উড়ে চলতেন ড্রাইভার মালেক, জেনে নিন তার বিরুদ্ধে দুদকের কতগুলো মামলা?

প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:২৬ | আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:৩৩

সৈয়দ ঋয়াদ, ঢাকাটাইমস

রূপকথার গল্পকেও হার মানাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (বরখাস্ত) গাড়িচালক আবদুল মালেক ওরফে মালেকের উত্থান। দুর্নীতির মাধ্যমে গাড়িচালক থেকে বাড়ি, গাড়ি, ফ্লাটসহ শত শত কোটি টাকার মালিক। গাড়িচালক হলেও নিজেই যেন চালাতেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চলতেন উড়ে উড়ে।

তার অপকর্ম-দুর্নীতির সবই ছিল সাধারণ মানুষের অজানা। র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর বেরিয়ে আসে একের পর এক অপকীর্তির খতিয়ান। অস্ত্র মামলায় ১৫ বছরের সাজা নিয়ে এখন তার ঠাঁই কাশিমপুর কারাগারে।

ধরা পড়ার আগেই মালেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে আভিযোগ ছিলো। তদন্তাধীন ছিলো সেইসব অভিযোগ। এর মধ্যে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় ও বিদেশে পাচার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকে ডাক পড়ে তার।

২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর দুদকের উপ-পরিচালক মো. সামছুল আলম ড্রাইভার মালেককে দুদকে তলব করেন। তবে পরবর্তী সময়ে কর্মকর্তা বদলের কারণে অভিযোগটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুদকের কাছে মালেকের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ বেশ আগে থেকেই ছিল। দুদকের প্রতিটা কাজই বেশ রেকর্ড ও ডকুমেন্ট নির্ভর। তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ ছাড়া উড়ো অভিযোগ গ্রহণ করার সুযোগ নেই। সেই কারণে তার (মালেক) বিরুদ্ধে সম্ভবত তদন্ত দেরি হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক মালেকের বিরুদ্ধে দুদক এখন পর্যন্ত একটি মামলা দায়ের করেছে। আরেকটি মামলা হয়েছে তার স্ত্রী নার্গিস বেগমের বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক (বর্তমান উপপরিচালক) সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা দুটি দায়ের করেন।

আসামি আবদুল মালেকের বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে বলা হয়, চাকরিকালীন সময়ে অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে মোট এক কোটি ৫০ লাখ ৩১ হাজার ৮১০ টাকার স্থাবর-অস্থাবর অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। সম্পদ বিবরণীতে ৯৩ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪৮ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করে মিথ্যা বা ভিত্তিহীন ঘোষণা দিয়েছেন।

অন্য মামলায় বলা হয়, আবদুল মালেকের স্ত্রী নার্গিস বেগমের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এক কোটি ১০ লাখ ৯২ হাজার ৫০ টাকা মূল্যের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। মামলার প্রায় সাত মাস পরে দুদক তাদের বিরুদ্ধে গত ২১ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত অভিযোগপত্র দেয়।

মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা মালেককে জেলগেটে জিজ্ঞাসবাদ করেছি। তার বিরুদ্ধে এই মামলায় চূড়ান্ত অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। মামলাটি এখন আদালতে চলমান রয়েছে। তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে দুদক। এর বেশি মামলা সম্পর্কে বলার এখতিয়ার আমার নেই।’

র‌্যাবের হাতে যেভাবে গ্রেপ্তার

গত ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তুরাগ থানার কামারপাড়ায় ৪২ নম্বর বামনেরটেক হাজী কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলার বাসা থেকে তাকে আলোচিত ড্রাইবার মালেককে গ্রেপ্তারন করে র‌্যাব-১-এর একটি টিম।

ওই সময়ে মালেককে গ্রেপ্তারের পর তার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ বাংলাদেশি জাল নোট, একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।

ওই সময় র‌্যাব থেকে গণমাধ্যমকে বলা হয়, ড্রাইভার মালেকের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, জাল টাকার ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তিনি তার এলাকায় সাধারণ মানুষকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শক্তির মহড়া ও দাপট প্রদর্শনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন মর্মে তার বিরুদ্ধে ভিযোগ রয়েছে।

স্বাস্থ্যের এই চালককে আটকের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে র‌্যাব-১-এর পুলিশ পরিদর্শক আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন। আটকের পরের দিন অর্থাৎ ২১ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের পক্ষ থেকে পৃথক দুই মামলায় তার ১০ দিন করে ২০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে দুই মামলায় সাত দিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলাম।

গ্রেপ্তারের ঠিক এক বছর পর অর্থাৎ গত ২০২১ সালের ২০ সেপ্টম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরখাস্ত গাড়িচালক আব্দুল মালেক বিরুদ্ধে দায়ের করা অস্ত্র আইনের মামলার দুই ধারায় ১৫ বছর করে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। তবে একই সঙ্গে সাজা কার‌্যকর হওয়ার কারণে দুই মামলায় মোট ১৫ বছরের কারাভোগ করতে হবে তাকে।

মালেকের উত্থান যেভাবে!

অষ্টম শ্রেণি পাশ সার্টিফিকেট দিয়ে ১৯৮২ সালে সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পে ড্রাইভার হিসেবে যোগদান করেন মালেক। ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে ড্রাইভার হিসেবে চাকরি শুরু করেন। র‌্যাবের হাতে গ্রে্তোরে আগে প্রেষণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন।

নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। গত বিশ বছর ধরে এই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। আবদুল মালেক এভাবেই সিন্ডিকেট করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রভাব বিস্তার করেন। চুতর্থ শ্রেণীর কর্মচারী থেকে সর্বোচ্চ পদের কর্তারা ছিলেন তার হাতে জিম্মি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভারদের ওপর একছত্র আধিপত্যের পাশাপাশি ড্রাইভারদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির নামে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করতেন। নিজে গাড়ি চালক হলেও তিনি চালাতেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। পরিচালক প্রশাসনকে জিম্মি করে ডাক্তারেরও বদলি ও পদোন্নতি করাতেন। কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে আয় করতেন বিপুল অর্থ।

র‌্যাবের অনুসন্ধান বলা হয়, স্বাস্থ্যের সাবেক মহাপরিচালক শাহ মুনীর হোসেন পদে  থাকা অবস্থায় ২০০৯ থেকে ২০১০ সালে আবদুল মালেক স্বাস্থ্য সহকারী পদে শতাধিক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেন। মালেকের এসব নিয়োগের একটি বড় অংশ পেতেন শাহ মুনীর হোসেন আর বাকিটা মালেক নিজেই রাখতেন।

ড্রাইভার মালেক ঠিক কত সম্পদের মালিক!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালেকের ঢাকায় অন্তত চারটি ফ্ল্যাট ও ১০টি প্লটের মালিক। মালেকের স্ত্রীর নামে দক্ষিণ কামারপাড়ায় ২টি সাততলা বিলাসবহুল ভবন, ধানমন্ডির হাতিরপুল এলাকায় সাড়ে ৪ কাঠা জমিতে একটি নির্মাণাধীন ১০তলা ভবন।

এছাড়া দক্ষিণ কামারপাড়ায় ১৫ কাঠা জমিতে একটি ডেইরি ফার্ম, গবাদিপশুর বৃহৎ খামার, মাছের ঘের ও পরিবহন ব্যবসা পরিচালনা করেন মালেক। এসব ব্যবসা দেখাশোনা করেন তার ছোট ভাই আবদুল খালেক। খালেক নিজেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের   পিয়ন হিসেবে কর্মরত।

অন্যদিকে মালেকের বহু সম্পদ খালেকের স্ত্রীর নামে রয়েছে। এখন পর্যন্ত চারটি বেসরকারি ব্যাংকে মালেকের নামে-বেনামে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব টাকা তার স্ত্রী, ভাই খালেক ও এক ভাতিজাসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয়ের নামে রাখা হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/২৩ফেব্রুয়ারি/এসআর/ডিএম)