পাগলীমার হাটে প্রতিদিন কোটি টাকার মরিচ বিক্রি

আব্দুর রশিদ শাহ্, নীলফামারী
| আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২২, ১৩:১৭ | প্রকাশিত : ০৬ এপ্রিল ২০২২, ১৩:১৫

নীলফামারীর ডোমার উপজেলার মরিচের জন্য বিখ্যাত পাগলীমার হাট। প্রতিদিন সকাল থেকে হাটে শুরু হয় হাকডাক। দেশের বিভিন্ন জেলার থেকে পাইকাররা আসেন এখানে। বিকাল পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। ভরা মৌসুমে এই হাটে প্রতিদিন অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার মণ মরিচ বিক্রি হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এখানকার মরিচ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। হিসেব করলে এখানে গড়ে প্রতিদিন কোটি টাকার মরিচ কেনাবেনা হয়।

ডোমার উপজেলার মটুকপুর ইউনিয়নের পাঙ্গা মুছার মোড় এলাকায় পাগলীমার হাটের অবস্থান। মরিচের এই হাটে ডোমার, ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলা ছাড়াও পাশে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার শত শত মরিচ চাষি ও ব্যবসায়ী আসেন। শুধু মরিচ ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠা পাগলীমার হাটে রয়েছে অর্ধশত আড়ৎ। দূর দূরান্তের ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনায় এসব আড়ৎ সবসময় সরগরম থাকে।

নীলফামারীসহ আশপাশের জেলার মাটি ভালো হওয়ায় উৎপাদিত মরিচের মান ভালো হয়।

এই হাটের কদর একটু বেশি। গেল ১৪ থেকে ১৫ বছর ধরে কেনাবেচাও বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এই হাটে আসাতে খুশি স্থানীয় মরিচ চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

তারা বলেন, দিন দিন মরিচের উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে চাহিদা। মচিরের ভরা মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে সত্তর লাখ থেকে কোটি টাকার বেশি মরিচ বিক্রি হয়ে থাকে বলে দাবি করছেন হাট ইজারাদার।

হাটে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জাতের বিন্দু মরিচ, সাপ্লাই মরিচ, ডেমা মরিচ, ডেমা হাইব্রিড মরিচ, জিরা মরিচসহ দেশি মরিচ পাওয়া যায়। তবে প্রকার ভেদে এসব মরিচ প্রতিমন ১৫০০-১৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। তবে কোনো কোনো দিন আমদানির তুলনায় চাহিদা বেশি হলে দাম একটু বেশি থাকে। ক্রেতা-বিক্রেতার হাকডাকে মুখর হাট। কেউ মরিচ বস্তাবন্দি করছেন, কেউ আবার টাকা গুণছেন।

সরেজমিনে গিয়ে কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মরিচের ফলন বাম্পার হলেও কিছু মরিচ ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণে চিন্তিত তারা।

নিজেরাই স্থানীয় বাজারে কীটনাশকের দোকান থেকে বিষ কিনে মরিচ খেতে স্প্রে করছেন। কৃষি অফিস থেকে কোনো ধরনের পরামর্শ মিলে না বলে অভিযোগ তাদের। তবে দাম ভাল আর মরিচের চাহিদা ব্যাপক হওয়ায় আবহাওয়া ভালো থাকলে অধিক মুনাফা লাভের স্বপ্ন দেখছেন তারা।

মরিচ চাষি আফজাল আহমেদ বলেন, আমি তিন বিঘা মাটিতে মরিচ চাষ করছি। মরিচে পোকার আক্রমণের কারণে প্রতি সপ্তাহে স্প্রে করতে হয়। এ পর্যন্ত খরচ ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। প্রায় লাখ খানেক টাকার মরিচ বিক্রি করেছি। আবহাওয়া যদি ভালো থাকে, আরও এক লাখ টাকার মতো মরিচ বিক্রি করতে পারব।

আরেক মরিচ চাষি আবুল হোসেন বলেন, মরিচে রোগ দেখা দিয়েছে, সেই কারণে চিন্তায় আছি। অসময়েই কোনো মরিচ সাদা আবার কোনো মরিচ হলুদ হয়ে গেছে। গাছে এবার ফুল-ফলও কম এসেছে। বাজার থেকে ওষুধ কিনে স্প্রে করেছি। এখন পর্যন্ত কৃষি অফিসের কারো কাছ থেকে কোনে পরামর্শ নিতে পারিনি।

অনাথ চন্দ্র রায় দীর্ঘ দিন ধরে মরিচ চাষ করে আসছেন। সপ্তাহে তিন চারদিন মরিচ বিক্রি করতে হাটেও আসেন।

তিনি বলেন, এবারও তিন বিঘা জমিতে মতো মরিচ চাষ করেছি। বর্তমানে মরিচ ক্ষেতে প্রচুর পরিমাণে পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। ফলন নিয়ে চিন্তিত। কৃষি অফিসের কোনো বিএস এর দেখা পাই না। নিজেরাই বাজারের দোকান থেকে বিভিন্ন কোম্পানির কীটনাশক কিনে খেতে স্প্রে করছি। এবার মরিচের দামটা অনেক ভালো। তবে কৃষি অফিস থেকে বিএস এসে যদি পরামর্শ দিত, তাহলে মনে হয় ফলন আরো ভালো হতো।

হাটের আড়তদার সমিতির সভাপতি এনতাজুল হক বলেন, পাগলীমার হাটে মরিচের মৌসুমে প্রতিদিন হাট বসে। এমন কোন দিন নেই, এখানে আট থেকে ১০ হাজার মণ মরিচ কেনাবেচা হয় না। এখানকার মরিচ সিরাজগঞ্জ, পাবনা, যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। এই হাটটি উত্তরাঞ্চলে মরিচের জন্য বিখ্যাত। প্রায় ১৫ বছর ধরে এই হাটের মরিচ বেচাকেনার সাথে যুক্ত আছি। আশেপাশের কয়েকটি উপজেলার চাষিরা এখানে মরিচ বিক্রি করতে আসেন।

হাটে এক আড়তে বসে কথা হয় কুষ্টিয়া থেকে আসা পাইকার মজিবর রহমানের সাথে।

তিনি বলেন, মরিচের জন্য উত্তরাঞ্চলে এটি বিখ্যাত হাট। কয়েক বছর ধরে আমি এই হাটে মরিচ কেনাকাটা করছি। এখানে আমি বিভিন্ন জাতের মরিচ কিনে নিয়ে যাই। টাকা লেনদেন বা বাড়তি কোনো ঝামেলা নেই। অনেক সময় হাটে না এসেও ব্যাংকে টাকা পাঠিয়ে এখানকার আড়ত থেকে মরিচ কিনে থাকি।

স্থানীয় মরিচ ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান বলেন, এই পাগলীরমার হাটে দীর্ঘদিন ধরে শুধুই মরিচের বেচাকেনা হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এখান থেকে মরিচ কিনে নিয়ে যায়। বাহিরের জেলা থেকে পাইকার আসায় আমরা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চাষিদের কাছ থেকে মরিচ কিনে ভালো দামে মরিচ বিক্রি করতে পারছি। এতে আমরাও যেমন লাভবান হচ্ছি, তেমনি আমাদের এলাকার কৃষকরাও মরিচের ভালো দাম পাচ্ছে।

হাট ইজারাদার রোমান কবির বলেন, আমরা আমাদের লাভের কথা চিন্তা করি না। তারপরেও যেহেতু টাকা দিয়ে হাট ইজারা নিয়েছি, সেই হিসেবে যত পারা যায় কৃষকদের ছাড় দেই আমরা। এছাড়াও বাহিরে থেকে আসা পাইকারদের যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়, সেই দিকটা আমরা হাট কতৃপক্ষ খেয়াল রাখি।

এদিকে মরিচ চাষিদের অভিযোগ মানতে নারাজ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আনিছুজ্জামান। উল্টো তিনি দাবি করেন, কৃষি বিভাগের অব্যাহত পরামর্শ এবং নির্দেশনায় এই অঞ্চলে মরিচের উৎপাদন বেড়েছে। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় মরিচের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি বাজারে ভালো দাম থাকায় কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন।

ডোমার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আনিছুজ্জামান বলেন, উপজেলায় এ বছর মরিচের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৫০ হেক্টর। তার মধ্যে আমরা ৭৮০ হেক্টর অর্জন করেছি। এ বছর মরিচের ফলন ও দাম দুটোই ভালো যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এই সময়ে মরিচের কিছু সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত ফল ছিদ্রকারীর একটা পোকা মরিচে আক্রমণ করে থাকে। পোকা দমনে আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। আমাদের ব্লকে যারা আছে তারাও পরামর্শ দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে যদি কৃষকরা এমামেকটিন বেনজয়েট গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করেন, তাহলে বেশি উপকৃত হবেন। আমরা এই কীটনাশক এক সপ্তাহ পর পর ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছি।

(ঢাকাটাইমস/৬এপ্রিল/এসএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :