শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস

ব্যাংকিং পেশার অভিজ্ঞতা আর ধর্মীয় টোপে ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২২, ১৪:৫২ | প্রকাশিত : ১৩ মার্চ ২০২২, ১৪:২০
ওঁরা পাঁচজন প্রতারক
ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে প্রতারণা করতো শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানি। এভাবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে কোম্পাটির বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শাহ আলম ও তার চার সহযোগীকে গত শনিবার রাতে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। তারা প্রতারণার কৌশল রপ্ত করতে কাজে লাগিয়েছেন ব্যাংকিং পেশার অভিজ্ঞতা।
র‌্যাব বলছে, তিন শতাধিক মাঠকর্মীর মাধ্যমে পাঁচ-ছয় হাজার মানুষের কাছ থেকে অন্তত দুই শ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নিজেদের নামে জমি কিনে এবং ব্যাংকে বিনিয়োগ করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। গ্রাহকরা টাকা ফেরত চাইলে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে সবাই আত্মগোপনে চলে যান। বর্তমানে কোম্পানির যে সম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের টাকা অর্ধেকও পরিশোধ করা যাবে না।
রবিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘নরসিংদীর শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানিতে বিনিয়োগে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে নেয়া হতো আমানত। আর প্রতিষ্ঠানটিতে আমানত রাখতে হলে আগে দিতে হতো ধর্মীয় পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় পাস করলেই করা হতো সদস্য। এর পর নেয়া হতো আমানত। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে টাকা ফেরত চাওয়ার পরই আত্মগোপনে চলে যায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা। অভিযোগ পেয়ে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ এর অভিযানে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
র‌্যাব জানিয়েছে, প্রতারক চক্রের অন্যতম হোতা শাহ আলম, দেলোয়ার হোসেন শিকদার, কাজী মানে উল্লাহ, সুমন মোল্লাহ, আব্দুল হান্নান মোল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বাড়ি নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায়।
মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের দুই শ কোটি টাকা হাতিয়ে নরসিংদীর পাঁচ থেকে ছয় হাজার সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে র‌্যাব মুখপাত্র বলেন, ‘ভুক্তভোগীরা নরসিংদীর পলাশ থানায় একটি মামলা করেন। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন ও সমবায় অধিদপ্তরে অভিযোগ দেন। এরপরই তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
যেভাবে প্রতারণা শুরু
২০১০ সালে নরসিংদীর সদর থানার চিনিশপুর ইউনিয়নের ঘোড়াদিয়া এলাকায় শরিয়াভিত্তিক শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে এমএলএম কার্যক্রম শুরু করে। কৌশলে ধর্মকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে সুদমুক্ত ব্যবসার কথা বলে বিভিন্ন পেশার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ শুরু করেন তারা। সাধারণ মানুষের মাঝে বিশ্বাস অর্জনের জন্য নেয়া হতো ধর্মের পরীক্ষা। সুদমুক্ত মুনাফার ফাঁদে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেয়া টাকা দিয়ে শাহ আলম চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ২৪ জন কর্মচারী ও ২০ জন পরিচালক নিয়োগ করা হয়। পরিচালকদের সবাই প্রতারক শাহ আলমের সহযোগীদের স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন।
প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়াতে নরসিংদীর বিভিন্ন থানায় জাঁকজমকপূর্ণ শাখা অফিস ও কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- শাহ সুলতান এম.সি.এস. কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি., স্বদেশ টেক্সটাইল লিমিটেড, শাহ সুলতান টেক্সটাইল লিমিটেড ও শাহ সুলতান প্রপার্টিজ লিমিটেড।
র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে যা জানা গেছে
প্রতিষ্ঠানের মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহের জন্য তিন শতাধিক কর্মী রয়েছে। যাদেরকে কোনো প্রকার বেতন দেয়া হতো না। গ্রাহকদের বিনিয়োগে এককালীন ১০ শতাংশ ও বছরে ছয় শতাংশ মুনাফার প্রলোভন দেয়া হতো। বার্ষিক ১২-১৬ শতাংশ মুনাফার প্রলোভন দেখায় প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়াও তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি মুনাফায় মাসিক ভিত্তিতে ‘ডিপিএস’-এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতেন। বেশ কিছু গ্রাহককে বেশি বা উচ্চ মুনাফায় ঋণ দেন। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান না হলেও তারা ব্যাংকের মতোই গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা টাকায় জমি কেনা ও টেক্সটাইল মিলে (কারখানা) বিনিয়োগ এবং নিজস্ব অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করেন।
সাংবাদিকদের যা বললেন র‌্যাব মুখপাত্র:
ইসলামিক কৌশলে কীভাবে প্রতারণা করছিল এমন প্রশ্নে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতির পরীক্ষা ও ইসলামিক কিছু কৌশল অবলম্বন করে এই প্রতারণা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণ মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য তারা ধর্মীয় অনুভূতির পরীক্ষা নিতেন। ইসলামি শরিয়া মোতাবেক সবকিছু মেনে চলছেন কি না- এই বিবেচনায় গ্রাহকদের সদস্যপদ ও বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেয়া হতো। এছাড়াও একটি নির্দিষ্ট জেলাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং ওই এলাকায় ২০১০ সালের আগে তারা বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা থাকায় মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে।’
গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া টাকা দিয়ে কী করা হতো- এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, ‘গ্রাহকের টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পার্সেন্টেজ দেয়া হতো; বেতন দেয়া হতো না। আর নিজেদের নামে জমি কিনেছে তারা। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করেছে, আবার সেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। গ্রাহকদের টাকা দিয়ে দুটি টেক্সটাইল মিল ও স্বদেশ প্রপার্টিজ নামে একটি কোম্পানি খুলেছিল।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘শাহ সুলতানের চারটি প্রতিষ্ঠানে পাঁচ থেকে ছয় হাজার গ্রাহক রয়েছে। তাদের তথ্যমতে আরও অনেক টাকার প্রতারণা করেছে। তবে এই টাকাগুলো ব্যাংকে রাখেনি।’
‘প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষে ২০ জন থাকলেও পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের তথ্যমতে, করোনাকালীন সময়ে তারা লাভ করতে না পারায় গ্রাহকদের টাকা দিতে পারেনি। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের যে সম্পদ রয়েছে তা বিক্রি করল ৫০ কোটি টাকার মতো হবে।’ জানান র‌্যাব মুখপাত্র।
ঢাকাটাইমস/১৩মার্চ/এসএস/এফএ

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :