শবে বরাত ক্ষমা প্রার্থনার রাত

প্রকাশ | ১৭ মার্চ ২০২২, ১৫:২৪ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২২, ১৫:৩০

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

শবে বরাত মহান আল্লাহর দেয়া একটি পবিত্র রাত। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি। শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত।

হাদিস শরিফে রাসুলের (সা.) ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফী মিন শাবান’। অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫তম রজনী যা আরবি ভাষায় লাইলাতুল বারাআত নামে পরিচিত।

পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানা ভাষায় যা ‘শবে বরাত’ নামেই অধিক পরিচিত। এই রাতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে অভাব-অনটন, রোগ-শোক, বিপদ-আপদ ও গুনাহ থেকে মুক্তি চাওয়ার জন্য আহ্বান জানান।

মহান আল্লাহ মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহর এবাদত করার জন্য। পৃথিবীতে অবস্থানকালীন সময়ে মানুষ ও জিন জাতি কীভাবে চলবে এবং কী কী আমল করবে এবং কোন কোন কাজ পরিহার করতে হবে তা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন। তবুও মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অনেক পাপ করে থাকে। আল্লাহ বড়ই দয়ালু। তিনি চান অপরাধ করার পর বান্দাদেরকে একটি সুযোগ দিতে চান। যাতে তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে তওবা করে। তারা যদি এই শবে বরাত রাতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে তিনি ক্ষমা করে দেবেন। আর এ জন্য রাতটি ক্ষমা প্রার্থনার রাত। সুতরাং পাপীরা এ রাতে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে।

শবেবরাত আগমণের পূর্বেই আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন থাকলে তা ঠিক করে নিতে হবে। কারো হক থাকলে তা আদায় করে দিতে হবে। অন্তরকে কলুষমুক্ত করে নিবে।

কোরআনুল কারিমে এসেছে, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়ই আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি।’ (সুরা-৪৪ দুখান, আয়াত: ১-৫)। মুফাসসিরিনগণ বলেন: এখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তাফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখান–এর দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত বলে শবে বরাতকে বোঝানো হয়েছে। (মাআরিফুল কোরআন)।

অনেক হাদিসে এসেছে, ক্ষমার রাত শবে বরাত। আল্লাহ তাআলা এই রাতে অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু এরপরও কিছু লোক আছেন, যাদের আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। এই রাতে তাদের ভাগ্যে ক্ষমা নেই। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) সূত্রে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, মধ্য শাবানের রাতে, অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক, হিংসুক ও বিদ্বেষী লোক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৬৬৫; আল মুজামুল কাবির : ২০/১০৯; শুয়াবুল ঈমান, হাদিস : ৬৬২৮)।

শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, ‘এমন পাঁচটি রাত রয়েছে, যেগুলোতে আল্লাহ তাআলা বান্দার দোয়া ফিরিয়ে দেন না। সেই রাতগুলো হলো, জুমার রাত, রজবের প্রথম রাত, শাবানের ১৫ তারিখের রাত, দুই ঈদের রাত।’ (সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ৬০৮৭; শুয়াবুল ঈমান, হাদিস : ৩৪৪০; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৯২৭)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাত ইবাদত–বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন, ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিক প্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব।’ এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৪)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে শাবানে ১ দিন রোজা রেখেছে, তাকে আমার সাফায়াত হবে। আরও একটি হাদিস শরীফে আছে যে, হুজুর সালল্লাহু তালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি শাবানের ১৫ তারিখে রোজা রাখবে, তাকে জাহান্নামের আগুন ছোঁবে না।

আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) এই রাতে মদিনার কবরস্থান জান্নাতুল বাকিতে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি বলেন, এই রাতে কালব গোত্রের বকরির পশমের সংখ্যার চেয়েও বেশিসংখ্যক বান্দাকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৩৯, ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৭৯, শুয়াবুল ঈমান, হাদিস : ৩৫৪৪)।

হযরত আসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর তাঁর পিতার সনদে দাদা হযরত আবুবকর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শাবানের ১৫তম রাত্রে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং সকল পাপীকে (যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে) ক্ষমা করে দেন। তবে’ মুশরিক’ (আল্লাহর সাথে সমকক্ষ সাব্যস্তকারী) ও ‘মুশহিন’ (হিংসুক) ব্যতীত। (-বায়হাকি ফি শুয়াবিল ঈমান হা. ৩৮৩৫)

শবে বরাতের রাত তাৎপর্য মন্ডিত। এর যথেষ্ট ফজিলত ও বরকত রয়েছে। অন্য দিকে মাহে রমজানের আগের মাস হওয়ার কারণে মূলত এটি মাহে রমজানের সাধনা ও অধ্যবসায়ের পূর্ব প্রস্তুতির মাস।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন শাবান আমার মাস আর রমজান মহান আল্লাহ তায়ালার মাস।

হুজুরে পাক (সা.) আরো এরশাদ করেন, যখন তোমাদের মাঝে শবে বরাতের আগমন হয় তখন তোমরা সেই রাতে জাগ্রত থেকে কাটাও, নামাজ পড়, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত কর এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ।

কারণ, ওই দিন সূর্যাস্তের পরপরই মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আকাশে ফজর পর্যন্ত স্বীয় নূরের তাজাল্লীর বিচ্চুরণ ঘটান এবং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়-

কোনো গুনাগার নাফরমান ব্যক্তি আছে কি- যে আমার সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করবে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। রিযিক প্রার্থী কেউ আছে কি- যে আমার কাছে রিযিক প্রার্থনা করবে? তার জন্য আমার রিযিক ভান্ডার খুলে দিব। কোনো বিপদ গ্রস্থ আছে কি- যে আমার কাছে মুক্তি চাবে? আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্ত করে দিব।

সারারাত মহান আল্লাহর তায়ালার পক্ষ থেকে সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত এইভাবে ঘোষণা দেয়া হয়ে থাকে এবং বান্দাদের উপর আল্লাহর রহমত অজস্র ধারায় নাজিল হতে থাকে (ইবনে মাজা)।

হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আজ রাতে জন্ম মৃত্যু নিধারণ, জীবিকা বন্টন এবং মানুষের সব কার্যাবলী আকাশে উঠানো হবে (জামিয়াতুল তালেবিন )।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন শাবানের মধ্যবর্তী রাতে হযরত জিবরাইল (আ.) আমার নিকট এসে বললেন, হে মুহম্মদ (স.) আপনার মাথা আকাশের দিকে উঠান, কেননা আজ বরকতের রাত। আমি বললাম কেমন বরকত? হযরত জিব্রাইল (আ.) বললেন, এ রাতে মহান আল্লাহপাক রহমতের ৩০০ দরজা খুলে দেন।

রাতের চতুর্থাংশে পুনরায় জিব্রাইল (আ.) এসে বললেন, হে মুহম্মদ (সা.) মাথা উত্তোলন করুন, আমি মাথা উত্তোলন করে দেখলাম বেহেশতের সব দরজা খোলা। প্রথম দরজা থেকে এক জন ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলছেন আজ রুকুকারীদের জন্য সুসংবাদ।

দ্বিতীয় দরজা থেকে একজন দাঁড়িয়ে বলছেন, আজ সেজদাকারীদের জন্য সুসংবাদ। তৃতীয় দরজায় একজন দাঁড়িয়ে বলছেন, আজ জিকিরকারীদের জন্য সুসংবাদ। চতুর্থ দরজায় একজন দাঁড়িয়ে বলছেন, আজ আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারীদের জন্য সুসংবাদ।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম কখন পর্যন্ত এই দরজা খোলা থাকবে। হযরত জিব্রাইল (আ.) বললেন, সুবহে সাদিক পর্যন্ত।

হযরত হাসান বসরী ( রহ.) নবী করিম (সা.) এর ৩০ জন সাহাবীর থেকে বর্ণনা করেন, এ রাতে নামাজ আদায়কারীদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা ৭০ বার রহমতের দৃষ্টি করে থাকেন এবং প্রত্যেক দৃষ্টিতে ৭০টি ইচ্ছা পূরণ করে থাকেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, এ রাতে আল্লাহ তায়ালা বণী ক্বালব, বণী নজীব ও বণী রবি এ তিন বংশের বকরী ভেড়ার পশম সমতুল্য অসংখ গুনাহগারকে মাফ করে দেন। উল্লেখ্য এদের অধিক বকরী ছিল।

আমাদের উচিত আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এ রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ, তওবা, দুরুদ শরীফ পাঠ জিকির আজগার ও পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত এবং সব মৃত মুসলিম নর-নারীর জন্য দোয়া করা।

এত বরকতময় রজনীতেও কিছু লোকের দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন না। এরা হলো মুশরিক, আল্লাহর সঙ্গে শত্রুতা পোষণকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, আত্মীয়তা ছিন্নকারী, মদ পানকারী, জুয়াড়ী, অত্যাচারী সৈনিক, তবলা বাদক।

বরকতময় এ রজনীতে তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নিমগ্ন থাকাই মুমিনের কর্তব্য। অনেকে আবার মনগড়া রীতি-নীতি নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার মূলক কাজ সওয়াবের আশায় করে থাকেন। এতে সওয়াব না হয়ে হয় কঠিন গুনাহ। যেমন- বোমাবাজী বা আলোকসজ্জা করা, মসজিদে অযথা মোমবাতি জ্বালানো, গরু, ছাগল, মোরগের গোশত যোগাড় করাকে আবশ্যক মনে করা।

নবী করীম (স.) আল্লাহর দরবারে আগ থেকেই দোয়া করতেন এ বলে— হে আল্লাহ! আমাকে রজব ও শাবান মাসের বরকত দাও এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছাও।

(ঢাকাটাইমস/১৭ মার্চ/আরজেড)