বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন নিয়ে ভারতে আরএসএসের অপচেষ্টা!

জি এম কিবরিয়া
 | প্রকাশিত : ১৪ এপ্রিল ২০২২, ১৯:৫৬

মুঘল বাদশাহ আকবর নন, বরং গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্কই যে বাংলা সন বা 'বঙ্গাব্দ' প্রবর্তন করেছিলেন, সেই মর্মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জোরালো প্রচার ও 'সচেতনতা অভিযান' শুরু করেছে কট্টর হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন আরএসএস ও তাদের অনুসারী সংগঠনগুলো। এই খবর দিচ্ছে বিবিসি বাংলা।

ভারতে এবার বাংলা নববর্ষ পালিত হচ্ছে ১৫ এপ্রিল। সেই বাংলা সনের সূত্রপাত যে একজন হিন্দু রাজার হাত ধরে, সেই বক্তব্য নিয়েই জেলায় জেলায় প্রচার শুরু করছে আরএসএস প্রভাবিত 'বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ'।

এখানে প্রশ্ন হলো, বাঙালী মুসলমান সমাজ এই হিন্দু মৌলবাদী আরএসএসের এই চক্রান্তকে কীভাবে দেখবেন?

ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলে। ইতিহাস অনুযায়ী, বাংলা সনের প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৬ খ্রি.)।

মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর হিজরী সন অনুযায়ী কৃষি খাজনা আদায় করা হতো। চন্দ্রবর্ষ যেহেতু পরিবর্তনশীল, সেহেতু ফসল উঠার সাথে সামঞ্জস্য ছিল না। অসময়ে খাজনা দেয়া কৃষকদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল। সম্রাটের আদেশে তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজী সৌরবছর ও আরবী হিজরী সনের ওপর ভিত্তি করে "বাংলা সন ও তারিখ" নির্ধারণ করেন (সূত্র: ড. মিজানুর রহমান, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাবি)।

এভাবেই আকবর প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনেন। বাংলা মাসগুলোর নাম রাখা হয় নক্ষত্রের নামানুসারে। শুরুতে মাসের দিনগুলো ছিল ৩১টি পৃথক নামে।

অতঃপর সম্রাট জাহাঙ্গীর পৃথিবীর অন্যান্য পঞ্জিকার সপ্তাহ গণনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সপ্তাহের ৭ দিনের নামকরণ করেন। এখানেও গ্রহ-নক্ষত্রের নামানুসারেই দিনগুলোর নামকরণ করা হয়।

বাংলা সন কিন্তু শূন্য বা এক থেকে শুরু হয়নি, যে বছর বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়, সে বছর হিজরি সন ছিল ৯২৩ হিজরি।

সে অনুযায়ী সম্রাটের নির্দেশে সন প্রবর্তনের বছরই ৯২৩ বছর যোগ করে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলা সনের।

দুর্ভাগ্য হচ্ছে যারা ভারতবর্ষে মুসলমানদের বিশেষ করে মুঘলদের শাসন নিয়ে গর্ব করেন বা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত ভারতবর্ষে মুসলমানদের বিজয়গাঁথা হিসেবে উচ্ছ্বসিত হন তাঁরাই তাঁদের প্রিয় সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত বাংলা সনকে হিন্দুদের ঐতিহ্য বলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিরোধিতা করেন।

এখন তারা খুশি কি অখুশি হবেন বুঝা কঠিন, যখন ভারতের মৌলবাদী হিন্দু সংগঠন সন প্রবর্তনটি রাজা শশাঙ্কের বলে চালাতে চাইছে!

তবে এটা পরিষ্কার যে, যারা বাংলা নববর্ষের সঙ্গে হিন্দুয়ানির গন্ধ খোঁজেন তাদের জানা উচিত এর সাথে হিন্দুত্ব বা মুসলমানিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই।

পৃথিবীতে যুগে যুগে প্রায় সব দেশে নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ইরানের নওরোজ।

নওরোজ (ফার্সি শব্দ যা অর্থ "নতুন দিন") ইরানি সৌর বর্ষপঞ্জী অনুসারে পালিত হয়। এই উৎসবকে "পারস্য নববর্ষ" হিসেবে অভিহিত করা হয়। বর্ণাঢ্য ও রঙিন ভাবে এই উৎসব যে সকল দেশ পালন করে তাদের অধিকাংশ দেশই মুসলিম। যেমন: ইরান, আলবেনিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া, ইরাক, কাজাখস্তান, কসোভো, কিরগিজিস্তান, সিরিয়া, তাজিকিস্তান, তুরস্ক, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)।

অথচ ধর্মের দোহাই দিয়ে এ দেশের এক শ্রেণির বকধর্মীক বাংলা নববর্ষকে এ দেশের সংস্কৃতি থেকে মুছে ফেলতে তৎপর রয়েছে বলে প্রতিয়মাণ হয়!

১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালনকারী অন্যান্য দেশ:

কেবল বাংলাদেশ নয়, এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে ১৪ এপ্রিলে বর্ষবরণের উৎসব পালন করা হয় (সূত্র: বিবিসি বাংলা)। এর মধ্যে ভারতের কয়েকটি রাজ্য, মিয়ানমার, নেপাল, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম অন্যতম।

মিয়ানমারে নববর্ষকে "থিংইয়ান" নামে ডাকা হয়। যার অর্থ 'পরিবর্তন' বা 'স্থানান্তর'। থিংইয়ানের দিনে বার্মা জুড়ে পানি উৎসব হয়, যা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো (৫০০ বছরের) পানি উৎসবের একটি।

থাইল্যান্ডের নতুন বছরের শুরুর দিনটি সংক্রান (সংক্রান্তি) উৎসব নামে পরিচিত।

মালয়েশিয়ান সিয়ামিজ গোত্রের মানুষেরা একে ধর্মীয় রীতি মেনে এ উৎসব পালন করেন।

ইন্দোনেশিয়ার বালি ও জাভা অঞ্চলের পঞ্জিকা শকাব্দের অনুসরণে ২৬ মার্চ নববর্ষ উদ্যাপন করা হয়।

শ্রীলঙ্কায় এই দিনে পালিত হয় 'সিনহালা নববর্ষ' যা দেশটির সকল মানুষ উদযাপনে সামিল হন। দিনটিতে শ্রীলঙ্কায় সরকারি ছুটি থাকে। কম্বোডিয়াতে ১৪ই এপ্রিল খেমার নববর্ষ পালন করা হয়। দেশটিতে দিনটিকে বলা হয় 'চউল সানাম থামাই', এর মানে নতুন বছরে প্রবেশ করা। উৎসবের শুরু হয় বৌদ্ধ মন্দিরে সকাল বেলায় ধর্মীয় আচার পালনের মধ্য দিয়ে।

১৪ এপ্রিল নেপালের আনুষ্ঠানিক বর্ষ পঞ্জিকা বিক্রম সাম্বাতের প্রথম দিন। এ দিনে নেপালে নববর্ষ উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকে।

লাওসেও বৈশাখের প্রথম দিনটি পালন করা হয় সংক্রান বা সংক্রান্তি বা নতুন বছর নামে।

দেশটিতে তিন দিন ধরে চলে উৎসব আনুষ্ঠানিকতা।

তাছাড়া ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন নববর্ষ উদযাপন করা হয়। এর মধ্যে আসামে- বিহু, পশ্চিমবঙ্গে- পহেলা বৈশাখ, কেরালায়-বিষু, উড়িষ্যাতে -পান সংক্রান্তি, পাঞ্জাবে- বৈশাখি, তামিল নাড়ুতে -পুথান্দু এবং ত্রিপুরায়- পহেলা বৈশাখ নামে নববর্ষ উৎসব পালিত হয়, যা তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

তথাকথিত কোন কোন মধ্যপন্থী মত প্রকাশ করেন যে নববর্ষ পালন করেন, কিন্তু উৎসব নয়। তাদের উদ্দেশ্যে বলা যায় নওরোজ কি উৎসব বিবর্জিত?

বাংলা নববর্ষ এত উৎসব মুখর কেন:

অতীতে জমিদারেরা খাজনা আদায়ে যে নিপীড়ন বা তিক্ততা সৃষ্টি করতো তা লাঘবের জন্য সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের পরের দিনটিকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা সাথে উৎসবে পরিণত করেন। এতে থাকত নাচ, গান, যাত্রাপালা, মেলা, গরু ও ঘোড় দৌড়, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ ইত্যাদির আয়োজন।

ঢাকায় নববর্ষ প্রবর্তন:

১৬০৮ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশনে সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতি যখন ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেন তখন থেকেই এদেশে রাজস্ব আদায় এবং বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশের শুরুর দিন হিসেবে পহেলা বৈশাখ উৎসবের দিনরূপে পালন শুরু হয়। এ সময় সুবেদার ইসলাম খাঁ তাঁর বাসভবনের সামনে প্রজাদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ ও বৈশাখী উৎসব পালন করতেন। এই উপলক্ষে মেলায় গান-বাজনা, গরু-মোষের লড়াই, কাবাডি খেলা হতো।

আধুনিক কালে নববর্ষ:

আধুনিক কালে শান্তিনিকেতন থেকেই বাংলা বর্ষ-বিদায় হিসাবে 'চৈত্র সংক্রান্তি' ও পহেলা বৈশাখ 'নববর্ষ' পালন শুরু হয়।

পাকিস্তানীরা বাঙালীদের বরাবরই হিন্দু প্রভাবিত নিচু জাতের মানুষ ভাবত। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে হিন্দুত্বকে গন্ধ খুঁজে বেড়াত। তারা বাংলা ভাষায় উর্দু ও আরবী শব্দের জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে হিন্দুয়ানি এই বাংলা ভাষাকে মুসলমানিকরণের আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। আইয়ুব খান এদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে।

৫২-র ভাষা আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করাসহ পাকিস্তানের জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদ হিসাবে ১৯৬০-এর দশক থেকে বাঙালী বর্ষবরণ উৎসব পালন শুরু করে।

১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হয়। একই বছর প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ’ দিয়ে শুরু হয়েছিল নতুনরূপে বাঙালীর প্রাণের উৎসব বৈশাখ উদযাপনের পথচলা। রবীন্দ্রসাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চা বন্ধ করার পেছনেও উদ্দেশ্য ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদী ধারাকে ধ্বংস করা। একুশের চেতনার মতো নববর্ষ উদযাপনও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে শাণিত করবে ভেবেই পাকিস্তানীরা ও তাদের এ দেশীয় দোসররা ইসলাম আর পাকিস্তানকে এক করে দেখে আর বাঙালীর ভাষা ও সংস্কৃতিকে হিন্দুত্বের সাথে মেশাতে চেষ্টা করে। এই অপচেষ্টার বিরোধিতার মধ্য দিয়েই আয়োজন শুরু হয় প্রতিবাদী বৈশাখ উদযাপন।

রমনা বটমূলে বর্ষবরণ:

১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়েই বৈশাখের পুনঃজাগরণ ঘটে। যারা অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন তাদের অন্যতম ওয়াহিদুল হক এবং ড. সনজিদা খাতুন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে পহেলা বৈশাখ সরকারী ছুটি ঘোষণা করেন এবং এটাকে জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

মঙ্গল শোভাযাত্রা:

বাংলা নববর্ষকে বাঙালীর সার্বজনীন বৃহত্তম উৎসবে পরিণত করতে আশির দশকের শেষের দিকে সর্বপ্রথম চারুকলা ইনস্টিটিউটের নেতৃত্বে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। তখন সামরিক স্বৈরশাসন এবং মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জোরালো একটি মাধ্যম হিসেবেই মঙ্গল শোভাযাত্রার ধারণাটি সামনে আসে। শুভ-অশুভের প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপস্থাপিত হয় বিশাল আকৃতির অজগর, হাতি, বাঘ, টিয়া, পেঁচা, প্রজাপতি, কবুতর বিভিন্ন প্রাণীর প্রতীকী ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় স্থান করে নেয় বাঙালী ঐতিহ্যের লাঙল-জোয়াল, মই, চরকা, ঢেঁকি, পালকি, মাছ ধরার উপকরণসহ বস্তুগত সংস্কৃতির উপকরণাদি।

নববর্ষ ও অর্থনীতি:

সরকার নববর্ষের তাৎপর্য অনুধাবন করে নববর্ষ ভাতা প্রবর্তন করে। বাঙালীর জীবনে এটাই প্রথম সার্বজনীন অসাম্প্রদায়িক কোন উৎসবভাতা, যা সরকারী কর্মচারীদের দেয়া হচ্ছে। এই ভাতা ও নববর্ষের উৎসবের প্রস্তুতি এদেশের অর্থনীতিতে গুণিতক প্রভাব ফেলছে। পোশাক, জুতা, প্রসাধনী, মৃৎশিল্প, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী; মুখোশ, দেশী খেলনা, বাদ্যযন্ত্র, বাঁশি, ঢোল, প্লাস্টিক সামগ্রী শিল্পেকে গতিশীল করতে বিরাট অবদান রাখছে পহেলা বৈশাখ।

পরিশেষে:

আজও সেই পাকিস্তানের দোসরেরা সচেষ্ট রয়েছে বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎস পহেলা বৈশাখ ও বাঙালীর নববর্ষকে গলা টিপে হত্যার ষড়যন্ত্রে! সাবধান বাঙালী।

লেখক: ক্লিন এন্ড গ্রিন ফাউন্ডেশন ও গরিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :