পাঁচটি বিশ্ব রেকর্ড পদ্মা সেতুর

প্রকাশ | ১৯ এপ্রিল ২০২২, ০৭:৪২ | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২২, ০৭:৪৮

মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকাটাইমস

প্রমত্তা খরস্রোতা পদ্মা নদী। তার ওপর সেতু! এক দশক আগেও এই স্বপ্ন ছিল অকল্পণীয়। তবে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে জাতির। সেই স্বপ্ন পূরণের রূপকল্পকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের অর্থায়নে তৈরি হওয়া এই সেতু এখন বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতার মূর্ত প্রতীক।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম। এই প্রকল্পে যুক্ত থাকতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন এই অভিজ্ঞ প্রকৌশলী। ঢাকা টাইমসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি পদ্মা সেতু তৈরির একদম শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নানা বিষয়ে কথা বলেছেন।

প্রশ্ন: পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজের টাকায় বাস্তবায়ন করার সাহসী সিদ্ধান্ত ও কৃতিত্বের কারণেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা সারা বিশ্বে আজ বিশ্বাসযোগ্য। এই প্রকল্পের পিডি হিসেবে প্রায় এগারো বছর ধরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন৷ এই চ্যালেঞ্জটা কেমন?

শফিকুল ইসলাম: যেকোনো কাজেই চ্যালেঞ্জ আছে। ছোট কাজে ছোট চ্যালেঞ্জ, বড় কাজে বড়। পদ্মাসেতুর মতো এত বড় প্রজেক্টে প্রথমেই আমাদের কাছে যেটা চ্যালেঞ্জ ছিল সেটা হল অর্থায়ন। বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেন নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করবেন। তো প্রথমেই সেই চ্যালেঞ্জটার মুখোমুখি হই।

সরকার আমাদের সাপোর্ট দিয়েছে। সরকার আমাদের কাছে তথ্য চেয়েছে আমরাও তথ্য দিয়েছি। আমরা বলেছি সেতুটি তৈরি করতে অনেক অর্থের দরকার। কিন্তু সেটি একদিনে বা ১ বছরে লাগছে না। অর্থ লাগবে ধাপে ধাপে। দিন দিন আমাদের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। তাই আমাদের নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব।

এরপরে চ্যালেঞ্জটি হলো টেকনিক্যাল। আমাদের ম্যানেজম্যান্ট দিয়ে এটা করতে পারব কি-না বা আমাদের ম্যানেজমেন্টে বিদেশি কট্রাক্টর আসবে কি-না। এদিকে বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে কি দেবে না দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগছিল। তাছাড়া আমরা যে নেতৃত্ব দেবো সেটি পারবো কি-না। এসমস্ত বহু চ্যালেঞ্জের সমুখীন হয়েছি। 

প্রশ্ন: দেশি বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে মাথা তুলে পূর্ণ রূপ পেয়েছে পদ্মা সেতু৷ এটি তৈরিতে যে টাকা ব্যয় হচ্ছে, তা ওঠাতে কতো বছর সময় লাগব?

শফিকুল ইসলাম: আমরা একটা আনুমানিক জরিপ করেছি। এতে ধারণা পেয়েছি, ২০-২৫ বছরের মধ্যে নির্মাণের ব্যয়কৃত টাকা উঠে আসবে। সেতু চালু হলে পদ্মার ওপারের বিশাল জনগোষ্ঠী নির্বিঘ্নে যাতায়াত করবে। কাচাঁমাল, সবজি বা অন্যান্য সবকিছু দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থানান্তর করা যাবে। এতে তৃণমূলের লোকজন সুবিধা পাবে বেশী।

প্রশ্ন: করে নাগাদ এই সেতু চালু চালু করতে পারবেন?

শফিকুল ইসলাম: এই বছরের জুনেই সড়ক পথ খুলে দিতে পারবো বলে আশাবাদী। আমাদের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। গত বছরের ২৩ আগস্ট সেতুতে শেষ রোড স্ল্যাব বসানো হয়েছে। এরপর সেতুটি মাওয়া-জাজিরা সড়কপথে সংযুক্ত হয়। সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে এখন চলছে শেষ পর্যায়ের কর্মযজ্ঞ।
মূল সেতুর কাজ, সেতুতে কার্পেটিং, ভায়াডাক্টে কার্পেটিং, ওয়াটারপ্রুফিং ওয়ার্ক, গ্যাসের পাইপলাইন, ল্যাম্প পোস্ট এবং দুই পাড়ে দুটি বিদ্যুৎ সাবস্টেশন সব কাজই প্রায় শেষ। পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ এখন চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে জুন মাসেই পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।
প্রশ্ন: চালু হলে প্রতিদিন কি পরিমান যানবাহন চলাচল করবে পদ্মা সেতু দিয়ে?

শফিকুল ইসলাম: এটা আনুমানিক একটা জরিপ করা হয়েছে। তবে এখন যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে সেতু চালু হয়ে গেলে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি চলাচল করবে। তাছাড়া ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটি ওদিকে দিন দিন বাড়ছে। ওদিকে বন্দর হচ্ছে। তখন অনেক যান চলাচল করবে। সঠিকভাবে এখন বলা যাবে না ঠিক কত গাড়ী চলবে।

প্রশ্ন: প্রযুক্তি উৎকর্ষতার একটা দারুন সময়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু৷ এখানে আধুনিক কি কি প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হয়েছে, যা এই সেতুকে অনন্য এবং বিশ্বমানের করে তুলবে?

শফিকুল ইসলাম: পদ্মা সেতু শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় পুরো বিশ্বের জন্যই একপ্রকার রোল মডেল। প্রবল স্রোতের এই পদ্মায় সেতুটি তৈরি করতে আমাদের অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে। সবকিছুতেই আধুনিক মানের সব ব্যবহার হয়েছে।

পাচঁটি বিশ্বরেকর্ডও করেছে এই সেতু। সর্বাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে এটির নির্মাণে। খরস্রোতা পদ্মায় ব্রিজ নির্মাণে এক্সপার্টদের ভাষ্য, পানি প্রবাহ বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরেই এর অবস্থান।

মাটির ১২০ থেকে ১২২ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো এই রেকর্ডের অন্যতম। পৃথিবীর অন্য কোথাও কোনো সেতুতে পাইল এতো গভীরে প্রবেশ করাতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্ব রেকর্ড হল, পিলার এবং স্প্যানের মাঝে যে বেয়ারিং থাকে সেটি। এখানে ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বেয়ারিং ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীতে এর আগে এমন বড় বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি কোনো সেতুতে।

তৃতীয় রেকর্ড নদী শাসন। ১৪ কিলোমিটার (১.৬ মাওয়া+১২.৪ জাজিরা) এলাকা নদী শাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এই নদী শাসনে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি।

পরের রেকর্ডটি ব্রিজে ব্যবহৃত ক্রেন। পিলারের ওপর স্প্যান বসাতে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি আনা হয়েছে চীন থেকে। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুণতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে প্রথম এই ব্রিজটি বানাতেই এতো দীর্ঘ দিন ক্রেনটি ভাড়ায় থেকেছে। এই ক্রেনটির বাজার দর ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আরেকটি রেকর্ড পদ্মা সেতুই বিশ্বে প্রথম যেটি কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে।

প্রশ্ন: পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্মাণকাজের পুরোটা সম্পন্ন হয়েছে আপনার তত্ত্বাবধানে। বড় স্থাপনা নির্মাণে আপনার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং সততার জন্য আপনি প্রশংসিত। কীভাবে দেখছেন?

শফিকুল ইসলাম: পদ্মা সেতুর প্ল্যানিং হওয়ার প্রথম থেকেই আমি এর সঙ্গে যুক্ত। দেশের জন্য এত বড় কাজে যুক্ত হতে পারার এই সৌভাগ্য আমাকে সৃষ্টিকর্তা দান করেছে। অবশ্যই আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। দেশের এত বড় একটা কাজে আমার সম্পৃক্ততা প্রথম থেকেই। আমার পক্ষ থেকে আমি আমার সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার এই ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতাও আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় বঙ্গবন্ধুকন্যা আমার ওপর আস্থা রেখেছেন। আমি চেষ্টা করেছি। এখন এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। কাজের মূল্যায়ন দেশের জনগণই করবে।

প্রসঙ্গত, শফিকুল ইসলাম ২০১১ সালের নভেম্বরে পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। অবসরে যাওয়ার পর ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর তাকে চুক্তিভিত্তিক ওই পদে রাখা হয়। আরও কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে অবসরপ্রাপ্ত এই প্রকৌশলীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/১৯এপ্রিল/ডিএম)