যা হতে পারে ‘সোনার বাংলা দর্শনের’ অনন্য প্রতিপাদ্য

প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১৯:১৯

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, পিপিএম

মহান সৃষ্টিকর্তার মহাজাগতিক সৃষ্টির অন্যতম বিস্ময়কর সৃষ্টি নিঃসন্দেহে মানবজাতি। প্রাণাত্মাসম্পন্ন জীবজগতের সেরা জীব হিসেবে মানুষ পরিচিত। প্রাণিজগতের সবার মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, বিবেকবোধ বিশেষত উন্নত ভোকাল কর্ডের বিশেষত্বে মানুষই প্রাণিকুলের শিরোমণি। জীবনচক্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষকে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, আচার-ব্যবহার, কৃষ্টি-কালচার, মূল্যবোধ, ধর্ম-কর্ম, দেশপ্রেমসহ হাজারো অনুষঙ্গকে গ্রহণ করতে হয়। ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, কল্যাণ-অকল্যাণ, উপকারী কিংবা ক্ষতিকর এ বিষয়গুলো সঠিক উপলব্ধি করে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার সংবেদনশীল যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।

তাই মানবসন্তান হিসেবে জন্ম নিলেও সবাইকেই প্রকৃত মানুষ বলার সুযোগ নেই। স্বশিক্ষা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কল্যাণ-অকল্যাণের পার্থক্য শিখে বাস্তব জীবনে সংবেদনশীলভাবে দৃশ্যমান প্রয়োগ করার সামর্থ্যসম্পন্ন মানুষ যখন মানবসম্পদে পরিণত হয় তখন তাকে আমরা প্রকৃত মানুষ বলতে পারি এবং সৃষ্টিসেরা অভিধার মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।

বেড়ে ওঠার বিভিন্ন স্তরে নানা রকম জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে বুদ্ধিমত্তা ও সংবেদনশীলতার মাধ্যমে তা উতরিয়ে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যেসব দেশ, জাতি-রাষ্ট্র যত বেশি সফলকাম হতে পেরেছে সেসব দেশে অপরাধপ্রবণতা কমতে কমতে শূন্যের কোটামুখী হয়েছে। তারা এই অস্থির বিশ্বেও প্রকৃত মানুষ হিসেবে স্বর্গীয় জীবনযাপন করছে। সৃষ্টির সেরা মানুষের রোল মডেল হিসেবে তারা অনুসরণীয়।

আমরা সুইজারল্যান্ডের কথা বলতে পারি। বাঙালি জাতির মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে সুইজারল্যান্ড বানাতে চেয়েছিলেন। বাঙালির জীবনে সে স্বপ্ন এখনো অধরাই রয়ে গেছে বৈকি।

১৯৭৫ সালে ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে জাতির পিতার জীবন অবসান-উত্তর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার উন্মত্ত নষ্ট মনুষ্যত্বের কালো অধ্যায়কেই রাজনৈতিক চর্চার উত্তম পথ হিসেবে বেছে নেন। বঙ্গবন্ধুর নাম-গন্ধ মুছে ফেলার চক্রান্তের অংশ হিসেবে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড শুধু সংঘটিত করেই ক্ষান্ত হননি; তদুপরি  তাঁকে যেন আপামর বাংলার মানুষ খুব সহজে কাছে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে না পারে সেজন্য রাজধানীর বুক থেকে সরিয়ে নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন খুনি চক্রের নেতারা। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে না মর্মে পবিত্র সংবিধানকে কলঙ্কিত করেই সন্তুষ্ট থাকেননি সেই সঙ্গে  সংবিধানের অন্যতম সৌন্দর্য অসাম্প্রদায়িকতাকে পরিহার করে বিপরীতমুখী সাম্প্রদায়িক পথে চলতে বাধ্য করলেন বাঙালি জাতিকে।  মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে দিয়ে সাম্প্রদায়িক চেতনাকে শক্তিশালী করতে মনুষ্যত্বের চরিত্র হননে হেন কোনো কাজ নেই যা তারা করেনি। একটি লম্বা সময় অতিক্রম করতে গিয়ে সময়ে-অসময়ে সুস্থভাবের অভাবে পরিকল্পনা ষড়যন্ত্রের ডালপালায় কয়েকটি প্রজন্ম মন্দের অনুসারী হয়ে সংখ্যাতত্ত্বে মন্দ মানুষের সংখ্যাই বেড়ে গেল এই দেশে। রুদ্ধ হতে থাকলো প্রকৃত মানুষ হওয়ার সব পথ, আর উন্মুক্ত হতে থাকলো মনুষ্যত্ব বিসর্জনের সব দরজা।

এসব রাষ্ট্রনায়ক মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্বের রাস্তা থেকে বিচ্যুত করে প্রেষণা হিসেবে উপহার দিতে থাকলেন লুণ্ঠিত টাকা-পয়সার কিছু ভাগ-বাটোয়ারা, আর নির্মাণকাজে ব্যয়িত টাকার তথাকথিত উন্নয়ন। অপকর্মের পুরস্কার অন্যায় অর্থ অর্জনের দাপুটে প্রশান্তি নিয়েই বেড়ে উঠলো কয়েক প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এ দেশের সন্তানেরা। পূর্ব থেকে চলে আসা মৌলবাদের একটি বড় ধারা তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্য করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শেষ সম্মানটুকুতে লজ্জা-অপমানের বিষাক্ত পেরেক ঠুকে দিলেন। চিহ্নিত রাজাকার-আলবদরদের মন্ত্রী বানিয়ে সরকারি গাড়িতে উড়াতে শুরু করলেন লাল-সবুজের পতাকা।

দুর্ভাগ্যের দুষ্টচক্র অতিক্রম করে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে জনমুখী করার লক্ষ্যে দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালিয়ে নব্বইয়ের গণআন্দোলন ও স্বৈরশাসন উৎখাতে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতি ও ব্যক্তি শেখ হাসিনার মনে যে গভীর ক্ষত ছিল, সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বিস্তারিত স্বপ্নের ক্যানভাসে যেসব পরিকল্পনা চিত্রিত হয়েছিল, সবকিছুকে মিলিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণে তা খুব বেশি যথেষ্ট ছিল না। পথের কাঁটা মুক্ত  করার লক্ষ্যে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্র তৈরি করতে, ইতিহাসের কলঙ্কখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আবার উঠেপড়ে লাগল।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতার থাকে, মাঠের রাজনীতিতেও যাতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে সে লক্ষ্যে শেখ হাসিনাকে খুন করতে মরিয়া হয়ে ওঠে চক্র। বারবার তার ওপর মরণ আঘাত আসতে থাকে। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ হাসিনার মৃত্যুকে নিশ্চিত করতে আর্জেস বোমা স্নাইপার রাইফেলের ভয়ংকরী নৃশংস জঙ্গিপনা আইভি রহমানসহ ২২ জন নেতা-কর্মীর প্রাণ কেড়ে নেয়। কোন দৈব মাঙ্গলিক কল্যাণে বেঁচে গেলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। মাঝখানে সামরিক-বেসামরিক যৌথ কায়দায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়টিও নানারকম অনাচারেই পরিপূর্ণ ছিল। ক্ষমতালোভীরা কাঙালিপনা বীভৎস রূপ ধারণ করতে থাকলো। পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ড কিংবা পাকিস্তানের মতো সামরিক কায়দায় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকবার কৌশল হিসাবে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে মাইনাস-টু থিওরি বাস্তবায়নের চেষ্টায় শেষ অবধি ব্যর্থ হয়েছেন। এ ঘটনা-উত্তর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত জোট সরকার ক্ষমতায় আসেন।

জঙ্গি উত্থান, মৌলবাদী আগ্রাসন, দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বুনন করা ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত জাল, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে জড়ানো বাঙালির ভঙ্গুর মনস্তত্ত্বকে বিবেচনায় রেখে একের পর এক শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি টানার লক্ষ্যে, জঞ্জালমুক্ত করতে, জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অপরাধী রাজাকার-আলবদরদের বিচারিক কার্যক্রম শুরু করলেন। একই সঙ্গে দেশকে স্বনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেসব সূচকে গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা যাবে, প্রাধিকার ভিত্তিতে সে দিকগুলো বিবেচনায় নিয়েও পথ চলতে শুরু করলেন। বিশেষ করে বিচারের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের কুৎসিত চেহারা কতটা ভয়ংকর হতে পারে, চলমান এ প্রজন্ম সেটি প্রত্যক্ষ করেছে কমবেশি সবাই। অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার এমন সাহসী পদক্ষেপের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন অংশীদারদের বিমাতাসুলভ আচরণকে  উপেক্ষা করেই নিজ দৃঢ়তায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সামগ্রিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সূচকে পর্যায়ক্রমিক সাফল্য ধরে রেখে দেশকে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন। উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার সামগ্রিক রোডম্যাপ অংকন করে সে পথে সাফল্য অর্জনে ধারাবাহিক আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন।

সাধুবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিশ্বব্যাংকের অসাধু মননে কুঠারাঘাত করে অসাধুদের আরোপিত কালিমা বাঙালির গায়ে যেমন লাগতে দেননি তেমনি রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে সফল পদ্মা সেতু নির্মাণ করে নিজেদের সক্ষমতার আত্মবিশ্বাসে যে নতুন শক্তি সঞ্চয় ও প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন, তা বিশ্বে মাইলফলক হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, টেকনোলজি উল্লেখ করার মতো প্রায় সব ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কর্মসৃজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্রতা জয়ে অনেক সফলতাও এসেছে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে মানুষের মেধা উর্বর হয়েছে। তদুপরি অতি মূল্যবান দুটো বিশেষ দিক প্রকৃত অর্থে সৃজনশীল সুখপাঠ্য অর্থাৎ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে এবং তা আরও বিকশিত করে টেকসই রাখতে এ জাতির মননের অবনমন ঘটেছে যা চোখে পড়ার মতো।

মাত্র সাড়ে তিন বছরের রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু এ জাতির মানুষের লোভ লালসা, লুটেরা স্বভাব, ঠকবাজিতা, অতি পুঁজিবাদিতার দুর্নীতি এমন আরো অব্যক্ত কত যে শঠতার চরিত্রে বাঙালিকে নতুন করে যেভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা থেকে পরিত্রাণ পেতেই তিনি রাষ্ট্রপরিচালনায় পরিবর্তন এনে সমগ্র বাংলাকে সমবায়ভিত্তিক যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কথা ভেবেছিলেন, তাতে একদিকে যেমন গরিব-দুঃখী মেহনতি সাধারণ মানুষের পর্যায়ক্রমিক ভাগ্যের পরিবর্তন হতো, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আরও সৌন্দর্য ছড়াত, আর সেই সঙ্গে একে-অপরের সহায়ক হয়ে গড়ে উঠত বাঙালির অনন্যসাধারণ মনস্তত্ত্ব, যা ছাড়া প্রকৃত সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয়।

দিব্যচক্ষে বিষয়টি সমাজতন্ত্রের চিত্র অঙ্কন করলেও তা ছিল বঙ্গবন্ধুর একেবারেই নিজস্ব চিন্তার ফসল। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থেকে এ ফসল ঘরে এনে দিতে পারলে এটি হতে পারত বিশ্বমানবতার সেরা অনুসরণীয় মডেল। কাজেই দৃশ্যমান উন্নয়নের পাশাপাশি সমান্তরালে নতুন প্রজন্ম এবং আগত শিশুদের জন্য উন্নত মনন তৈরিতে গবেষণালব্ধ মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে সুনাগরিক তৈরির রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা জরুরি প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু-কন্যার প্রচেষ্টায় একদিকে জঞ্জালমুক্ত হতে থাকবে দেশ, অন্যদিকে সোনালি শিশুরা বেড়ে হয়ে উঠবে সোনার মানুষ, রক্ষা করবে আপনার প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, সেই সঙ্গে উন্নত মননের কষ্টিতে বিকশিত হয়ে আরো বেশি টেকসই হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য লাল-সবুজের পতাকা।

লেখক: পুলিশ সুপার, কবি ও কণ্ঠশিল্পী।