‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী মনিরুল’

প্রকাশ | ১৫ এপ্রিল ২০২২, ১১:৫৩

সুমন আজহার

লাশের পাশে ঘুমের ঔষধের খালি প্যাকেট আর একটা হাতে লেখা সুইসাইড নোট, ‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী মনিরুল।’ এস আই শরাফত আলী সুইসাইড নোট পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠালেন। লাশ পোস্টমর্টেম করার নির্দেশও দিলেন। কিন্তু দিনশেষে উনাকে সবচেয়ে অবাক করলো যে বিষয়টা, সেটা হলো লাশের পরিচিত কারো নামই মনিরুল না। না বন্ধুবান্ধব, না আত্মীয়স্বজন। লাশের নাম সুমন। যুবক ছেলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। সেই ইউনিভার্সিটিতে খোজ নিয়েও মনিরুল নামের কাউকে পাওয়া গেল না৷

সুমনের বাবা-মাও জানালেন, তারা এই নামে কাউকে চেনেন না। বা তাদের ছেলের সাথে পরিচয় ছিল মনিরুল বলে কারো, সেটাও তারা জানেন না। এরকম অদ্ভুত আত্মহত্যা কেস আগে কখনো পায়নি এস আই শরাফত। এটা মার্ডার না তো? কোনোভাবে সাজানো হয়েছে আত্মহত্যার মত করে। পুলিশকে বিশ্বাস করানোর জন্যই হয়তো সুইসাইড নোটে আন্দাজে কারো নাম লেখা হয়েছে৷

বিষয়টা আরো জট পাকালো, যখন এই ঘটনার দুই দিন পর আরো একটা কেস পাওয়া গেল ঠিক একই রকম। এবারে ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে গলায় দড়ি দিয়ে। লাশের পাশে সুইসাইড নোট। নোটে সেই একই কথা লেখা। ‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী মনিরুল।’

পুলিশের সন্দেহ এবার কোনো এক সিরিয়াল কিলারের প্রতি। পরপর একইরকম দুইটা সুইসাইড কীভাবে হয়। এমনকি এবারও যে মারা গেছে, সেই রাসেলের পরিচিত কেউ নেই মনিরুল নামে। এমনকি সুমন এবং রাসেলের মধ্যে কোনো কানেকশনও পাওয়া যায়নি। এরা একজন আরেকজনকে চিনতই না। তার পরও একইভাবে কেন সুইসাইড করলো?

কেস পুলিশের থেকে চলে গেল সরাসরি সিআইডির কাছে এবং এই কেসটা পারসোনালি বড় স্যারকে রিকোয়েস্ট করে নিজের হাতে নিয়েছেন সদ্য জয়েন করা এএসপি মনিরুল ইসলাম। নিজের নামটা সুইসাইড নোটের সাথে মিলে যাওয়াই তার আগ্রহের কারণ৷ ছোটবেলা থেকেই অনেক গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছেন মনিরুল। তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সিআইডি হওয়া। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তার ওপর জয়েন করার মাস দুয়েক যেতে না যেতেই এরকম রহস্যময় কেস! আর কী চাই! ভেতরে ভেতরে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করলো ও। তবে তার এই উত্তেজনায় আরো একটা পালক যোগ হলো ঠিক এক সপ্তাহ পর। এবার মিরপুর বারোর এক বাসায় পাওয়া গেছে বিজয় নামের এক হিন্দু যুবকের লাশ। সেই একই সুইসাইড কেস। বিষ খেয়েছে বিজয়। একই সুইসাইড নোট লিখে গেছে সে। ‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী মনিরুল।’

কে এই মনিরুল? কেন তার জন্য সবাই সুইসাইড করছে? কী এমন করেছেন তিনি? ভেবেচিন্তেও কোনো কুলকিনারা পায় না এই কেসের ইনভেস্টিগেশন অফিসার মনিরুল ইসলাম। তবে লাশ পরীক্ষার পর এবার এক নতুন মোড় নিল কেস। লাশের শরীরে পাওয়া গেছে একধরনের ড্রাগ। যেটা মানুষের চিন্তা ভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে।

তাহলে কেউ কি এই যুবকদেরকে ড্রাগ দেয়ার মাধ্যমে ইনফ্লুয়েন্স করছে সুইসাইড করার প্রতি? সেই লোকের নির্দেশেই তবে এরা এই অদ্ভুত সুইসাইড নোট লিখেছে? কিন্তু তাহলে প্রথম দুই লাশের শরীরে কেন এই ড্রাগ পাওয়া গেল না? তারা কেন ড্রাগ ছাড়াই আত্মহত্যা করলো? ভাবতে ভাবতে মাথার চুল পেকে যাওয়ার জোগাড় হয় মনিরুলের। কিন্তু কোনো কুলকিনারা পায় না৷

পুরো বিষয়টা আবার শুরু থেকে ভাবার চেষ্টা করে মনিরুল। এই তিনটা কেসের ভেতর একটা মিল আছে। তিনজনই যুবক ছেলে। একজনের বয়স পঁচিশ, বাকি দুইজনের সাতাশ। এদের একজন ছিল ভার্সিটির ছাত্র। একজন জব করতো একটা কোম্পানিতে। ছোটোখাটো পোস্ট। আরেকজন ছিল বেকার। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো সুমন আর রাসেল নেশা করত না কোনো। তবে বিজয় করতো। এই নিয়ে বিজয়ের বাসায় বেশ ঝামেলা হতো। এমনকি বিজয় বেকারও ছিল। নেশার টাকা জোগাড় করতে সে বাসা থেকে বিভিন্ন জিনিস চুরিও করতো।

রাসেলের মা জানালো তার ছেলে প্রেম করতো। বাকি দুইজনের পরিবার এ বিষয়ে কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু অনেক খুঁজেও শুধু যুবক হওয়া বাদে এই তিনজনের ভেতর আর কোনো মিল খুজে পেল না মনিরুল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টও সাফ সাফ বলছে এগুলো সুইসাইড। খুন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারো শরীরে জোর জবরদস্তির কোনো চিহ্নই পাওয়া যায়নি। কিন্তু ঢাকা শহরের তিন প্রান্তে থাকা তিনজন যুবক একই মানুষের নাম সুইসাইড নোটে লিখে আত্মহত্যা করতে যাবে কোন যুক্তিতে?

এতসব ভাবনার ভেতরে ঘটে গেল আরেকটা আত্মহত্যা। সেই একই যুবক ছেলে। নাম তন্ময়। বয়স ত্রিশ একত্রিশ হবে। সে আত্মহত্যা করেছে আট তলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে। কিন্তু তার ঘরে টেবিলের ওপরই পাওয়া গেছে সেই সুইসাইড নোট। তবে এই প্রথমবার সুইসাইড নোটে দুই লাইন বেশি লেখা। তাতে লেখা, ‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী মনিরুল। মা বাবা তোমরা ভালো থেকো। আমাকে মাফ করে দিও।’

বোঝা যাচ্ছে তন্ময় তার বাবা মা’কে বেশ ভালোবাসতো। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে ছিল সে এটাও কারণ হতে পারে। তন্ময়ের মা ঘটনার পর থেকেই অজ্ঞান। হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু এবার খুঁজে পাওয়া গেল মনিরুলকে। তন্ময়ের আপন বড় চাচা। মনিরুল হক।

ইনভেস্টিগেশন রুমে বসে প্রায় কেঁদে দিল বয়স্ক লোকটা। বললো, ‘বিশ্বাস করেন স্যার তন্ময়কে আমি কোনোদিন খারাপ কিছু বলিনি। আমি থাকি চট্টগ্রাম, ওরা ঢাকাতে। বছরে এক দুইবার দেখা হয়৷ আমি ওকে নিজের ছেলের মতই দেখি। আমার কোনো দোষ নেই! এমনকি গত তিনমাস আমার তন্ময়ের সাথে দেখাই হয় না। শেষ ফোনে কথা হয়েছে তাও দেড়মাস আগে।’

লোকটার হাবভাব দেখে মনে হলো সত্যিই বলছে। এএসপি মনিরুল ইসলামের ধারণা, তন্ময়ের বড় চাচার নামটা মিলে গেছে কাকতালীয় ভাবে। মনিরুল খুব কমন নাম। তার নিজের নামও মনিরুল। তার মানে তো এই না যে সে এদের সুইসাইডের পেছনে দায়ী। তাছাড়া এই বড় চাচা লোকটাকে সন্দেহ করা যেত যদি আগের ঘটনাগুলো না ঘটতো। আগের তিনজন যেহেতু মনিরুল বলতে অপরিচিত আর রহস্যময় কাউকে বুঝিয়েছে, সেহেতু তন্ময়ও তাই ই করবে।

সুমনের সুইসাইডের একমাস হয়ে গেছে প্রায়। এর মাঝে আরো তিনজন একইভাবে আত্মহত্যা করলো। অথচ এখনো এই কেস নিয়ে কোনো সন্তোষজনক ফলাফল ই পাওয়া যায়নি। ওপরমহল থেকেও প্রচুর চাপ আসছে। এর মাঝে পাঁচ নাম্বার সুইসাইডটা ঘটল। এই ছেলের বাসা আবার ঢাকার বাইরে। মুন্সিগঞ্জ সদরে। নাম আশিক। সেও মনিরুলের নামই লিখে গেছে সুইসাইড নোটে।

মনিরুলকে এই কেস থেকে অব্যহতি দেয়া হলো। নতুন এবং চৌকস অফিসার নিয়োগ দেয়া হলো। তাতেও কিছু হলো না। ছয় নাম্বার আত্মহত্যা আবার ঢাকাতেই ঘটল। ছেলেটার নাম জিসান। দেখতে খুব হ্যান্ডসাম ছিল ছেলেটা।

মনিরুল কখনো ভাবেনি তার প্রথম কেসেই ব্যর্থ হবে। নিজেকে আজকাল ওর খুব অপদার্থ মনে হয়। সারাদিন এই কেসটা নিয়ে ভাবে৷ কোনো ক্লু কি ওর মাথায় আসবে না? যদিও ও এখন আর এই কেসের দায়িত্বে নেই, কিন্তু মাথা থেকে জিনিসটা সরাতেই পারে না। এর প্রভাব তার ব্যক্তিগত জীবনেও পড়েছে। নতুন বিয়ে করা বউয়ের ওপর কথায় কথায় রেগে যায়৷ সারাদিন খিটমিট করে।

এই নিয়ে মনিরুলের বউ তিথীরও খুব মন খারাপ থাকে। বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল তার। বিয়ের পর বরের সাথে প্রেম করবে। অথচ তার পুলিশ অফিসার বর তাকে টাইমই দেয় না। একদিন রাতে মনিরুল বসে বসে ভাবছিল। তিথী এসে তার পাশে বসলো। বললো, ‘সারাদিন কি এতো ভাবো বলো তো!’

মনিরুল না সূচক মাথা নাড়লো। বললো, ‘বলা যাবে না তোমাকে। কেসের বিষয়ে আমি কারো সাথে কিছু শেয়ার করতে চাই না। এগুলো আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিক্রেট। তাছাড়া আমি এখন আর এই কেসে নেইও।’ ‘তাহলে সারাদিন এটা নিয়ে ভাবো কেন?’ ‘না ভেবে থাকতে পারি না। খুব রহস্যময় কেস। আমি কখনো এতো অদ্ভুত কিছু গল্প উপন্যাসেও পড়িনি। এর কোনো আগামাথা নেই ‘

এইবার আগ্রহী হয়ে ওঠে তিথী, ‘বলো না কী নিয়ে কেস৷ বলো না।’ ‘তুমি শুনে কি করবা।’ ‘কিছু করব না। খুব আগ্রহ হচ্ছে। প্লিজ বলো।’ ‘কারো সাথে শেয়ার করবা না তো?’ ‘না করব না। প্রমিজ।’ ধীরে ধীরে পুরো ঘটনা তিথীকে খুলে বলে মনিরুল। ছয়টা সুইসাইড, একই সুইসাইড নোট। শুনতে শুনতে হা হয়ে যায় তিথী৷ সেও এমন আজগুবি কেসের কথা শোনেনি স্বীকার করে।

রাতে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়েছে মনিরুল আর তিথী। কিছুক্ষণ বাদেই মনিরুলের হালকা নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসলো। কিন্তু তিথীর চোখে ঘুম নেই। তার কি উচিত সবকিছু মনিরুলকে খুলে বলা? তিথী ভেবে পায় না কী করবে। মনিরুল ওই সুইসাইড কেসের বর্ণনা দেয়ার সময়ই তিথী সব বুঝেছে। সে এই রাসেল, সুমন, বিজয়, তন্ময়, আশিক, কাউসার, জিসান, প্রত্যেককে চেনে। প্রত্যেকেই ওর এক্স বয়ফ্রেন্ড। একই সাথে অনেকগুলো প্রেম করতো তিথী। দুর্দান্ত সুন্দরী হিসাবে ও ছিল সবার জাতীয় ক্রাশ।

বিসিএস ক্যাডার মনিরুলের সম্বন্ধ আসার পর তিথী সবাইকে ছ্যাকা দিয়ে মনিরুলকে বিয়ে করে ফেলে। সেই কষ্টেই ছেলেগুলো আত্মহত্যা করছে। আহারে! অবশ্য তিথীর প্রেমে একবার পড়লে ওকে ভোলা এতো সহজ না। এমনই চিজ ও!

পরদিন অফিসে এসে মনিরুল শোনে আরেকটা লাশ পাওয়া গেছে উত্তরায়। সুইসাইডে একই নাম লেখা। মনিরুল অফিসের কোনো কাজে মন বসাতে পারেন না। সারাদিন বসে বসে শুধু একটা কথাই ভাবে। ‘সুইসাইড নোটে লেখা এই মনিরুলের পরিচয় কী? কে এই লোকটা?’

লেখক: সুমন আজহার, পুলিশ কর্মকর্তা

ঢাকাটাইমস/১৫ এপ্রিল/এএইচ