সত্যিই আর কোনোদিন দেখা হবে না প্রিয় হাবিব ভাই!

প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:৫৭ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:০৩

মোহাম্মদ আরিফুর রহমান

এভাবে প্রয়াত (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) হলেন হাবিব ভাই! সত্যিই পরলোকে চলে গেলেন! সত্যিই আর কোনদিন তুমুল আড্ডা দেওয়া হবে না! প্রাণ খুলে, অন রেকর্ড, অফ দ্যা রেকর্ড আলোচনা হবেনা! না ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রিয় পীর হাবিব ভাই! অনলাইন পোর্টালগুলোতে সাংবাদিক, প্রিয় সহকর্মী আর -সময় অসময়ের শুভাকাঙ্ক্ষী পীর হাবিবুর রহমানের প্রয়াত হওয়ার খবরটা পড়ে বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। স্ট্রোক করে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর বিকেল ৪টা ৮মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। বড্ড অসময়ে এবং অকালে চলে গেলেন আমার এবং আমার মতো অনেকের প্রিয় পীর হাবিবুর রহমান। মানতে কষ্ট হচ্ছে। খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত এই মৃত্যু। কী বলে সান্ত্বনা দেবো নিজেকে আর হাবিব ভাইয়ের পরিবারকে! অনেক স্মৃতি। অনেক পারস্পরিক বোঝাপড়া। একজন বড় ভাই, শুভাকাঙ্ক্ষী আর মেধাবী সংবাদকর্মীকে হারালাম।

একসঙ্গে খুব বেশিদিন কাজ করার সুযোগ হয়নি মেধাবী পীর হাবিবের সঙ্গে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের খুবই অল্প সময়ের জন্য তাঁকে পেয়েছিলাম। ২০০১ সালে তিনি উপ-সম্পাদক হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিদিনে যোগদান করেন, আমিও তখন উপ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত সেখানে। সম্ভবত তাঁর যোগদানের মাসখানেকের মাথায় আমি বাংলাদেশ প্রতিদিন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। বড় ভাইতুল্য পীর হাবিব ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন কর্মস্থল ছেড়ে যাচ্ছি আমি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কর্মস্থলে তিনিই যে কক্ষটিতে বসতেন তখন সেখানে আমি বসতাম। বার কয়েক আমার কক্ষে এলেন। অনেক করে বোঝালেন। ভাই, আমি এলাম একসঙ্গে কাজ করবো বলে, আর তুমি ছেড়ে যাচ্ছো, যেও না, প্লিজ। চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনেছি। অসম্মান হয় এমন কোনো কথা বলিনি। থাকব না চলে যাবো সেটিও এড়িয়ে গেছি। পরে যখন ছেড়ে এলাম তখন আক্ষেপের সুরে বলেছেন, না গেলেই কি হতো না? তাকে কথা দিয়েছিলাম, যেখানেই থাকি না কেন, আপনার এই ভালোবাসা, স্নেহ আর বন্ধুপ্রিয়তা মিস করবো। দেখবেন আমরা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠব অচিরেই। 

যখনই যেটা নতুন করে শুরু করেছি অথবা নানামুখি চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করছি তখনই নিয়ম করে মুঠোফোনে প্রিয় হাবিব ভাইয়ের অনুপ্রেরণা, পরামর্শ পেতাম। আর সুযোগ হলেই। চা-কফির আড্ডা হতো আমাদের। এবং যথারীতি এই আড্ডায় কমনসঙ্গী প্রিয় বড়ভাই, সম্পাদক নঈম নিজাম। হাবিব ভাই বরাবরই অকপটে কথা বলায় পারদর্শী। যেটা বুঝতেন, দেখতেন সেটাই নির্বিকারে বলতেন, লিখতেনও। এ কারণে তাঁর অনেক শত্রুও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। গত দু-তিনবছর একটি কথা ঘুরে ফিরেই বলতেন, ‘এখন আর আগের মতো অনেককেই বিশ্বাস করতে পারি না। প্রাণ খুলে কথা বলব, বিশ্বাস করে কিছু বলব, এমন লোকের বড্ড অভাব। তোমাদের (নঈম নিজাম এবং আমি) সঙ্গে বসলে অন্তত প্রাণ খুলে যা খুশি তাই বলতে পারি, এটাই বড় শান্তি।’

বাংলাদেশ প্রতিদিন ছেড়ে কিছুদিন পূর্বপশ্চিম নামে অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন প্রিয় হাবিব ভাই। কিছুদিন যাওয়ার পরেই একদিন ফোন করলেন, বললেন, ‘ছোটভাই তোমার অপরিসীম ধৈর্য্য।’ পাল্টা প্রশ্নে জানতে চাই, কেন ভাই? বললেন, ‘আমি তো আর ঠিকমতো পোর্টাল চালাতে পারছি না। ফিরে যাচ্ছি বাংলাদেশ প্রতিদিনেই।’আবার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন সেখানে। নিয়মিত কলাম লেখেন, জনপ্রিয়তাও পান সমানে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে শত্রুর সংখ্যাও বাড়ে। আড্ডায় আক্ষেপ করে বলেন, ‘অমুক ক্ষেপেছে, তমুক অখুশি। কী যে করি! আর তো আগের মতো ক্ষুরধার কলম চালাতে পারব কিনা নিজেই বুঝতে পারি না।’

বোনম্যারো ক্যানসার চিকিৎসার জন্য বোম্বে যাবেন আমায় টেক্সট করলেন। লিখলেন, ‘কীভাবে তোমাকে সরাসরি বলব জানি না, এজন্য টেক্সটে খবরটি দিয়ে প্রস্তুত করে রাখলাম। আমি ক্যানসার আক্রান্ত। যাওয়ার আগে কি তোমার সাথে দেখা হবে না?’ সেদিন রাতেই একটা কফিশপে মিলিত হলাম আমরা। খানিকটা মন খারাপ তাঁর। ছেলেমেয়েকে নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়! সাহস জোগালাম। আরও নানা বিষয়ে কথা হলো। অবসন্ন মনের পীর হাবিব কফিশপ থেকে বের হলেন ফুরফুরে মেজাজে। গাড়িতে ওঠার আগে বললেন, ‘ডিয়ার, এজন্যই তোমাকে আমার এত পছন্দ। কীভাবে যে তুমি আমার মন ভালো করে দিলে আমি নিজেও বুঝতে পারলাম না। আবার দেখা হবে।’ খুব ভালো লেগেছিল সেদিন। তাঁর হাসিমুখ দেখে। ক্যানসার থেকে সেরে উঠলেন ঠিকই। কিন্তু কোভিড এবং কোভিড পরবর্তী শারীরিক জটিলতা ঠিকই পর্যদুস্ত করলো সাহসী এই কলমসৈনিককে। বিষণ্ন মন আর মুখে কীভাবে আপনাকে বিদায় জানাবো প্রিয় হাবিব ভাই? পরলোকে অনেক ভালো থাকবেন।  

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস২৪ ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়।