বেদে সম্প্রদায়ের বিলুপ্ত ‘ঠার’ ভাষা নিয়ে ডিআইজি হাবিবের বই, জানুন আদ্যোপান্ত

প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২২:৪৪ | আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:২৬

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

সমাজের পিছিয়ে পড়া বেদে সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় উঠিয়ে আনতে কাজ করছেন একজন মানবিক পুলিশ অফিসার। তার নাম হাবিবুর রহমান। বর্তমানে তিনি পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি (উপ মহাপরিদর্শক) হিসেবে দায়িত্বরত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি তিনি অবহেলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন 'উত্তরণ ফাউন্ডেশন'। বর্তমানে সাভার ছাড়াও মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও সিংড়া এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

মানবিক পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানের ভূমিকার কারণে বেদে এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর অনেকের সামাজিক অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে; পাশাপাশি দেশের সব থেকে বড় যৌনপল্লী দৌলতদিয়ার শিশুদের জন্যও কাজ করছেন তিনি। যৌনপল্লী থেকে শিশুদের আলাদা রাখার চেষ্টা করছে উত্তরণ ফাউন্ডেশন। মায়েরা মাসের নির্দিষ্ট সময় তার সন্তানকে দেখতে যেতে পারে। এতে শিশুদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। এই শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে শিক্ষা উপকরণ যেমন স্কুলব্যাগ, খাতা-বই-কলম, টিফিন বক্স, দুধের ফিডারসহ নানা ধরনের উপকরণ তুলে দেওয়া হচ্ছে।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাদের ব্যতিক্রম ভাষা সম্পর্কে জানতে পারেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। ‘ঠার’ বেদেদের স্বতন্ত্র ভাষা। যাতে অন্যরা তাদের কথাবার্তা বুঝতে না পারে। তবে বাংলা ভাষাভাষীর সঙ্গে তারা বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাদের ভাষার সঙ্গে আরাকানদের ভাষার মিল রয়েছে। কেউ কেউ আবার ভাষাটির সঙ্গে চাক এবং কাডু ভাষার সামঞ্জস্যতার কথা বলেছেন।

ভাষার মাসে সেই রহস্যময় ‘ঠার’ ভাষার পূর্ণাঙ্গ বই প্রকাশ করছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। 

এবারের ‘বইমেলা ২০২২’ উপলক্ষে তিনি লিখেছেন ‘ঠার’, বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা নামক বইটি। যেখানে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন প্রান্তিক বেদেপল্লীর নিজস্ব ভাষা ‘ঠার’-এর আদ্যোপান্ত।

'ঠার' নিয়ে যা বলছেন লেখক

ঢাকা টাইমসকে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ঠার’ নিয়ে গবেষণা করে বুঝলাম, এর বেশির ভাগ শব্দই বাংলা ভাষার আদি রূপ থেকে উদ্ভূত। ভাষাটির নেই কোনো বর্ণ বা লিপি। মূলত এটি কথ্য ভাষা। ‘ঠার’ এদের মাতৃভাষা। যা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে। যদিও ভাষাটি নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে কয়েক জন গবেষক ‘ঠার’ ভাষা নিয়ে করেছেন গবেষণা। তবে ‘ঠার’ নিয়ে লেখা হয়নি কোনো গ্রন্থ কিংবা পাণ্ডুলিপি।

ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ঠার’ বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা বইটি দীর্ঘ আট বছর গবেষণার ফসল। যেহেতু 'ঠার' বা 'ঠের' ভাষাটির লিখিত কোনো রূপ নেই, সেহেতু শব্দটির কোনটি সত্য তা বলা মুশকিল।

শুরুর গল্পটা ছিল এরকম- ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আয়োজিত বিভিন্ন সভায় বেদে প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের রীতি চালু করি। বেদেরা তাতে অংশগ্রহণ করে। হঠাৎ লক্ষ করি বেদেরা নিজেদের মধ্যে একটি ভিন্ন ভাষায় কথা বলছে, যা আমাকে কৌতূহলী করে তোলে। তখন জানতে পারলাম- ভাষাটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অংশ। গবেষকদের কেউ কেউ একে ‘ঠার’  বা ‘ঠের’ ভাষা বলে থাকেন। যেহেতু ভাষাটির লিখিত কোনো রূপ নেই, সেহেতু শব্দটির কোনটি সত্য তা বলা মুশকিল।

‘ঠার’ ভাষাভাষী বেদে সম্প্রদায়ের সম্পর্কে হাবিবুর রহমান বলেন, কেউ কেউ আবার ভাষাটির সঙ্গে চাক এবং কাডু ভাষার সামঞ্জস্যতার কথা বলেছেন। তবে ‘ঠার’ নিয়ে গবেষণা করে বুঝলাম, এর বেশির ভাগ শব্দই বাংলা ভাষার আদি রূপ থেকে উদ্ভূত। ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র বা গবেষক না হয়েও ভাষাটি সম্পর্কে কৌতূহলী মানসিকতা আমাকে উৎসাহিত করেছে। সেই থেকে বই রচনার পরিকল্পনা। যার পূর্ণাঙ্গ রূপ ‘ঠার’ বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় সাত লাখ ৮০ হাজার বেদে জনগোষ্ঠী রয়েছে। ৫৩টি জেলায় তাদের মানবেতর জীবনযাপন। বেদেরা শতকরা ৯০ ভাগই নিরক্ষর। সামাজিকভাবেও এরা চরম অবহেলিত।

ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ঠার’ ভাষার গবেষণার পাঁচ শতাধিক বেদে প্রতিনিধির সঙ্গে দীর্ঘ আট বছর যোগাযোগ রেখেছি। তাদের মাধ্যমে ভাষাটির শব্দ, ব্যাকরণ উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। কখনো কখনো বেদেপল্লীতে উপস্থিত হতে না পারলে বেদেদের আমার অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা বলে অজানা ভাষাটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বই হিসেবে লিখিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনও দীর্ঘ এই গবেষণাযাত্রায় সংগৃহীত ঠার ভাষার শব্দ, চয়ন, বাক্যগঠন ইত্যাদি সম্পর্কে একমত পোষণ করেছেন।

'ঠের' নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা

ব্যক্তি উদ্যোগে বেদেদের পুনর্বাসন এবং বিলুপ্ত প্রায় ‘ঠার’ ভাষার গবেষণায় দীর্ঘ আট বছর কাজ করেছেন ডিআইজি হাবিবুর রহমান। দীর্ঘ এই গবেষণা যাত্রায় হাবিবুর রহমানকে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহে ঘুরতে হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় তাকে সাহায্য করেন তার সহকর্মীরাও। এমনকি ভাষাটির তথ্যউপাত্ত সংগ্রহে বেশ কয়েক জন প্রতিনিধির নিরলস পরিশ্রমের পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রভাষক আমানত মোল্লা এবং সাভারের পোড়াবাড়ীর বেদেপল্লীর সদস্য আমজাদ হোসেন। গ্রন্থটি গবেষণানির্ভর ও তথ্যসমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন আরও অনেক গুণগ্রাহী ব্যক্তিবর্গও।

১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জের চন্দ্র দিঘলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হাবিবুর রহমান। ১৭তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে তিনি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে যোগ দেন। কর্মক্ষেত্রে সততা, সাহসিকতা, দক্ষতা আর সময়োপযোগী ও দূরদর্শী নেতৃত্বগুণের কারণে এরই মধ্যে সুখ্যাতি পেয়েছেন তিনি। তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দুইবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। পেশাগত কাজের বাইরে তিনি একজন ক্রীড়া সংগঠকও। কাজ করছেন কাবাডি নিয়ে।

'ঠের' বইয়ের উদ্বোধন মঙ্গলবার

পাঞ্জেরী প্রকাশনীর ব্যানারে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। এজন্য লেখক প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কামরুল হাসান শায়ককে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে গ্রন্থটির সংশ্লিষ্ট গবেষক, শিক্ষক, ছাত্র সকলকে ধন্যবাদ ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, গ্রন্থটিতে দেশের বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষার উদ্ভব আলোচনা, ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। যেন বিপন্নপ্রায় এই জাতির বিলুপ্ত প্রায় ভাষাটি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ও যৌক্তিক ধারণা লাভ করা যায়।

২২ ফেব্রয়ারি বিকাল সাড়ে ৩টায় বইটির প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে। 

এই আয়োজনে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কথা সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কবি কামাল চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কবি ও লেখক মিনার মনসুর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান। 

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানে বইটির ভাবনা ও প্রস্তাবনা তুলে ধরবেন বইয়ের লেখক হাবিবুর রহমান।

(ঢাকাটাইমস/২১ফেব্রুয়ারি/এসএস/জেবি)