

জানা গেছে, ব্যবসায় মন্দা ও আয়ের উৎস কমে যাওয়ায় দল চালাতে হিমশিম খেতে হয় মান্নাকে। করোনাকালে তোপখানা রোডে নাগরিক ঐক্যের অফিস ভাড়াও বাকি পড়ে যায়।

ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, মান্নার একটি কোল্ড স্টোরেজ আছে। সেখানে পার্টনারের সঙ্গে সমস্যায় পুরো প্রাপ্য থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। এছাড়া একটি সিএনজি স্টেশন আছে। তবে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা থাকলেও এখনো সংযোগ পাননি বলে অভিযোগ মান্নার। এছাড়া আগে পত্রিকায় লেখালেখি ও টক শো থেকে কিছু আয় ছিল তার। কিন্তু বর্তমানে সেটি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে বলে ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছেন মান্না।

মাহমুদুর রহমান মান্নার স্ত্রী মেহের নিগার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই ছাত্রীকে জীবনসঙ্গী করেছেন তিনি। নানাভাবে মান্নাকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী। বাসায় অল্প-স্বল্প হলেও স্ত্রীকেও সহযোগিতা করেন মান্না। তবে রাজনীতির ব্যাপারে তেমন আগ্রহী না মেহের নিগার।

মা-বাবার ১১ সন্তানের মধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্না চতুর্থ। তারা সাত ভাই, চার বোন। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। সার্টিফিকেট অনুসারে ১৯৫১ সালে বগুড়া শহরের চকলোকমানে জন্ম মান্নার। পিতা আফসার উদ্দিন আহমদের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জের বিহার ফকিরপাড়া।

(ঢাকাটাইমস/২৭জানুয়ারি/বিইউ/জেবি)