ভারতে যাননি খান আলতাফ হোসেন ভুলু

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১৪:৪৮

পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণে দুপুরের আগেই বরিশাল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। এদিকে গানবোট থেকে একের পর এক শেল নিক্ষেপ করতে থাকে হানাদার বাহিনী। বলা হয়, চরবাড়িয়া-শায়েস্তাবাদে অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কেবল এই শেলের আঘাতে। তখন কেউ মাঠে, কেউ ঘরে। কোনো কিছু বুঝতে না বুঝতেই একেকটি গোলার আঘাতে একাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, প্রাণ গেছে গবাদিপশুরও।

সাংবাদিক গোপাল সরকারের মতে, গানবোট থেকে অন্তত একশ থেকে দেড়শ শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। বিকট শব্দের এ শেলের কারণে গোটা এলাকা কেঁপে কেঁপে উঠেছে। শহরও তখন কেঁপেছে। পাকবাহিনী প্রবেশের আগেই শহরের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পুরো শহর খালি হয়ে যায়। গোপাল সরকারের উচ্চারণ, ‘শহরের রাস্তায় একটি কুকুরও ছিল না।’

একের পর এক মর্টার শেলে বারবার কেঁপে ওঠা এবং পাকবাহিনী প্রবেশের আশঙ্কায় বরিশাল শহর ছেড়ে সাধারণ মানুষ ছুটেছে গ্রামের দিকে। অধিকতর গ্রামের দিকে ছুটেছে শহরতলির মানুষ। আর রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সিংহভাগই ধরেছেন ভারতে যাবার পথ। এ ক্ষেত্রে প্রধান গন্তব্য ছিল নবগ্রাম রোড হয়ে ঝালকাঠি। কেউ গেছেন সাগরদী হয়ে ঝালকাঠির দিকে। লক্ষ্য ভারত। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজন যারা ভারতের পথ ধরেননি তাদের মধ্যে অন্যতম খান আলতাফ হোসেন ভুলু।

এ ব্যাপারে খান অলতাফ হোসেন ভুলু বলেন, বাদশা নামে পুলিশের এক কর্মকর্তা মহিলা কলেজের এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করতেন। তখন সম্ভবত তাদের সদ্য বিয়ে হয়েছে, অথবা তখনো হয়নি। দেখলাম সিএন্ডবি চৌমাথা দিয়ে বাদশা মিয়া তার স্ত্রী অথবা প্রেমিকা নিয়ে জিপে করে পশ্চিম দিকে যাচ্ছেন। তাকে থামিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। তার সঙ্গে অস্ত্র ছিল। আমার সঙ্গেও অস্ত্র ছিল। জিপে করে আমরা কালিজিরা নদী পর্যন্ত যাই। সে সময় গাড়ি নিয়ে নদী পার হবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে এ তীরে অনেক জিপ-পিকআপ পরিত্যক্ত ছিল। নৌকায় কালিজিরা নদী পার হয়ে অনেক দূর হেঁটে রাতে ঝালকাঠির আওয়ামী লীগ নেতা আক্কাস আলীর বাড়িতে আশ্রয় নেই। রাত কাটিয়ে ভোরে নিজ এলাকা বাকেরগঞ্জের দিকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা করি। এ পথে নদী পার হতে হয়েছে তিনটি। সেই নদীগুলোর এখন আর আগের রূপ নেই। ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যা নাগাদ বাকেরগঞ্জ পৌঁছেছি।

পাকবাহিনীর আক্রমণের মুখে নেতারা যখন ভারতের পথে তখন বিপরীতমুখী হবার কারণ প্রসঙ্গে খান আলতাফ হোসেন ভুলু বলেন, আমি বিপ্লবীদের জীবনী পড়েছি। তাদের ক্ষেত্রে নিজের মাটি ছেড়ে পলায়ন প্রাধান্য পায়নি। নিজের মাটিতে থেকেই প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার ধারা অনুসরণ করে আসছেন বিপ্লবীরা। আর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের যে নির্দেশনা তাতে যার যা আছে তা নিয়ে শত্রুকে মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে, পালিয়ে যেতে বলা হয়নি। সব মিলিয়ে আমি নিজ এলাকায় থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলাকে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করেছি এবং বাকেরগঞ্জে শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছি। সপ্তাহখানেকের মধ্যে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ এ বাহিনী দাঁড়িয়ে যায়। এর নামকরণ করা হয় আমার নামে, ‘ভুলু বাহিনী।’

শেষের দিকে এ বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫শ। এর সামরিক প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন নাসির। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয় আমার বাড়ি গোমায় কৃষ্ণকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ক্যাম্প স্থানান্তরিত হয় চরাদী ইউনিয়নের গোপালপুরে। কিছুদিন পর ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়া হয় পাদ্রিশিপপুর মহেশপুর হাইস্কুলে। পরে জমিদার নাটু বাবুর অনুরোধে ক্যাম্প শ্যামপুর হাইস্কুলে নেওয়া হয়। এদিকে দক্ষিণবঙ্গের হেড কোয়ার্টার স্থাপিত হয় পাদ্রিশিপপুরে। সেই সময় ওই এলাকা ছিল একেবারেই প্রত্যন্ত অঞ্চল।

জানা যায়, জমিদার নাটু বাবু শ্যামপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপনের অনুরোধ করেছিলেন রাজাকারদের হাত থেকে তার নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে। কিন্তু তিনি নিরাপদে থাকতে পারেননি। রাজাকার চক্র তাকে হত্যা করে। তবে তা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নয়, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৭৩ সালের ১০ অক্টোবর তাকে হত্যা করা হয়। অনেকেই বলেন, এই খুনের পরিকল্পনা হয়েছিল জেলখানায় বসে। আর এ খুনের অপরাধে কারও কোনো সাজা হয়নি বরং সেই সময় রটিয়ে দেওয়া হয়, সম্পত্তির লোভেই স্থায়ীভাবে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। তখন জমিদারের তিন সন্তানই ছিল নাবালক।

খান আলতাফ হোসেন ভুলু জানান, রাজাকারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাকেরগঞ্জে মুক্তিবাহিনী একাধিক অপারেশন করেছে। আর পাকবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধও করেছে। এর মধ্যে শ্যামপুর ক্যাম্প আক্রমণ এবং বাকেরগঞ্জ থানা দখলে দুর্ধর্ষ যুদ্ধ হয়েছে। তিনি জানান, পাকবাহিনী শ্যামপুর ক্যাম্প আক্রমণ করে ১৪ নভেম্বর। এ সময় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। সারারাত চলা এ যুদ্ধে তিনজন মুত্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৩১ জন পাক সৈন্য নিহত হয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে পরদিন হানাদার বাহিনী এলাকায় ব্যাপক গণহত্যা চালায়। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। সেদিন অন্তত একশ মানুষ পাকিস্তানিদের গুলিতে নিহত হয়।

বাকেরগঞ্জ থানা দখল প্রসঙ্গে খান অলতাফ হোসেন ভুলু বলেন, এই থানা রক্ষায় শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। বাংকার তৈরি করা হয়েছিল সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো। এ ছাড়া আরও অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল যা সাধারণত যুদ্ধ চলাকালে সীমান্তে বিওপিতে করা হয়। সেখানে ইপিআর ছিল প্রায় দুইশ। এসব বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েই বাকেরগঞ্জ থানা দখলের পরিকল্পনা করা হয়। এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধে বরিশালের ইনচার্জ হিসেবে মেজর শাজাহান ওমর এবং থানার ইনচার্জ হিসেবে ক্যাপ্টেন নাসির। থানা দখলের এ যৌথ অভিযান শুরু হয় ৪ ডিসেম্বর। একটানা চলে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। চারদিনের মাথায় মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করতে সক্ষম হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষের ইপিআর-পুলিশ-রাজাকার মিলিয়ে তিন-চারশ জন নিহত হয়। এদিকে তৎকালীন বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদকসহ শহীদ হন ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধশেষে দেখা গেল, মালেক ওসি ছাড়া আর কোনো পুলিশ সদস্য গুলি ছোড়েননি। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে মালেক ওসি ও শাহু রাজাকারকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় বলে জানান খান আলতাফ হোসেন ভুলু।

খান অলতাফ হোসেন ভুলু জানান, জুন মাস নাগাদ বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশাল শহরে সরবরাহ চেইন কাটআপ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে খবর এলো, একজন রাজাকার কমান্ডার ৫-৬টি নৌকা বোঝাই করে চাল-ডাল-মুরগি-খাসি নিয়ে বরিশাল শহরে যাচ্ছে। দ্রুত মুভ করে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে আটক করে। তাকে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ‘জয়বাংলা’ বললে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সে রাজি হচ্ছিল না। ‘জয়বাংলা’ বলতে বাধ্য করার জন্য এক পর্যায়ে তাকে পিটানো শুরু হয়। কিন্তু কিছুতেই সে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা মানেনি। অনবরত পিটানোর ফলে তার জীব বেরিয়ে আসে। মানুষের জীব এত বড় হয় তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু তবুও সে ‘জয়বাংলা’ বলেনি। এক পর্যায়ে সে মরে যায়।

খান আলাতাফ হোসেন ভুলু এই রাজাকার কমান্ডারের নাম স্মরণ করতে পারেননি। কিন্তু অন্য সূত্রে জানা গেছে তার নাম-ধাম-পরিচয়; সবকিছু। আরও জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহারে নিহত রাজাকার কমান্ডারের তিন সন্তান মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাচ্ছেন। এদের মধ্যে একজন রক্ষীবাহিনীতেও চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলেন। তার অত্যাচারের কাহিনি এখনো বাকেরগঞ্জের মানুষের মনে ভয় জাগিয়ে দেয়!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :