মেহেরপুরে শহীদ হামিদের কবরের চিহ্ন হারিয়ে যাচ্ছে

প্রকাশ | ১৩ মার্চ ২০২২, ১৫:৪৮

নাসের চৌধুরী, মেহেরপুর

পাক সেনারা না চিনলেও স্থানীয় রাজাকারেরা চিনতেন মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা মেহেরপুরের আবদুল হামিদকে। ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর রাজাকাররা প্রতিভাবান তরুণ হামিদকে ধরে নিয়ে যায়। ওই সময় হামিদ বাবা-মা’সহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। খাবার আসন থেকে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে সরকারি কলেজে সেনাক্যাম্পে শারীরিক নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে। যুদ্ধ পরবর্তী তার লাশ শনাক্ত করে পরিবারের লোকজন। কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল স্কুলমাঠের এক কোনে তাকে সমাহিত করা হয়। সেই কবরের চিহ্নটি বিলীনের পথে।  কবরটি সংস্কারে উদ্যোগ নেয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কিংবা জেলা প্রশাসনের কেউ। তার নামে একটি স্মৃতিফলক ছিল, মেহেরপুর পৌরসভা সেখানে মার্কেট নির্মাণ করেছে। শহীদ হামিদের নামে একটি সড়ক আছে। ওই সড়কটি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল হামিদ স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে দল গঠন করেছিলেন। রাতের আঁধারে রাস্তার পাশের দৃষ্টিকাড়া দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সেঁটে দিতেন স্বাধীনতার পক্ষে। তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য ও খাবার সরবরাহ করাসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন। তার সেই পোস্টারের বাণি মানুষের মুখে মুখে ফিরত। এ কারণে স্থানীয় অবাঙালি ও রাজাকারদের চক্ষুশূলে পরিণত হন তিনি। আবদুল হামিদ ছিলেন ভালো অভিনয় শিল্পী। ফুটবলেও সুনাম কুড়িয়ে ছিলেন। 

১৯৭১-এ মেহেরপুর তখন থমথমে পরিবেশ। মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি হানাদারদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো ও গোপনে লিফলেট বিলি করা হচ্ছিল আবদুল হামিদের নেতৃত্বে। ৩ ডিসেম্বর দুপুরে বাবা-মাসহ ভাই-বোনদের নিয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন হামিদ। সে সময় স্থানীয় শরীফ বিহারির নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি হানাদার সেনা শহরের গভর্নমেন্ট হাইস্কুল পাড়ায় হামিদের বাড়িতে হানা দেয়। বাবা-মায়ের সামনেই খাবারের থালা থেকে হামিদকে তুলে পিছমোড়া করে বেঁধে ট্রাকে করে নিয়ে যায় সরকারি কলেজের সেনাক্যাম্পে। মারাত্মক নির্যাতন করে ওইদিনই হত্যা করে কলেজ প্রাঙ্গণে গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয় তাঁর লাশ। স্বাধীনতা পরবর্তী স্বজনেরা লাশের সন্ধান পেয়ে কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল প্রাঙ্গণের এক কোণে সমাহিত করেন। অদম্য সাহসী, নাট্যাভিনেতা, সংস্কৃতিসেবী শহীদ আবদুল হামিদের জন্ম ১৯৫৪ সালে মেহেরপুর শহরের গভর্নমেন্ট হাইস্কুলসংলগ্ন সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা মরহুম আবদুর রশীদ ছিলেন ব্যবসায়ী, মা মরহুম হাদিসা  বেগম ছিলেন গৃহিণী।

স্বাধীনতা পরবর্তী স্থানীয় তরুণ যুবকরা  মেহেরপুর শহরের কাঁসারি বাজার মোড়ে শহীদ হামিদের নামে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করেছিলেন। ২০০১ সালে তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান মোতাছিম বিল্লাহ মতু কাঁসারিপাড়া মোড়ে মার্কেট নির্মানের সময় স্মৃতিফলকটি গুঁড়িয়ে দেন। তবে পৌরসভার পক্ষে মল্লিকপাড়া মোড় থেকে কাঁসারিবাজার মোড় পর্যন্ত সড়কটি শহীদ আবদুল হামিদের নামে নামকরণ করেন। ওই সড়কের নামেই হামিদকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

শহীদ এই মুক্তিযোদ্ধা হামিদের ভাই আবদুস সালাম বলেন ‘আমার ভাইয়ের কবর রাস্ট্রের সম্পদ। রাস্ট্র কীভাবে রাখবে সেটা রাস্ট্রই ভালো জানেন’।

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মাহবুবুল হক মন্টু প্রসঙ্গে বলেন- ঘুরে ফিরে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা হয়, স্বাধীনতা বিরোধীদের ওই তালিকায় স্থান দেওয়া হয়, অথচ একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়া হয় না এটা জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জার। উন্নয়নের জোয়ারে একটি কবর সংরক্ষণ করা হয় না ভাবতেই কষ্ট হয়।

কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলের প্রধান শিক্ষক সানজিদা ইসলাম লাবনী বলেন- আমাদের বাজেট না থাকায় কবরটি মেরামত করতে পারিনি। তবে স্থানীয় গণপূর্ত অফিসে আবেদন করা হয়েছে কবরটি সংস্কার করার জন্য।

(ঢাকাটাইমস/১৩মার্চ/এআর)