শিল্পী সমিতির নির্বাচন ও একটি কাল্পনিক শুনানি

এফআই দ্বীপু
| আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:১০ | প্রকাশিত : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:৩০

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষিত হয়েছে ৩০ জানুয়ারি ২০২২। কিন্তু এর ফলাফল নিয়ে এখনও টানাহেঁচড়া চলছেই। ৫ ফেব্রুয়া‌রি এফডিসিতে পরাজিত সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী নিপুণ আক্তারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আপিল বোর্ডের এক সভায় নির্বাচন সংক্রান্ত একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

যদিও জয়ী সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান দাবি করেছেন, এই সভাটি সম্পূর্ণ অবৈধ এবং এ ধরনের একটি কাজ করার কোনো এখতিয়ার তাদের নেই। এই খবর জানতে হলে শুনানি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে তার আগেই আমরা একটি কাল্পনিক শুনানি দেখে নিই।

আদালতে বিচারক তার আসনে গিয়ে বসেছেন। বিচারক আবার নিজেই অভিযোগ দিয়েছেন দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ না বলে সেটাকে দিক নির্দেশনা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। সেটা পরের বিবেচ্য বিষয়। তার আগে আমরা বাদী নিপুণ আক্তার ও বিবাদী জায়েদ খানের কৌশলীর চুলচেরা (পড়ুন চুল ছেঁড়া) বাকবিতন্ডা শুনি।

বাদী: মাই লর্ড, বিবাদী আমাকে জোর করে পরাজিত করেছেন। তিনি টাকার বিনিময়ে ভোট কিনেছেন। নির্বাচনের দিন আমি সেটা দেখেছি। আমি নির্বাচন কমিশন বরাবর অভিযোগও দিয়েছি। তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর আমি দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন করছি।

বিবাদী: মাই লর্ড, বাদী যে অভিযোগ করেছেন, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট। তিনি হেরে গিয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এমন অভিযোগ করছেন। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর সেটা মেনে নিয়ে নতুন করে অভিযোগ করা একেবারেই অবান্তর।

বাদী: মাই লর্ড, মোটেও তা নয়। আপনি আমার অভিযোগ আমলে নিয়ে মন্ত্রণালয়ে দিক নির্দেশনা চেয়েছেন। সেই অনুযায়ী আপনি ব্যবস্থা নিন।

বিবাদী: মাই লর্ড, আপনি এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না। প্রথমত, অভিযোগটি বানোয়াট। দ্বিতীয়ত, এমন বানোয়াট অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো এখতিয়ারও আপনার নেই। কারণ, এ মুহূর্তে আপনি নিজেও অবৈধ।

এটা শুনে বিচারক জোরে একটা হাঁচি দিলেন। বিবাদীর কাছে জানতে চাইলেন, আমি কীভাবে অবৈধ সেটা ব্যাখ্যা করুন। বিবাদী বলতে শুরু করলেন, ‘মাই লর্ড, গত ২ ফেব্রুয়ারি সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রেরিত পত্রে বলা হয়েছে, ‘সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী জনাব জায়েদ খান এবং কার্যকরী পরিষদ সদস্য পদপ্রার্থী জনাব চুন্নু-এর প্রার্থীতার ফলাফল ব্যতীত অন্যান্য পদ-এর ফলাফল অক্ষুণ্ন রেখে উক্ত দুজনের বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য মাননীয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী বরাবরে আপনাকর্তৃক প্রেরিত পত্রটি সংযুক্ত কাগজপত্রসহ সমাজকল্যান মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ হিসেবে অদ্য নিম্নস্বাক্ষরকারীর হস্তগত হয়েছে।

প্রাপ্তপত্র বিবেচনায় বলা যায়, নির্বাচন বিষয়ে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের আলাদা দিক নির্দেশনার কোনো প্রয়োজনীয়তা নাই। নির্বাচন নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত গঠনতন্ত্রের আলোকে গঠিত নির্বাচন কমিশনের অনুমোদিত ও জারিকৃত নির্বাচনী আচরণবিধি মতে পরিচালিত হয়েছে, সেহেতু আচরণ বিধিমতে উক্ত প্রার্থীদ্বয়ের বিষয়ে চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদানের জন্য নির্বাচনী আপীল বোর্ড চূড়ান্ত ক্ষমতাপ্রাপ্ত।’

মাই লর্ড, আপনার অভিযোগের বিষয়ে এই চিঠিতে মন্ত্রণালয় কিন্তু বলে দিয়েছে, ‘নির্বাচন বিষয়ে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের আলাদা দিক নির্দেশনার কোনো প্রয়োজনীয়তা নাই।’ আপনি তথ্য গোপন করে নিজে যেচে গিয়ে এমন একটি নির্দেশনা নিয়ে এসেছেন। এবার বলি আপনি কীভাবে তথ্য গোপন করেছেন এবং কীভাবে আপনি অবৈধ।

মাই লর্ড, শিল্পী সমিতির নির্বাচনী তফসিলের ১০ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন উপলক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সদস্যকে প্রভাবিত করার জন্য অথবা উপঢৌকন দেওয়া যাবে না। কোনো প্রার্থী ভোটারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করতে পারবেন না। ভোট প্রার্থনা করে ভোটারকে প্রভাবিত ও বিব্রত করতে পারবেন না। যদি কোনো প্রার্থীর উক্ত ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই প্রার্থীর প্রার্থিতা নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে পারবেন।’

একই তফসিলের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আপিল বোর্ডে আপত্তি জানিয়ে ২৯ জানুয়ারি বেলা একটার মধ্যে আবেদন করতে হবে। একই দিন বিকাল পাঁচটায় আপিল শুনানি ও নিস্পত্তি হবে। ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, চূড়ান্ত সংশোধনী ফলাফল ৩০ জানুয়ারি প্রকাশ হবে। ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন হচ্ছে তিনজন। তারা হলেন- পীরজাদা শহিদুল হারুন-চেয়ারম্যান, বজলুর রশীদ চৌধুরী-সদস্য ও বিএইচ নিশান-সদস্য।

মাই লর্ড, আপনি যে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন, সেখান থেকে প্রেরিত পত্রে কিন্তু উল্লেখ আছে, ‘নির্বাচন নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত গঠনতন্ত্রের আলোকে গঠিত নির্বাচন কমিশনের অনুমোদিত ও জারীকৃত নির্বাচনী আচরণবিধি মতে পরিচালিত হয়েছে, সেহেতু আচরণ বিধিমতে উক্ত প্রার্থীদ্বয়ের বিষয়ে চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদানের জন্য নির্বাচনী আপীল বোর্ড চূড়ান্ত ক্ষমতাপ্রাপ্ত।’

মাই লর্ড, একটু ভালো করে খেয়াল করুন, মন্ত্রণালয় কিন্তু ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে গঠনতন্ত্র ও নির্বাচন কমিশনকে। এবার খেয়াল করুন তফসিলের ১৩ ও ১৪ ধারায় কী বলা হয়েছে। নির্বাচনে আপনি নিজেই আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। আপনার কাছেই বাদী ফলাফলে আপত্তি জানিয়ে আবেদন করেছিলেন। আপনি নির্দিষ্ট দিনে বাদীর সামনেই ভোট পূনরায় গণনা করে ফলাফল প্রকাশ করেছেন। বাদী সেই ফলাফল মেনে নিয়েছেন বলে স্বাক্ষরও করেছেন আপনার উপস্থিতিতে। এরপর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশও হয়েছে। চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর আপনি অর্থাৎ আপিল বোর্ডেরও মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। অর্থাৎ সমিতির গঠণতন্ত্র ও নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী আপনি নিজেই তো এখন অবৈধ। মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে আপনি কোনো তথ্য না দিয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।

আরও কথা আছে মাই লর্ড, আপনি নিজেই যে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে স্বাক্ষর করেছেন, সেখানে আপনি কীভাবে পরবর্তীতে অভিযোগ যাচাইয়ে মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনা চাইতে পারেন? এটা কী স্ববিরোধী কাজ নয়? আপনি কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়ে দিক নির্দেশনা চেয়েছেন। তার আগের দিন চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে।

চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগে কেন আপনি দিক নির্দেশনা চাননি? আর যদি বাদী চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার পরে আপনার বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন তাহলে, আপনি কেন সেটা অনুমোদন করলেন? যেখানে চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পর আপনি নিজে এবং আপনার আপিল বোর্ডই তো এখন জিজলভ। মাই লর্ড, আপনি কী কোনো চাপের মধ্যে আছেন?

আরও একটি বিষয় মাই লর্ড, বাদী যদি অনিয়মের অভিযোগ দিয়েই থাকেন, তাহলে কেন প্রাথমিক ফলাফলে আপত্তি জানিয়েছিলেন? ভোট পূণর্গণনার আবেদন করেছিলেন? তারপর কেন চূড়ান্ত ফলাফল মেনে নিয়ে সেটায় স্বাক্ষর করেছিলেন? এসবের স্বাক্ষী তো আপনি মাই লর্ড! চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে দেয়ার পর আপনার আর কোনো কাজ থাকে?

মাই লর্ড, এখন বলুন, আপনি অবৈধ কী না? আর গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনী তফসিল মোতাবেক কোনো অবৈধ বক্তি কী বিচারকের আসনে বসতে পারে? দিক নির্দেশনা চেয়ে আপনিও মূলত আপনার চিঠিতে অভিযোগ করেছেন মন্ত্রণালয়ের কাছে। এখন বলুন আপনি অভিযোগকারী হয়ে বিচারকের আসনে বসতে পারেন কী না? এবার আপনার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় মাই লর্ড?

বিচারক সব শুনে এক গ্লাস পানি চাইলেন। পানিটা গলার ভেতর ঢেলে ঢকঢক করে গিলে ফেললেন। কপাল থেকে ঘামটা মুছে বললেন- ‘অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার। বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার। সুতরাং কোনো কথা হবে না।’ বলেই খসখস করে তিনি কাগজে কী জানি লিখলেন। তারপর সেখানে সাইন করে কলম ভেঙে ফেললেন।

বিচারক কী লিখেছেন সেটা জানতে হলে ৫ ফেব্রুয়া‌রি সত্যিকারের শুনানির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: এফআই দ্বীপু, বিনোদন সাংবাদিক, দৈনিক যুগান্তর

ঢাকাটাইমস/০৫ফেব্রুয়ারি/এএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিনোদন এর সর্বশেষ

এফডিসিতে সাংবাদিকদের মারধর: লজ্জিত রিয়াজ, জানিয়েছেন নিন্দা

সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এফডিসির সামনে মানববন্ধন

ভারতে ‘পদ্মশ্রী’ পেলেন বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বন্যা

শিশুশিল্পী উধাও, পুরস্কারের জন্য খুঁজছেন পরিচালক নূরুজ্জামান

সাংবাদিকদের মারধর: শিল্পী সমিতিকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

নির্বাচিত হয়েই হিন্দি সিনেমা আমদানির বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিলেন ডিপজল

‘আম্মাজান’ সুপারহিট হওয়ার পরও কেন সিনেমা ছাড়লেন শবনম?

এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, দুঃখ প্রকাশ করে যা বললেন মিশা-ডিপজল

এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা

সাবেক স্ত্রী তিন্নির সঙ্গে বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে যা বললেন হিল্লোল

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :