তিস্তা ফ্লাড বাইপাস সড়কের বেহাল দশা, ভোগান্তিতে দুই জেলার মানুষ

আব্দুর রশিদ শাহ্, নীলফামারী
| আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২২, ১১:২৯ | প্রকাশিত : ১৪ এপ্রিল ২০২২, ১১:২৪

নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার সংযোগস্থলে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প। এই ব্যারেজ রক্ষার্থে বাম তীরে লালমনিরহাট অংশে ফ্লাড বাইপাস নির্মাণ করা হয়। ফ্লাড বাইপাস সড়কটি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থেকে ডিমলা হয়ে নীলফামারী যাতায়াতের একমাত্র সড়ক। আর এই তিস্তা ব্যারেজ ফ্লাড বাইপাস সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে জরাজীণের ফলে এই সড়ক দিয়ে শতশত যাত্রীবাহী পরিবহন ও পণ্যবাহী পরিবহনে চলাচলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

জানা গেছে, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারীর ডিমলা খড়িবাড়ী সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এ তিস্তা নদী। যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশে যায়। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার।

ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত সরকার এক তরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় শীতেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়।

২০২১ সালের ২০ অক্টোবর হঠাৎ তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বেড়ে যায়। ওই দিন তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প রক্ষায় নির্মিত সড়কের (ফ্লাড বাইপাস) ৩০০ মিটারের মতো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে বন্ধ হয়ে যায় লালমনিরহাটের সঙ্গে নীলফামারীর যোগাযোগ। পরে ইমারজেন্সি বরাদ্দ নিয়ে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়কটির সংস্কার করেন পাউবো।

এদিকে কিছুদিন না যেতেই আবারও তা এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়। এরপর বাইপাস সড়কটি আর সংস্কার করা হয়নি। সড়কটিতে বালু ও মাটি ভরাটের কারণে খড়াতে সড়কজুড়ে প্রচুর ধুলা আর সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি দিয়ে সড়কটি কাদায় ভরে যায়। ফলে পিকআপ ভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স, মাহিন্দ্রা, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, অটোভ্যান, টেম্পুসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রমতে, তিস্তা ব্যারেজ বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। ১৫শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প নির্মিত। উত্তর জনপদের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার অনাবাদী জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বাড়তি ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকার তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মূল পরিকল্পনা গৃহীত হয় পাকিস্তান আমলে ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৭ সালে প্রকল্পের কাজ শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিভিন্ন জটিলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

পরে ১৯৭৯ সালে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার গড্ডিমারী ইউনিয়নের দোয়ানী এবং নীলফামারীর ডিমলার খালিসা চাপানী ইউনিয়নের ডালিয়া- এর মধ্যবর্তী স্থানে তিস্তা নদীর ওপর ৪৪টি রেডিয়াল গেট সম্বলিত ৬১৫ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ব্যারেজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

১৯৯১ সালে মূল ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও ক্যানেলসহ অন্যান্য কাজ শেষ হয় ১৯৯৮ সালের জুন মাসে। এসময় রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের পাগলাপীর থেকে লালমনিরহাট-বুড়িমারী স্থল বন্দর মহাসড়কের বড়খাতা নামক স্থান পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটারের সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে পাউবো।

২০০১ সালে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের ওপর দিয়ে সংযোগ সড়কটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলে সে সময় ভারী যানবাহনের কাছ থেকে টোল আদায় করা হতো। ওই সংযোগ সড়কের ফলে বিভিন্ন জেলার দূরত্ব ও সময় অনেকটা কমে আসে। লালমনিহাটের বুড়িমারী স্থল বন্দরসহ এ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক বিপ্লব ঘটে।

তবে ব্যারেজ প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর ওই সড়ক দিয়ে অধিক ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে তখন থেকে হালকা যানবাহন স্বাভাবিক রাখা হয়। সে ক্ষেত্রে টোল নেওয়াও বন্ধ করে দেয় পাউবো।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফ্লাড বাইপাস সড়কে সামান্য বৃষ্টিতেই বিভিন্ন স্থানে কাদামাটিসহ ছোট-বড় অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন দুই জেলার হাজার হাজার মানুষ ও গাড়ি চালকরা। খানাখন্দে ভরা এ সড়কে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে চলছে হালকা ও ভারী যান। এ ছাড়া অটোরিকশা ও ইজিবাইকের মতো ছোট ছোট যানবাহন উল্টে গিয়ে প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ঠিকাদারের চরম অবহেলা ও স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের সঠিক তদারকি না থাকায় সড়কটির বেহাল অবস্থা হয়েছে। খানাখন্দে ভরা এই সড়কে একটু বৃষ্টি হলেই গর্তগুলোতে পানি জমে বেহাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন যাত্রী ও চালকরা। শুধু তাই নয়, রোগী পরিবহন ও জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত যাতায়াত করা যায় না এই সড়ক দিয়ে। সড়কটি দ্রুত সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান গাড়ি চালক ও স্থানীয়রা।

কথা হয় তিস্তা ব্যারেজ এলাকার বাবুল হোসেনের সাথে।

তিনি বলেন, ‘সামান্য বৃষ্টি হলে কাদার জন্য চলাচলের সমস্যা আবার বৃষ্টি না হলে ধুলার জন্য চলাচল করা যায় না এই রাস্তা দিয়ে। দেখছেনই তো কিভাবে গাড়ি সব আটকানো আছে। অটো থেকে শুরু করে লোকজন যাওয়াও তো খুব সমস্যা। এই রোড দিয়ে প্রচুর মানুষ যাতায়াত করে। রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টাই তো গাড়ি চলছে এই ভাবেই।’

এই সড়কে র্দীঘদিন ধরে নিয়মিত ব্যাটাচালিত ইজিবাইক চালান শাহিদ ইসলাম।

তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘একটু বৃষ্টির কারণে রাস্তার যে অবস্থা, মানুষ অনেক কষ্ট করছে। সরকারের কাছে বিনীত একটা আবেদন কিছু ভাঙ্গ ইটের খোয়া যদি এই রাস্তায় ফেলাইতো গাড়িগুলো সুন্দরভাবে চলতো। মানুষগুলো এতো কষ্ট-দুর্ভোগ করতো না। আমাদের অটোগুলার কন্ট্রোলারগুলো পোড়া যাচ্ছে। একটা কন্ট্রোলারের দাম পাঁচ হাজার টাকা, সারাদিন কামাই (রোজগার) হয় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা।’

ব্যাটাচালিত ইজিবাইকচালক সুলতান শেখ বলেন, ‘এরকম রাস্তায় যাওয়া যায় নাকি। ভেদরকেদর, গাড়ি চলে না খুব কষ্ট করে চালাতে হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হইছে আবার ভাঙ্গা রাস্তায় বালু মাটি ফেলাইছে, এতে কাদা হইছে। ভোগান্তির কথা আর বলা যায় না।’

ট্রাক চালক কামরুল মিয়া বলেন, ‘একদিন হালকা বৃষ্টি হলে গাড়ি নেওয়া যায় না। রাস্তায় দেখেন কত গাড়ি আটকে আছে, যানযট লাইগা রইছে। খালি গাড়ি নেওয়া যায় না। এটা বন্যার সময় ভেঙ্গে গেছিলো। তারপর বালু দিছে আর কিছু করে নাই। আমি চাচ্ছি রাস্তাটায় খোয়া (ইটের ভাঙ্গা) ফেলাক। যে কোনো একটা উদ্যোগ নিক সরকার, তাহলে অনেক ভাল হবে।’

দোয়ানী এলাকার আফজাল হোসেন বলেন, ‘অল্প বৃষ্টিতে এই রাস্তার এক কিলোমিটার পর্যন্ত কোনো গাড়ি চলছে না। সামান্য বৃষ্টিতেই এই রাস্তার অবস্থা আরো তো সামনে বেশি বৃষ্টি হলে এই রাস্তার অবস্থা আরো খারাপ হতো।’

হাটে ছাগল বিক্রি করতে যাচ্ছিলেন ওই এলাকার সুজন আলী।

তিনি বলেন, ‘এলা তো বৃষ্টি নাই তারপরেও দেকো কি অবস্থা। আর যখন বৃষ্টি হইবে তখন তো চলাফিরা আরো কষ্ট হইবে। এ সমস্যার তো জটিল। এই যে হাট যামো ছাগল ধরি আইনো। হাটি আসিছি এপাক থাকি ওপাকে যেয়া গাড়িত চড়ির লাগিবে।’

মোটরসাইকেল চালক সাজু ইসলাম বলেন, ‘যখন বৃষ্টি নাই তখন প্রচুর পরিমাণে ধুলা হয়। সামান্য বৃষ্টিতে যে অবস্থা হইছে আরো যদি প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয় তাহলে তো রাস্তা চলার মতো যোগ্য থাকিবে না।’

ব্যাটাচালিত ইজিবাইকচালক বুরহান উদ্দীন বলেন, ‘বৃষ্টি হইলে কাদা দিয়ে যাওয়া যায় না আবার খড়া হইলে ধুলার জ্বালায় হাটা যায় না। মাছ আনতে বড়খাতা থেকে ডালিয়া যাচ্ছি, এখন কিভাবে যাবো এই রোডটা দিয়ে। এই রোডের যে কন্ডিশন বড় বড় গাড়িগুলা দেখেন কিভাবে ফাইসা যাচ্ছে। আমরা চাচ্ছি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেন এই রোডটার দিকে দৃষ্টি দেয়। তারাতাড়ি এটা সংস্কার করা হোক।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা উদ দৌলা বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ফ্লাড বাইপাস সংস্কারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে দ্রুত সংস্কার কাজ শুরু করে সড়কটি সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করা হবে। তবে বন্যার আগে দ্রুত এটি সংস্কারের চেষ্টা করা হচ্ছে।

(ঢাকাটাইমস/১৪এপ্রিল/এসএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :