‘রাশেদা রওনক খান আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব’

প্রকাশ | ১৪ এপ্রিল ২০২২, ২০:৫১

মো. শাহিন রেজা

লেখাটা শুরু করব হেনরি অ্যাডামসের একটি উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছেন- “শিক্ষকের প্রভাব অনন্তকালে গিয়েও শেষ হয় না"। আজ লিখব আমার জীবনের এমনই একজন সেরা শিক্ষক ও প্রিয় ব্যক্তিত্বকে নিয়ে যার মানবিকতা আমাকে প্রভাবিত করেছে তাঁর আদর্শ ধারণ ও চর্চা করতে।

রাশেদা রওনক খান, আমার প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় ব্যক্তি ও অভিভাবক। তিনি সর্বগুণে গুণান্বিত একজন অসাধারণ মানুষ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২৭তম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন তিনি। অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ছাত্র ছিলাম। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, এর কিছু দিন পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক পদে যোগদান করেন।

তিনি আমাকে সরাসরি ক্লাস রুমে পড়াননি, কিন্তু না পড়িয়েও প্রিয় শিক্ষক হলেন কিভাবে ? এটা বলার আগে পরিচয় পর্বটা বলে রাখি, তাঁর সাথে আমার পরিচয়টা বেশ কাকতালীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় আমি দেশ বিদেশের আপডেট খবরাখবর রাখতাম। সেই সময় একটা অনলাইন পত্রিকাতে 'প্রগতিশীল আমরা বনাম ওরা' শিরোনামে তাঁর একটা লেখা পড়েছিলাম। এখনো অব্দি আমার পড়া অন্যতম সেরা আর্টিকেল এটা। এর পর লেখকের সাথে যোগাযোগ করে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করি। কিছু দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দেখা হয়। প্রথম দিনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক লাউঞ্জে অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছিল। দেখা করতে যাওয়ার আগে পত্রিকাতে তাঁর অনেক লেখা পড়েছিলাম এবং ইউটিউবে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর  টকশো দেখেছিলাম। ফলে, আলাপের পরে যা বুঝতে পেরেছিলাম তা মোটাদাগে বলতে গেলে তিনি একজন মানবিক মানুষ। তাঁর সহমর্মিতা, মমত্ব, উদারতা, মুক্ত চিন্তা, শিক্ষার্থীবান্ধব মানসিকতা তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। এই গুণগুলির সাথে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মহৎ হৃদয়ের জন্য আমার চোখে তিনি এক মহান মানুষ, আমার প্রিয় ব্যক্তি ও শিক্ষক। আমার বিশ্বাস শুধু আমিই না তিনি তাঁর সকল শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয় শিক্ষক হিসেবে জায়গা করে নিতে পেরেছেন এইসব গুণের কারণে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে কোনো লেখা শেয়ার করা হলে কিংবা তাঁর শিক্ষার্থী ও পরিচিতজনদের সাথে আলাপ করলে বোঝা যায় তিনি কতটা মমতাময়ী শিক্ষক, বন্ধু, স্বজন।

নন্দিত এই শিক্ষক লেখক হিসেবেও মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষের সংখ্যা নগণ্য। আমার ধারণা,  সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ লেখা আমার মতো অনেক পাঠকেরা ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করেছেন। তিনি অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়াতে নিয়মিত লেখা লেখির সাথে বিভিন্ন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে দেশ বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর উপস্থাপনায় চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত "ফাস্ট মিনিস্টার ", "ফলোআপ : ফাস্ট মিনিস্টার", আকাশচুম্বী দর্শক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এছাড়াও "মুক্তিযুদ্ধের গল্প", "কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা" অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।

এবার শুধু শিক্ষক-ই নন, অভিভাবক হিসেবে আমার জীবনে তাঁর প্রভাব নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। তাঁর সাথে পরিচয়ের কয়েক মাস আগে আমার শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যায়। আমি জাহাঙ্গীরনগরে অধ্যয়নরত অবস্থা থেকেই শরীরিক ও মানসিক বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছি। ফলে বেশ সমস্যার মধ্য দিয়েই দিন পার করতে হচ্ছে আমাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি আশার আলো নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। আমার প্রতিটি বিপদে, খারাপ সময়ে মমতাময়ী মায়ের মত পাশে আছেন। পরিচয়ের প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও স্নেহের মাধ্যমে  আমাকে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। ফলে আমার জীবনে তাঁর অবদান অনেক বেশি। আমার প্রতি তাঁর আন্তরিকতা, প্রাঞ্জল হাসি, সুন্দর কথা এবং ভালো ব্যবহারের অসম্ভব একটা ক্ষমতা রয়েছে যা আমার জীবন বদলে দেওয়ার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।

রোকেয়া পদক প্রাপ্ত প্রফেসর জোহরা আনিসের মেয়ে রাশেদা রওনক খান শিক্ষক ও লেখক  ছাড়াও একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমাজ বিজ্ঞানী, গবেষক ও সংস্কৃতিমনা মানুষ। স্কুলজীবন থেকে তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। তাঁর কবিতা আবৃত্তি শুনে যে কেউ মুগ্ধ হবেন। নাচ ও গানের চর্চা করেছেন ছোট বেলা থেকেই। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে অগ্রভাগে থাকতেন সবসময়। এমনি শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে সংস্কৃতি চর্চা বেগবানে উদ্যোগী হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক সংগঠনের (জুডো) সাথে যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠনটি বিতর্কে বেশ কয়েকবার দেশের  সেরা স্থান অর্জন করেছে।

২০২১ সালের শেষ ভাগে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। গবেষণা কর্মেও তিনি মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। ঢাকা শহরের আরবান রাজনীতির ওপর তিনি গবেষণা করেছেন। গবেষণার স্থান নির্বাচন করেছিলেন ঢাকার কড়াইল বস্তি। দিনের পর দিন তিনি বস্তির মানুষের সাথে কথা বলেছেন। তাঁদের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনেছেন এবং সমস্যা সমাধানের বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী মতামত প্রদান করেছেন। কারণ মানব কল্যাণ-ই তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। মানুষের কল্যানের কথা বিবেচনা করে তাঁরা পরিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন "ফাতেমা কুদ্দুস ফাউন্ডেশন" যার সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন গুণীজন শিক্ষক রাশেদা রওনক খান। নিয়মিত অর্থ সহায়তা করে এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

মানবিকতার প্রতিচ্ছবি রাশেদা রওনক খানের নামের পাশে এমন অসংখ্য বিশেষণ যোগ করা যাবে।  আমার বিশ্বাস দেশের প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর মতো শিক্ষক থাকলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবেন। এমন অসাধারণ আলোকিত মানুষ যদি বাংলার প্রতিটি ঘরে জন্ম গ্রহণ করে তবে এ দেশ সোনার বাংলাতে পরিণত হতে খুব বেশি দেরি হবে না।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।