মিউনিখের ফ্ল্যাটে পড়েছিল হুমায়ুন আজাদের নিথর দেহ

প্রকাশ | ১৩ এপ্রিল ২০২২, ১৫:০৫

ওমর ফারুক, ঢাকাটাইমস

২০০৪ সালের ১২ আগস্ট। জার্মানির মিউনিখ শহরে তখন কেবল সকাল। জার্মান পেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ইয়োহানেস স্ট্রাসার কিছু দাপ্তরিক কাজের জন্য অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছান। অনেকক্ষণ যাবত বেল বাজিয়ে, ডাকাডাকি করে তিনি কোনো সাড়া পেলেন না। পরে নিরুপায় হয়ে প্রবেশ করলেন অ্যাপার্টমেন্টে। কিন্তু ততক্ষণে জীবনের ওপারে চলে গেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ।

ইন্টারন্যাশনাল পেন ক্লাবের বৃত্তি নিয়ে হুমায়ুন আজাদ জার্মানির মিউনিখে আসেন ৮ আগস্ট রবিবার সন্ধ্যায়। মৃত্যুর আগের দিনেও ড. আজাদ যোগ দিয়েছিলেন একটি গ্রিল পার্টিতে, ছিলেন প্রাণোচ্ছল এবং হাসিখুশী। পুলিশ যখন তার অটোপসি করে, রিপোর্টে পাওয়া যায় মৃত্যুর কারণ স্বাভাবিক। হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন তিনি। তবে তার আগেই তাকে মেরে ফেলেছিলো উগ্রবাদী সন্ত্রাসীরা। ২০০৪ সালের অমর একুশে বইমেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি ধারালো অস্ত্রের আঘাতে চোয়াল খুলে গিয়েছিলো তার। একই সঙ্গে শরীরের বাম পাশ হয়ে গিয়েছিল অকেজো। জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়েছেন অসংখ্য সমস্যা আর যন্ত্রণায়। সে বছরই জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে তিনি চলে যান জার্মানি।    

১৯৪৭ সালে বিক্রমপুরে জন্ম নেয়া হুমায়ুন আজাদ একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, রাজনীতিক ভাষ্যকার, কিশোরসাহিত্যিক, গবেষক, এবং অধ্যাপক। তবে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, যৌনতা, নারীবাদ ও রাজনীতি বিষয়ে তার ক্ষুরধার লেখার জন্য তিনি ছিলেন বিশেষভাবে আলোচিত। ১৯৯২ সালে তার নারীবাদী গবেষণা-সংকলনমূলক গ্রন্থ নারী প্রকাশের পর পাঠকমহলে সৃষ্টি হয় বিতর্কের। যার ফলে ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল অবধি সাড়ে চার বছর বইটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিল।

হুমায়ুন আজাদ ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও তিনি সরাসরি ধর্মের সমালোচনা সে অর্থে করেননি। তবে তিনি সবসময়ই ধর্মীয় মৌলবাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করতেন।  বাংলাদেশের সমাজে চলা রক্ষণশীলতা এবং প্রথার বিরোধী ছিলেন তিনি। হুমায়ুন আজাদের লেখালেখিতে উদারপন্থা, বিজ্ঞানমনস্কতার এবং একই সঙ্গে দ্রোহের ছাপ স্পষ্ট ছিলো। একটি বৈষম্যহীন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার স্বপ্ন তিনি দেখতেন। নিজের এক লেখায় হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, আমি এমন একটি সমাজ চাই যে সমাজ বলা যাক পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজের চূড়ান্ত রূপ। সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্নে বিভোর আমি নই, আমি চাই সবাই স্বচ্ছল থাকবে - জ্ঞানচর্চা, আনন্দ, উল্লাস এবং যতো প্রথা রয়েছে সেসব অতিক্রম করে মানুষ সম্পূর্ণ মানবিক জীবন যাপন করবে।

২০০৩ সালে হুমায়ুন আজাদ ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। ইত্তেফাক পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল উপন্যাসটি। ২০০৪ সালের বইমেলায় উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের একদল জনগোষ্ঠী প্রবল প্রতিক্রিয়া জানায়। তার জের ধরে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি  বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বারা নির্মমভাবে আক্রমণের শিকার হন হুমায়ুন আজাদ। সেবারে তাকে মেরে ফেলতে না পারলেও শারিরীকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েন তিনি। হামলার পর তিনি ২২ দিন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এবং ৪৮ দিন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার পরের দিন তার ছোট ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। পরে আদালতের আদেশে অধিকতর তদন্তের পর সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। ওই মামলার ১৮ বছর পর আজ ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আল-মামুনের আদালত চার আসামির ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন।

দণ্ডিত আসামিরা হলেন— জেএমবির সূরা সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক ও আনোয়ার আলম ওরফে ভাগ্নে শহিদ এবং জামায়াতে মুজাহিদুন বাংলাদেশের (জেএমবি) সূরা সদস্য সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন ও নুর মোহাম্মদ ওরফে সাবু। দণ্ডিতদের মধ্য শেষের দুই জন পলাতক আছেন।

এছাড়া আসামি রাকিবুল হাসান ওরফে হাফিজ মাহামুদ ক্রাসফায়ারে নিহত হয়েছেন।

(ঢাকাটাইমস/১৩এপ্রিল/ওএফ/ইএস)