পুলিশের মাদক নিরাময় কেন্দ্র দ্যুতি ছড়াচ্ছে, প্রশংসা সব মহলে

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:০৮ | প্রকাশিত : ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ২১:৩০

জুলকার নাইম রাকিব (ছদ্মনাম)। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় জড়িয়ে পড়ে মাদকের সঙ্গে। এসএসসির গণ্ডি পেরোনোর আগেই মাদকাসক্ত বন্ধু ও কাজিনদের সঙ্গে যাওয়া-আসা শুরু করে বারে। আসক্ত হয়ে নিয়মিত মদ-বিয়ারে ডুবে থাকতে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারের এই কিশোর।

এক পর্যায়ে পরিবার থেকে পড়াশোনা করতে তাকে পাঠানো হয় বিদেশে। কিন্তু পরিবার যে আশায় বিদেশে পাঠায় তা সফল তো হয়নি, উল্টো মাদক সেবনের মাত্রা বেড়ে যায়। পরবর্তীতে দেশে ফিরিয়ে এনে সুস্থ জীবনে ফেরাতে একে একে চারটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয় রাকিবকে। কিন্তু কোনো কাজে আসেনি চিকিৎসা। সবশেষ উদ্বোধনের দিনেই ভর্তি হন পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট পরিচালিত মাদকাসক্তি নিরাময় ও মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’-এ। দীর্ঘ প্রায় চারমাস চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠেছে এই তরুণ। মাদক ছেড়ে তিনি এখন ওয়েসিসে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। খুঁজছেন চাকরি।

বৃহস্পতিবার ঢাকাটাইমসকে মাদককে জয় করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার বর্ণনা দেন এই তরুণ। রাকিব বলেন, আগে আমি যেসব ট্রিটমেন্ট (চিকিৎসা) নিয়েছি সেগুলো আমার মনের মতো হয়নি। ওয়েসিসে চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে এখানেই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছি। এখানকার চিকিৎসা পদ্ধতি, পরিবেশ এবং সবার আন্তরিকতা খুবই চমৎকার। এখন আমি পুরোপুরিভাবে সুস্থ, ইনশাল্লাহ।

গত ৭ অক্টোবর পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ‘ওয়েসিস’। অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ও নান্দনিক পরিবেশে উন্নত ব্যবস্থাপনায় দেশের সবচেয়ে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এটি। স্বনামধন্য টেকনিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ কেন্দ্র। তুলনামূলক কম খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসা দেওয়া হয় এখানে।

সাত তলাবিশিষ্ট আধুনিক এই মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা।

পোস্তগোলা ব্রিজ পার হয়ে এক কিলোমিটার এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। সম্পূর্ণ অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে। সবার জন্য উন্মুক্ত। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদের প্রচেষ্টায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান ও একদল দক্ষ কর্মীবাহিনী।

যেভাবে আলোর পথের দিশা দিচ্ছে ওয়েসিস

ওয়েসিস সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর‌্যন্ত ১৩ জন প্রতিষ্ঠানটি থেকে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। চিকিৎসার জন্য আসাদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ব্যাংকার ও বেসরকারি চাকরিজীবীরাও রয়েছেন। গাঁজা, ইয়াবা ছাড়াও আইস, প্যাথেডিনে আসক্ত রোগীরা এখানে চিকিৎসা পাচ্ছেন।

উদ্বেগের বিষয় এই কেন্দ্রে যারা চিকিৎসার জন্য আসেন তাদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ।

তবে তরুণীদের অনেকে টেলিমেডিস সহায়তা নিচ্ছেন এখান থেকে। যদিও নারী মাদকাসক্ত কিংবা মানসিক হতাশায় থাকলে তাদের আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে এখানে। তাদের নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থান যাতে ঠিক থাকে সেজন্য আলাদা ফ্লোরে থাকা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। জনবলও আলাদা রাখা হয়েছে তাদের চিকিৎসা ও দেখভালে।

ডিআইজি হাবিবুর রহমানের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয় বলে জানা গেছে। যেখানে প্রতিদিন বিনামূল‍্যে ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা দেয়া হয়। প্রতিনিয়ত বিষয়টি মনিটরিংও করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

মাদকাসক্তের পাশাপাশি মানসিক হতাশায় ভুগছেন এমন রোগীরাও টেলিমিডিসিন সেবা নিতে ফোন করতে পারছেন। (০১৯৩০-৪০৪০৪০) এই নম্বরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়েসিসের দায়িত্বপ্রাপ্তরা শুধু চিকিৎসা সেবা দিয়েই থেমে থাকেন না। পাশাপাশি চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তিদের সুস্থ জীবনে ফিরতে পরামর্শ ও নির্দেশনাও দেন। আউটডোরেও মানসিক রোগীদের দেয়া হয় ওয়েসিসে।

মাদকাসক্তদের চিকিৎসায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, ইয়োগা এক্সপার্ট এবং অভিজ্ঞ অ্যাডিকশন কাউন্সেলরদের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। এছাড়া ওয়েসিসের চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক তদারকি, স্বতন্ত্র কাউন্সেলিং সেশন, উন্নতমানের শরীর চর্চা কেন্দ্র, বিনোদন সুবিধা, ইনডোর ও আউটডোর গেমস, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ ও জীবনধর্মী শিক্ষামূলক নানা আয়োজনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

দেশের অনেক মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে রোগীদের চিকিৎসার নামে নির্যাতন করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিযোগ আছে মানসম্মত চিকিৎসা না পাওয়ার। অপচিকিৎসা-নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। আবার কোনো কোনো নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার নামে রোগীকে আটকে রেখে এমনভাবে নির্যাতন করা হয় যে, মুক্তির পর রোগীকে সেই নির্যাতনের ক্ষত বহুদিন বয়ে বেড়াতে হয়।

২০২০ সালের ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবরের মাইন্ডএইড হাসপাতালের স্টাফদের নির্যাতনে মারা যান পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিম। সম্প্রতি গাজীপুরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রের অভিনেতা অনিক রহমান অভিসহ ২৮ জনকে উদ্ধার করে র‌্যাব। র‌্যাব জানিয়েছে এই কেন্দ্রটি ছিল মাদকের আখড়া।

রোগীদের সেবায় যত আয়োজন

জানা যায়, ৬০ শয্যার এই কেন্দ্রে আছে ২২টি কক্ষ। পুরুষদের জন্য ১৬টি কক্ষে আছে ৪৬টি শয্যা। আর নারীদের ছয়টি কক্ষে শয্যা ১৪টি। তাছাড়া ডাবল কেবিনে ২৮টি, ট্রিপল কেবিনে ১৫টি এবং জেনারেল ওয়ার্ডে আছে ১১টি শয্যা। এ ছাড়া জেনারেল ট্রিপল বেড আছে ছয়টি। জেনারেল ওয়ার্ড ছাড়া সব ওয়ার্ড বা কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।

ওয়েসিসে অত্যাধুনিক ডোপ টেস্ট মেশিন ‘গ্যাস প্রমোটো গ্রাফি’ আছে। বর্তমানে শুধু প্রস্রাব পরীক্ষা করে ডোপ টেস্ট করা হয়। কিন্তু ‘গ্যাস প্রমোটো গ্রাফি’তে চুল ও নাক থেকেও পরীক্ষা করা যায়।

বর্তমানে মাদক গ্রহণের তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু আধুনিক এই মেশিনে মাদক গ্রহণ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করলে প্রমাণ ধরা পড়ে। এ ছাড়া চীন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে মাদক নিরাময়ে আকুপাংচার চিকিৎসা বেশ জনপ্রিয় ও কার্যকরী। এখানে সেই ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ওয়েসিস উদ্বোধনের দিনে পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ এটি নিয়ে তার প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন। পুলিশ প্রধানের বক্তব্য ছিল, ‘মাদকাসক্তদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশে ওয়েসিস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গরিব বা ধনী পরিবারের কেউ যদি মাদকাসক্ত হয়, তাহলে পরিবারটির কী অবস্থা তা দেখার দুর্ভাগ্য আমার অনেকবার হয়েছে। সমাজের অনেক সম্মানিত ব্যক্তির নিরব কান্না আমাকে দেখতে হয়েছে। এই গোপন কান্না এত কষ্টের যা কারও সঙ্গে শেয়ারও করা যায় না সামাজিক মর্যাদার কারণে। কিন্তু আমার কাছে এসে শেয়ার করেছেন।

এসময় ওয়েসিস ছাড়া আরো একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র বা হাসাপতাল নির্মাণের পরিকল্পনার কথাও বলেছিলেন। তার স্বপ্ন হাসপাতালটি হবে ৫০০ থেকে ১ হাজার বেডের। পুলিশ হাসপাতালে একটি ক্যান্সার ইউনিট করতেও সেদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছিলেন পুলিশ প্রধান।

যা বলছেন ডিআইজি হাবিবুর রহমান

প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাজ তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। ওয়েসিস প্রাথমিকভাবে সফল জানিয়ে ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘সুচিকিৎসার মাধ্যমে মাদকাসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে সুন্দর জীবন গড়ে দিতে আমরা কাজ করছি। মাদকের ভয়াবহ ছোবলে আমাদের তরুণ সমাজের অনেকে জীবন নষ্ট করছে। তাদেরকে মাদকমুক্ত করে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে ‘ওয়েসিস’। সেবাগ্রহীতারা এখানে আন্তর্জাতিক মানের সেবা পাচ্ছেন জানিয়ে ডিআইজি হাবিব বলেন, ওয়েসিস সত্যিকার অর্থেই মরুভূমিতে এক মরুদ্যান।’

হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘৫০০ শয্যা বিশিষ্ট মানিকগঞ্জে আরও একটি ফাইভস্টার ও আন্তজার্তিক মানের অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এরইমধ্যে কালীগঙ্গা নদীর তীরে কয়েক বিঘা জমি কেনা হয়েছে। ওই কেন্দ্রটিতে ধর্মীয় সুবিধা ছাড়াও সুইমিং পুল, গার্ডেনসহ নানা ধরনের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে।’

টেলিমিডিসের বিষয়ে পুলিশের এই ঊর্ধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে আমাদের লোকবল সংকট নেই। মাদকাসক্ত কেন্দ্র হিসেবে কোথাও এফসিপিএস চিকিৎসকরা সেবা দেন না; যা আমরা দিচ্ছি। তাছাড়া টেলিফোনে ২৪ ঘণ্টা আমাদের চিকিৎসা বিভিন্ন সেবা মিলছে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুশান্ত নারায়ণ দে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশের রোগী পাচ্ছি। যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করিয়েছেন। সেখানে ভালো সেবা না পাওয়ার কারণে আমাদের এখানে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর যারা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন, তাদেরকেও প্রতিমাসে একবার আমাদের এখানে আসছে হয়। এসময় তাদেরকে ডোপ টেস্ট ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে কাউন্সিলিং করা হয়।

করোনাকালীন সময়েও আমরা স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সকল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/২৭জানুয়ারি/বিইউ/ইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :