জীর্ণশীর্ণ সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত, এখন তাকে চেনাই দায়!

প্রকাশ | ২৬ এপ্রিল ২০২২, ২১:২১ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২২, ১৬:১৬

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস

জীর্ণশীর্ণ শরীর, শুকিয়ে এমন হয়ে গেছেন যে চেনাও দায়। কথা বলতে পারেন না। সহজে কাউকে চিনতে পারেন না। মুখে খাবার খেতে পারেন না। নাকে নল দিয়ে খাওয়ার কাজ চলছে। কথাগুলো যাকে নিয়ে বলা হচ্ছে তিনি আওয়ামী লীগের গত দুই মন্ত্রিসভার বর্ষীয়ান সদস্য ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত।

গুরুতর অসুস্থ সাবেক এই অর্থমন্ত্রী হাসপাতাল থেকে বনানীর বাসায় এই অবস্থায় দিন কাটছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত দুইবারের অর্থমন্ত্রী আবদুল মুহিত সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।

তার হাত ধরেই সিলেট নগরীর উন্নয়নের আমুল পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ খাতকে প্রাধান্য দিয়ে নিরলসভাবে নিজ এলাকার উন্নয়নে কাজ করেছেন। বার্ধক্যের কারণে সবশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হননি। রাজনীতি থেকে চলে যান অবসরে। যদিও দেশে এমন ঘটনা বিরল।

এরপর থেকে অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে যাওয়া সাবেক ডাকসাইটে এই কূটনীতিক নীরবে নিভৃতে বনানীর বাসায় সময় কাটাতেন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর পাশাপাশি বইও লিখেছেন শুরুর দিকে। মাঝেমধ্যে কিছু অনুষ্ঠানে দেখা যেত।

কিন্তু ২০২০ সালে দেশে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর নিজেও আক্রান্ত হন। সেই থেকে শুরু। এখনো করোনা পরবর্তী ধকল কাটেনি। সঙ্গে নানা অসুস্থতা যুক্ত হওয়ায় অনেকদিন হাসপাতালের বিছানায় কেটেছে। বাসায় ফিরলেও সেইভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি।

গত বছরে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে অনেকটা শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন বয়সের কোটা ৯০ ছুঁইছুঁই মুহিত। ওই বছরের ২৯ জুলাই তাকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। পরে তিনি করোনামুক্ত হয়ে সেখান থেকে বাসায় ফিরেন। তখন থেকে শারীরিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েন প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ।

মাঝে একবার তার মৃত্যু নিয়ে গুজবও ছড়ায় অসাধু মহল। হাসপাতালের বিছানায় শোয়া তার কাহিল দেহের ছবি দেখে তখন তার ভক্ত-অনুরাগীরা ভেঙে পড়েন। অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবেই তার পরিবারের পক্ষ থেকে গুজবের বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়।

তবে জীবন সায়াহ্নে এসেও নিজের পিতৃভূমি সিলেটে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল এই প্রবীণ রাজনীতিক। সম্প্রতি ছোট ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের কাছে জানান তার ইচ্ছার কথা। আবদার করেছেন তাকে যেন সিলেট নেয়া হয়।

এদিকে নিজে যেমন এলাকার মানুষের জন্য টান অনুভব করেন, তেমনি সিলেটের সর্বস্তরের মানুষও তাকে ক্ষণেক্ষণে স্মরণ করে। যার প্রমাণ সবশেষ গত ১৬ মার্চ সিলেট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে দেওয়া হয় ‘গুণীশ্রেষ্ঠ সম্মাননা’।

পরিবারের সদস্যরা বিমানযোগে তাকে সিলেট নিয়ে আসার পর তাকে দেয়া সম্মাননা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ইংরেজি সাহিত্যের অসামান্য অনুরাগী মুহিত। অনুষ্ঠানে সিলেটের সাধারণ মানুষও উপস্থিত হয়ে তাদের প্রিয় মুহিত ভাইকে ভালোবাসা জানান।

সিলেট নগরের কিনব্রিজ এলাকার চাঁদনীঘাট এলাকায় এ অনুষ্ঠানে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ সংবর্ধিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায় শোনান তাঁর জীবন ও পরিবারের গল্প।

অবশ্য মাঝেমধ্যে কথায় খেই হারিয়ে যাওয়ার পর নিজেই বক্তব্যে বলেন, ‘মাঝে মাঝে শব্দ পেতে ভুল হয়ে যায়, বয়স হয়তো তার জন্য যথেষ্ট দায়ী।’

বক্তৃতায় আবুল মাল আবদুল মুহিত বক্তৃতায় নিজের জীবনকে ‘মহাতৃপ্তি আর মহাপ্রাপ্তির’ বলে উল্লেখ করেন। বক্তব্যে তিনি সিলেটের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসঙ্গও এনেছেন।

মুহিত বলেন, ‘আমি একান্তভাবে সিলেটের সন্তান। নিজের পিতৃভূমিতে আমি অতিথি, এটা গর্বের বিষয়। নিজের মূলে এসে এমন সম্মান পাওয়া, এমন স্বীকৃতি পাওয়া আমার জন্য আনন্দের।’

এদিকে বড় ভাইয়ের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সবার কাছে দোয়া চান। পাশাপাশি ভাইয়ের শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও সম্প্রতি কথা বলেন মন্ত্রী। বলেন, ‘তার কোনো রোগ নেই, তবে শারীরিকভাবে তিনি খুব দুর্বল। খাওয়ার ওপর কোনো আগ্রহ নেই উনার। উনি অনেকদিন কিছু খান না। ফলে ওজন কমে গেছে। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন।’

সবশেষ গত ২৩ এপ্রিলও সিলেট সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসন আয়োজিত ইফতারেও বড় ভাইয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এক নজরে আবুল মাল আবদুল মুহিত

১৯৩৪ সালে সিলেটে জন্ম নেয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, ভাষা-সৈনিক। অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ ও সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী দম্পতির দ্বিতীয় ছেলে তিনি। তার মাও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।

ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী মুহিত ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাশ করেন। চাকুরিরত অবস্থায় তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস-এ (সিএসপি) যোগদানের পর মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে তিনি পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন।

মুহিত পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চীফ ও উপ-সচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন।  পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এই বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন।

ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১-এর জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন।

১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউণ্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২-৮৩ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।

লেখক হিসেবে মুহিত সমান পারদর্শী। প্রশাসনিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তার ২১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে তিনি একজন পথিকৃত এবং বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি মুহিত আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি ১২টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন, যার ১০টি আওয়ামী লীগ সরকার আমলের।

(ঢাকাটাইমস/২৬এপ্রিল/বিইউ/ডিএম)