পিস্তল আছে গুলি নাই, গুলি আছে পিস্তল নাই

প্রকাশ | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪:৪২

সানবীর রূপল

বুধবার রাতে পিস্তল দিয়ে আত্মহননের ঘটনায় ফেসবুকে প্রথম যার স্ট্যাটাসে মায়া কান্দন দেখলাম জানামতে তিনি নিজেই তার অধীনস্থদের মানসিক দুশ্চিন্তার ঘোরের মধ্যে রাখতে পছন্দ করেন। এটা তার একটা খেলা। এরসাথে তাকে, তার সাথে ওকে লাগিয়ে রাখার খেলা। দমিয়ে রাখার খেলা।

 

বাংলাদেশের সমাজে আশপাশের প্রায় সকলেই কমবেশি নানা পদের খেলায় মত্ত। স্বামীর খেলায় স্ত্রী বিরক্ত, স্ত্রীর খেলায় স্বামী বিরক্ত, প্রেমিকার খেলায় প্রেমিক বিরক্ত, সহকর্মীর খেলায় সহকর্মী, বন্ধুর খেলায় বন্ধু, বসের খেলায় অফিস বিরক্ত। এ খেলছে ওর সাথে ও খেলছে তার সাথে। চক্রাকার খেলা চলে। এই যে প্রত্যেকেই খেলছেন, বলি এক জীবনে এতো খেলে লাভটা কী! হয় কয়টা টাকা বেশি পাবেন, নয় একটা পদ, একটা দামি গাড়ি, একটা দামি শাড়ি। এই তো?

 

একটু চিন্তা করে দেখেন  স্থান কাল পাত্রভেদে আপনি নিজেও কোথাও খেলার শিকার।

 

২. পৃথিবীতে মনখুলে ভালোবাসার বাজার এখন চরম মন্দা। কেউ কাউকে জানতে চায় না। আমি নিজেও হয়তো এর বাইরে না। তবে আমি যখন একটা টিমের প্রধান দায়িত্ব পালন করেছি কাজের সাথে মানসিক স্বাস্থ্য বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছি। প্রত্যেকের চোখের ভাষা বুঝতে চেয়েছি। হয়তো আমার ওপর আস্থা রেখে টিমের প্রত্যেক সহকর্মী তাদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি সমস্যা আমার কাছে জমা রাখতো। তাদেরকেও বলেছি মানসিক স্বাস্থ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

 

অথচ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বলতে গেলে তিনি তিরস্কার করেছেন। তাদের দরকার আউটপুট, তার দরকার দমিয়ে রাখা, তাদের দরকার টাকা, তাদের দরকার মানসিক চাপে রাখা, আতংকে রাখা। কর্মস্থলের এই চতুর্মুখী মানসিক গ্রাসে, অবমূল্যায়ন সইতে না পেরে একজন তার ছোট্ট শিশুকে রেখে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চাইলো। সেদিন খবর চাউর হয়েছে। তড়িঘড়ি সব নড়েচড়ে বসেছে। লোকটা বেঁচে গেছে। কিন্তু আশপাশের লোককে বলতে শুনেছি 'পাগল'!

 

শুনেছি জাপানের কিছু অফিসে 'ক্রাইং রুম' নামে একটা কক্ষ রাখা আছে। যেখানে কর্মীরা মন খারাপ থাকলে একা বসে কাঁদে। উন্নতবিশ্বে কর্মীকে কোন মালিক অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় চাপ প্রয়োগ করার অধিকার রাখে না। বাংলাদেশে যেকোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মানে আপনাকে মালিক কিনেছে, এখন যা খুশি করবে। আপনি সত্যি বলতে গেলে অত্যাচার শুরু।

 

৩. আমার কাছে পরিচিত একটা ছেলে কয়েকমাস পরপর আসতো। এই কয়মাসে তার সমস্যার কথা বলতো। আমি মনদিয়ে শুনতাম। তারপর আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলতাম। সে ফিরে যেতো। আবার কয়েকমাস পর আসতো। একবার বললো সে আমার কাছে এসে গল্প করে বাঁচার শরদ নিয়ে যায়। করোনাকালীন আমার খুব কাছের এক বন্ধুর স্ত্রী মানসিক অস্বস্তিতে ভুগছে। বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম সমস্যা কোথায়। একদিন মুখোমুখি হলাম।আমার সামনে সমস্যা বলতে বলতে অঝোরে কাঁদলো।আমি বাধা দিলাম না। তার কাছে অনেক বড় সমস্যাটা মনে হলো আমার কাছে খুবই সামান্য। আমি তাকে কাঁদতে উৎসাহ দিলাম।

 

কয়দিন আগে ঢাকা শহরে একা বসবাস করা একটা মেয়ে করোনায় ঘরবন্দী। আমি চেষ্টা করলাম প্রায় সারাক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলতে যেন মানসিকভাবে রোগ তাকে গ্রাস না করে। গতকালই সুস্থ হয়েছে জেনে বললাম 'আমার দায়িত্ব শেষ'।

 

২০২০ এর মে মাসে যখন পৃথিবীতে  করোনা আতংকের মধ্যে আমার করোনা পজিটিভ হলো তখন একটা ফেসবুক লাইভ দিয়েছিলাম। এরপর আমার নিজেরই পরিচিত ৭/৮ জন রোগী ছিলো। যারা প্রতিদিন আমার সঙ্গে কথা বলে নাকি সান্ত্বনা পেতো। আমার আশপাশের এমন অনেকগুলো লোক আছে যারা আমার কাছে স্বস্তি পায়। তাদের সমস্যাগুলোতে আমি সান্ত্বনা খুঁজি। আমি নিজেও খুব গোপনে মানসিক অস্বস্তিতে ভুগী। আত্মহত্যার কথা জীবনে একবার হলেও ভাবে নাই এমন কোন লোক মনে হয় নাই। কিন্তু ছাদ থেকে লাফ দেয়ার সময় মনে হয় আর একবার ধর্য্য ধরি, পিস্তল খোঁজার সময় মনে করি আর একবার দেখি। প্রত্যেক ব্যর্থতায় একটা নিরব সান্ত্বনা খুঁজি। বাঁচার জন্য নতুন নতুন সূত্র আবিষ্কার করি।

 

আমার মনে হয় পৃথিবীতে সমস্যা, সমাধান আর মেনে নেয়া এই তিনের ওপর বসবাস। সমস্যা হলে সমাধান করুন। যা সমাধান নাই তা শুধু দেখতে থাকুন। প্রত্যাশা কমিয়ে ফেলুন। দৌড় দিলে থামতে শিখুন। অহংকার দম্ভ করবেন না। সুখের মতো দুঃখও উপভোগ করুন। পৃথিবীতে শতভাগ মানুষ আমাকে ভালোভাবে নিবে না সেটাই স্বাভাবিক। মরতে তো হবেই।

 

আমি ভাবি আমার মৃত্যুর খবরে আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়া কত সংখ্যক লোক মন থেকে আফসোস করবে।আমাকে শেষবার দেখার আকুতি কতজনের মধ্যে আমি সৃষ্টি করতে পারলাম। সেখানেই নির্ধারণ হবে আমার জীবন ও কর্মের স্বার্থকতা।

 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী