গল্প

কর্পূর পুরুষ

রোখসানা ইয়াসমিন মণি
| আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১৬:০৯ | প্রকাশিত : ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১৫:২০

বিলুর মেজাজ ইদানীং বিগড়ে থাকে। সবার সঙ্গে সুযোগ পেলেই চোটপাট করে। শেফালী বেগম এটা পছন্দ করেন না। এমনকি সাবের হোসেনও না। সাবের হোসেনের চার মেয়ের মধ্যে বিলু বড়। মেজ মিলু সেজ নিলু আর ছোট মেয়ে দিলু। বিলু আর মিলুর বিয়ে হয়ে গেছে। নিলু কলেজে পড়ে আর দিলু প্রাইমারিতে। রিটায়ার সাবের হোসেনের ছেলে নেই। এই নিয়ে শেফালী বেগমের আক্ষেপের অন্ত থাকে না। বিলুর সঙ্গে পেরে না উঠলে খোঁচা মারেন, শেষ বয়সে এসে মেয়েদের কামড় সহ্য করতে হয়! এ-ও ছিল কপালে? কেন খোদা আমারে একটি ছেলে দিল না? আজ ছেলে থাকলে মায়ের দুঃখ বুঝত। গায়ে পড়ে মেয়ের কথা শুনতে হতো না।

বিলুও কম যায় না। এসব শুনে বলে, ছেলেদের হাতে স্বর্গের টিকিট থাকে। দেখো না রমিজ কাকার তিন ছেলে। মা-বাবারে কী সুন্দর স্বর্গে রেখেছে। আহা! ছেলের কাছে মা-বাবার কত শান্তি। খোঁচা শুনে শেফালী বেগম চুপসে যান। রমিজ হলো সাবের হোসেনের ভাই। তার তিন ছেলে। বড় ভাইয়ের চারটি মেয়ে। কত আফসোস করেন। আহা! একটি মেয়ে তার হলে এমন কী ক্ষতি হতো? তিনটি ছেলেই হতে হবে? এক বাগানে একটি ফুল ভালো লাগে? আক্ষেপ করেই শেফালী বেগমকে রমিজ বলে, ভাবি, আমার যদি একটি মেয়ে থাকত! বিলুর মতো। তাহলে আর এত কষ্ট পাই বলেন? পোলাগুলো এক্কেরে খাস জাউরা হইছে। একটাও মানুষ হইলো না। মেয়ে হইতো সব। কী শান্তিতে থাকতে পারতাম। আপনার সুখ দেইখা মনে মনে শ্বাস ফালাই । শেফালী বেগম রমিজের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝামটি মেরে বলে, হ সুখ! চোক্ষে তোমার ছানি পড়ছে। দেখো না আমার সুখ টেবাইয়া টেবাইয়া পড়তে আছে? ভান্ড নিয়া আসো। টেবাইয়া পড়ার আগে ভান্ডে তুইলা দিমু। রাতে শুইয়া জামাই-বউ দুইজনে মিল্লা খাইও। বুঝবা সুখ খাইতে কত আরাম। রমিজ কথা বাড়ায় না। বুঝে শেফালী বেগমের চান্দি গরম হয়ে আছে।

বিলুর ডিভোর্স হলো তিন বছর। ডিভোর্সের পর বসে থাকতে হয়নি। মেধার জোরে একটি চীনা কোম্পানিতে চাকরি হয়ে গেছে। বাবার বাসায় থাকে। মিলু শ্বশুরবাড়িতে ভালো আছে। শাশুড়ি একটু ঝালাপালা টাইপের হলেও অয়নের ভালোবাসার কমতি নেই মিলুর জন্য। ওরা চার বোন সুন্দরী। তবে বিলু মাত্রাতিরিক্ত। কিছু সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। এদের শুধু চেয়ে দেখতে হয়। বলে বোঝাতে গেলে কম হয়ে যায়। একমাত্র চোখের ভাষা সেসব সৌন্দর্য বর্ণনা করতে পারে। এসব বর্ণনা আবার লেখা যায় না। অতএব বিলুর সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা অসম্ভবের কাজ। বিলুর জব চীনা কোম্পানিতে। সারাক্ষণ মেইল, নোটবুক, ড্রাফট, মিটিং, ডেলিগেটর ম্যানটেইন করা, মিটিং এখানে-সেখানে- দৌড়ের মধ্যে থাকতে হয়। ভোর হলেই কাজ শুরু। নিজেকে গোছানো, মাকে কিচেনে হেল্প করা, বোনদের খেয়াল রাখা, বাবার ওষুধ, অসুখ, মিলুর শ্বশুরবাড়িতে এট-সেটা পাঠানো, বিভিন্ন পার্বণে ওদের ফ্যামিলিকে দাওয়াত করা, হাটবাজার সব শেষে নিজের অফিস। এসব সে খুব দ্রুত করে। দম ফেলার সময় নেই। ক্ষীপ্রগতির মেয়ে। মেইল ট্রেনের মতো। কোনো কাজে ছাড় দিতে নারাজ। যেটা করবে খুব মনোযোগ আর নিষ্ঠা নিয়ে করবে। কাজে খুঁত রাখা পছন্দ করে না। পারফেক্টলি চাই সব। এই পারফেকশনিস্ট হতে গিয়ে জীবনকে যন্ত্র করে ফেলেছে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা কখনো এগারোটা বেজে যায়। ক্লান্তশ্রান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে রুম অন্ধকার করে চোখ বুজে থাকে। এতটুকুই তার বিশ্রাম। তারপর ধীরে ধীরে উঠবে। মা-বাবার কাছে বসবে। বোনদের রুমে গিয়ে দেখে আসবে। কে কী করছে। পড়ালেখার খোঁজ নেবে। টিচাররা এলো কি না, পড়া ঠিকমতো দেয় কি না, নীলু কলেজে গিয়েছে কি না, দিলুর স্কুলের খোঁজখবর নিয়ে রুমে আসে। এরপর বালিশে হেলান দিয়ে জাস্টিন বিবারকে মনোযোগ দিয়ে শোনে। মা তখন চুপে চুপে বক্সখাটের ছাউনির ওপর চা আর হালকা স্ন্যাক্স রেখে যায়। মেয়েকে শেফালী বেগম তখন কিছু বলেন না। ওই একটি সময় মা- মেয়ে চুপ থাকে। তখন বিলুর মেইল ট্রেনের ইঞ্জিন আউটারে চলে যায়। রাতের এই দিক বিলু নিজের ভেতর গুটিয়ে পড়ে। তখন জীবন থেকে একটি ব্যস্ত দিন খসে পড়ে ভেবে অবাক হয়। গান শুনতে শুনতে ভাবে কত লং জার্নি করে এলো সে। জীবন নাকি ছোট। কে বলেছে এই কথা? এটা একদম ডাহা মিথ্যা কথা। যে বলেছে তার জীবনে কোনো গতি নেই। সে আলসে কেউ। শুয়েবসে জীবন কাটানো মানুষগুলোর কাছেই জীবন ছোট মনে হয়। ভোর থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত ছুটে চলা মানুষ জানে জীবনের মানে কী? বিলু চোখ খুললেও কাজ দেখে, বন্ধ করলেও কাজ দেখে। কাজ আর কাজ। জীবনটা কাজময়, নাকি কারুকাজময়।

বিলু আলসে আর ঢিলা লোকদের পছন্দ করে না। বিশেষ করে হাজেরার মাকে সে সহ্যই করতে পারে না। ওদের বাসার পারমানেন্ট বুয়া। এত স্লো আর লুজার যে, সে যখন একটি আলু কাটে, বিলুর তখন পাঁচটি হয়ে যায়। একটি ডিমপোচ করতে দিলে খাওয়ার আশা বাদ দিয়ে বিলু তখন নিজেই নিজেরটা করে নেয়। বিলুর সকালের নাশতা একটি রুটি একটি ডিম আর এক কাপ চা। এটি করতে গিয়েও হাজেরার মায়ের ছয় মাসে দিন পেরোয়। মেজাজ খিটিমিটি করে বিলু তখন চিল্লায়, ওই ঢিলাবিবি চা দিবা নাকি আমার চাকরি খাবা?

বাসায় তোড়জোড় তখন। শেফালী বেগমের বাতের ব্যথায় কঁকিয়ে কোনোরকম কিচেনে আসেন। মেয়ের জন্য চা-রুটি করতে গিয়ে হয় রুটি পুড়ে ফেলেন, না হয় চায়ে কোনো দিন লিকার বেশি দিয়ে ফেলেন বা কখনো চা-পাতা কম দেন। বিলু তখন খেয়ে না খেয়ে মেজাজ খিঁচতে খিঁচতে বেরিয়ে পড়ে। এ রকম করে হাঁপাতে হাঁপাতে অফিসে পৌঁছে। রুমে ঢুকেই পিয়ন হানিফকে কফির অর্ডার দিয়ে কাজে বসে। কফি অপছন্দ বিলুর। তবু না পারতে কয়েক ঢোঁক গিলে রেখে দেয়। বুকের ভেতর চায়ের তৃষ্ণা। সময় পেলে বাসায় বানিয়ে নিজেরটা নিজে খেয়ে বের হয়। আর যেদিন না পারে, সেদিন চায়ের তৃষ্ণায় ছটফট করে। এই চায়ের তৃষ্ণা জমতে জমতে মেজাজ বিগড়ে যায়। সকাল বেলার তৃষ্ণা বলে কথা। মেটে না বলে দিনটা অপূর্ণ কাটে। বিলু বোঝে চা কত গুরুত্বপূর্ণ তার জীবনে। বাসার সবার কাছে সময় মানে আঠারো মাসে বছর। সবাই হাজেরার মায়ের মতো ঢিলা হয়ে গেছে।

বিলুর আন্ডারে চারজন জুনিয়র অফিসার আছে। ওরা তটস্থ থাকে সব সময়। বিলুর গতি ট্রেনের চেয়েও দ্রুত, ক্ষিপ্রতা কম্পিউটারের চেয়েও মারাত্মক। ফাইল আর ডকুমেন্টস এমনভাবে তৈরি করে স্বয়ং ওর বসও চমকে ওঠে। বিলুর গোছানো কাজ, কাজের প্রতি সিনসিয়ারের কারণে দুজন সিনিয়রকে টপকে যখন ইনক্রিমেন্ট পেয়ে যায়, তখন অফিসে হইচই। বস খুশিতে গদগদ হয়ে একদিন পার্টি দিয়ে বসে। সেদিন সবাই একটু আবেগাক্রান্ত হয়ে বলেই ফেলে, বিলু ইজ দ্য মাস্টার অব দেয়ার বস! আর যায় কই। পরদিন বিলু এমন সব নথি তৈরি করে কোম্পানির সব এমপ্লয়ির দৌড় গেল বেড়ে। রাস্তায় ছুটে কেউ টাইয়ের গিট্টু বাঁধে, কেউ রিকশায় বসে নাশতা সারে, কেউ তো অফিসের চেয়ারে বসে জুতোর ফিতে লাগায়।

সোবহান সাহেব বিলুর এক ধাপ ওপরে, একদিন এসে বলেন, বেশ দেখাচ্ছ।

বিলু জবাব না দিয়ে কাজ করছে দেখে আবার বলেন, তুমি খুব স্মার্ট মেয়ে। বসকে গিলে ফেলেছ।

বিলু ঘাড় না তুলেই বলল, ফর্মুলা নিয়ে যান। আর আপনিও গিলুন।

-আমার ফর্মুলা কি তিনি ধরবেন?

-ধরবেন।

বিলু চোখ কটমট করে তাকিয়ে বলে, কাজে যান সোবহান সাহেব। কাজ করাটাই ফর্মুলা। বাঁচার বেটার ফর্মুলা হলো কাজে ডুবে থাকা। সোবহান সাহেবের কথা আর সামনে এগোয় না। বিলু বুঝে, আলাপের জন্য না, এই লোকটা আসে বিলুকে ত্যক্ত করার জন্য।

বিলুর চায়ের তেষ্টা প্রবল ঠেকছে। নাহ, অফিসে চায়ের সরঞ্জামাদি রাখতে হবে। কাজে মন দেওয়া যায় না। বসকে বলতে হবে। অন্তত তার রুমে যেন চায়ের ব্যবস্থা করা হয়। স্যারের সঙ্গে দেখা করার জন্য বিলু ওঠে। যেতে পথেই পাশের কর্নার থেকে দুনিয়া কাঁপানো হাসি শুনে থমকে দাঁড়ায়। কে হাসে অমন করে? গলা উঁচিয়ে দেখে আকাশি রঙের ফুলহাতা শার্ট পরা একটি ছেলে টেবিলে ঝুঁকে কী দেখে হাসছে। সঙ্গে পাশের এমপ্লয়িরাও যোগ দিচ্ছে।

বিলু কৌতূহল রাখতে না পেরে সামনে যায়। সে সাধারণত এই টেবিলে আসে না।

-কী ব্যাপার এখানে কী হচ্ছে?

-অপ্রস্তুত এমপ্লয়িরা বলে, ম্যাম ইনি মিস্টার মারুফ হাসান। এক সপ্তাহ হয় জয়েন করেছেন। রব্বানী স্যারের ফাইল পড়ে হাসছেন।

ওহহ রব্বানী! ব্যাটা তাহলে এই টেবিলে? গত একটি বছর বিলুকেও কম জ্বালায়নি।

বিলুর কণ্ঠ শুনে মারুফ হাই করে। বিলু হ্যালো দিয়ে বলে রব্বানী এখানে? করছেটা কী?

মারুফ আবার গলাফাটানো হাসি দিয়ে বলে, তিনি সিরামিকস ও গ্রানাইটের বিল কম্পোজে চারকে আট ভেবে কী প্যাঁচেই না ফেলেছে মারুফকে। কম্পিউটারে কিছুতেই হিসাব মেলাতে না পেরে শেষে দুনিয়ার কাগজপত্র বের করে হার্ডকপিতে দেখে এক কোটি চার লাখ ছয় শ টাকা। সে কম্পোজে দেখিয়েছে এক কোটি আট লাখ ছয় শ টাকা। এবার বোঝেন আমার অবস্থা। এটা ফাইন্ডআউট করেই আমি হাসতে হাসতে শেষ। এমন ভুল মানুষ করে? মারুফ আবার গগনবিদারী হাসির ঝড় বইয়ে দেয়।

বিলু বেরিয়ে আসে। অবাক হয়। রব্বানী এত বড় ভুল করল। আর মারুফ কী করে হাসে? তা-ও অট্টহাসি। এখানে হাসির কী আছে? বিলুর টেবিলের এই ঘটনা হলে রব্বানীকে সাসপেন্ড করত ও। গত বছর একই কাজের জন্য বিলু তার কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। তার আন্ডারের এক জুনিয়র সেদিন ছুটিতে। একটি তথ্যের জন্য বিলু ফাইলে সাইন করতে পারে না। বিলু এত ব্যস্ত যে কন্টাক্ট নম্বর খুঁজে বের করার সময় নেই। অতঃপর রব্বানীকে ওর ফোনে নম্বর তুলে কল দিতে বলে। রব্বানী কল করে। অপর প্রান্ত থেকে সুইচ অফ দেখায়। রাতে ওই নম্বর থেকে কল আসে। বিলু অবাক। সে এই নম্বর থেকে কল করেনি বারবার বলার পরও লোকটি বিলুকে বিরক্ত করেই যায়। এরপর অবস্থা এমন যে বিলু কই থাকে, কী করে, এমন মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনতে সে বারবার ফোন করবে। বিলু যেন তাকে সাইড দেয়। এসব ঘ্যানরঘ্যানর শুনে নম্বর ব্লক করে। পরদিন অফিসে গিয়ে রব্বানীকে এই ঘটনা বললে দেখে চার আর আটের বিভ্রাট। চারকে আট ভেবে সে এইট ডিজিট বসিয়ে রোহানকে কল করলে কল চলে যায় আরেক জায়গায়। তারপরের ঘটনা বিলুকে ভুগিয়েছে খুব। রাগে বিলু বসকে অভিযোগ করে। বস আর দেরি না করে তাকে অন্য টেবিলে পাঠায়। এই হলো রব্বানী-কাণ্ড। অফিসে কারও এখন একটু ভুল হলেই টাইটেল হয় রব্বানী-কাণ্ড।

বিলু লাঞ্চ ক্যান্টিনে সারে। অনেকে বাসা থেকে নিয়ে আসে। ওর সে উপায় নেই। বাসা হলো কচ্ছপের কারখানা। কারও কোনো গতি নেই। চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ীর মতো অবস্থা। আজ ক্যান্টিন হাউসফুল। কর্নারে একটি টেবিল খালি দেখে সে বসে পড়ে। ওয়েটার সবজি সালাদ আর ভর্তা দিয়ে যায়। দুপুরবেলায় এটাই ওর মেনু। একটু পর মারুফ আসে। কোথাও খালি নেই দেখে বিলুর পাশে একটি চেয়ার দেখে ওখানে বসে পড়ে। তার বসে পড়ার ভঙ্গিও অন্য রকম। শান্ত হয়ে না বসে ধপাস করে বসে। যেন চেয়ারটা ওকে জোর করাচ্ছে বসানোর জন্য। বসেই গা এলিয়ে ফুরফুরে গলায় বলে, আপনার পাশেই বসে গেলাম। কোথাও নো ভ্যাকেন্সি।

ওয়েটার এলে সে গরুভুনা, ডালের অর্ডার করে।

দুজনে খাচ্ছে। মারুফ বিলুকে গরুভুনা নিতে বলে। আপত্তি জানালে মারুফ ওর পাতে একরকম জোর করে ঢেলে দেয়।

-এ কী! এ কী! মারুফ সাহেব কী করছেন?

-আরে কিছু না। একটু মাংস পাতে দিলাম। আর সে বিলুর পাত থেকে ভর্তা তুলে নিল।

-দেখেছেন? দুজন সঙ্গী থাকলে এ রকম করে বিনিময় করতে হয়। এটাকে কার্টেসি বলে।

বিলু লজ্জা পেয়ে বলে, আসলে সাদামাটা খাবার নিয়ে বসা। দেওয়ার কিছু নেই। তা ছাড়া মাছ-মাংস চিবুতে, কাঁটা বাছতে অনেক সময়। দেরি হয়ে যায়।

-অফিস তো, কাজের এত চাপ। শেষ হয় না।

-এত কাজ কাজ করেন কেন? কিছু যদি মনে না করেন, মিস বেলি, সবাই কাজ করছে।

-বেলি না, আমার নাম বিলু।

-ওই হলো। একার আর আকার। তবে বেলি বললেও মন্দ না। আপনাকে যে নামেই ডাকা হোক, সেই নাম আপনার জন্য পারফেক্ট। তা মিস ভদ্রতা, মাইন্ড করেননি তো?

-ভদ্রতা?

-হুম, এবার মারুফ আবার হো হো করে গগনবিদারী হাসি দিয়ে ক্যান্টিন মুখরিত করে তোলে। বিলুকে চমকে দিয়ে বলে, আপনাকে ভদ্রতা বলে ডাকতে ইচ্ছে হলো। অথচ দেখুন ডাকলাম। কিন্তু নামটি আপনার জন্য আসলেই পারফেক্ট।

-বিলুর ভাত জড়িয়ে যাচ্ছে আঙুলে। কথা বলতে পারছে না। লোকটি কী অদ্ভুত আর সাবলীল। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে বিলুর চোখে চোখ রেখে। শঙ্কাহীন। যেন কত চেনে।

ওহহ দুপুর! আপনার খাবার রয়ে গেল। খাচ্ছেন না তো কিছু। আসলে আমারই দোষ। এত বকবক করলে কোনো সুন্দরী রমণীর আহার জোটে? তার চেয়ে মারুফ নাম বাদ। আমাকে বরং বখাটে ডাকুন। কেমন এলোমেলো করে দিলাম আপনাকে। ওহহ! ছেলেরা এত কথা বললে মেয়েদের কাছে প্রেস্টিজ থাকে না।

-আপনাকে বখাটে ডাকার আর কই সুযোগ পেলাম। দুপুরে কি আমাকেই বলেছেন? বিলু জানতে চাইল।

-আমার চোখের সামনে এ রকম আঁধার নয়না মেয়ে ছাড়া তো আর কেউ নেই যে তাকে বলব!

-অন্য কেউ থাকলে বলতেন? আচমকা এই কথা বলে বিলু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। হায়, হায় সে এটা কী বলেছে? মারুফ তাকে এবার হ্যাংলা মেয়ে ভাবতে পারে। তা ছাড়া ছেলেটা চঞ্চল। বুঝে বিলু। তার আগাগোড়ায় কোনো স্থিরতা নেই। এ রকম অস্থির ছেলে বিলুর অপছন্দ। সে মনটাকে শক্ত করে বেঁধে নেয়। নাহ, ছেলেটা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না। সে শক্ত আবরণ চোখে-মুখে এনে বলে, মারুফ এবার উঠতে হবে।

-ওকে, ম্যাম চলুন।

দুজন চলছে। ক্যান্টিন থেকে অফিস বিশ গজ দূরে। ওরা হাঁটছে। এপ্রিলের গরম। রোদে তেতে আছে চারপাশ। হাঁটতে হাঁটতে বিলুর চোখে মুখে ঘামের বিন্দু জমে। মারুফ ওদিকে চেয়ে বলে ঘামকন্যা। আপনি রোদে দারুণ সুন্দর। কেউ বলেছে কখনো আপনাকে এ রকম করে?

বিলুর বুক ধক করে ওঠে। শনশন শনৈঃ শনৈঃ ওঠে পাঁজরে। ছেলেটা আসলে কী? সম্মোহন ক্ষমতা তার। বিলু চিন্তা করে ছেলেটার দিকে তাকানো যাবে না। আজ পরিচয়। অথচ পরিচয়ের প্রথম দিনে ওকে কাবু করে দিচ্ছে। বিলু তাড়া দিয়ে বলে, উঠতে হবে। অফিসে অনেক কাজ। পরে দেখা হবে।

মারুফ বলে, ঠিক আছে ম্যাম, চা খেতে আসব। আপনি চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এসেছেন। কফি আমিও পছন্দ করি না। এই বলে দুজন দুদিকের সিঁড়িতে চলে যায়।

বিলু এলো ঠিকই। কিন্তু কাজে আর মন বসাতে পারে না। মনের ভেতর অস্থিরতা। ছটফট, গোলমাল লেগে যাচ্ছে। ছেলেটার হরহর গরগর কথাগুলো কানে বাজে। এত কাজ করে কী হবে? কাজ একা আপনি না, অফিসের সবাই করে। আপনি শুধু কাজ কাজ করে নিজেকে ঠকাচ্ছেন। কাজ হচ্ছে সামগ্রিক প্রক্রিয়া। একা একা কেউ কাজ করতে পারে না। সামগ্রিকের জোটবদ্ধতাই কাজ। বিলু এত দিন এটা বুঝল না কেন? সে এত কাজ করেছে যে ছুটি নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি। বসও কখনো বলেনি, বিলু অনেক হয়েছে এবার থামুন। বরং মিটিং, দেশের ভেতর, বাইরে ছোটাছুটি চীনাদের রিসিভ করা অফিসের সব বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া সব ওই সামলাত। অফিসে আরও অফিসার আছে। ওদের প্রয়োজন হয়নি কখনো। তাহলে বিলু? সে কি নিজেই চাইত এসব তার সঙ্গে হোক? আর এসব হওয়ার জন্য সে সব সময় সিনসিয়ার, পাঙ্কুচুয়ালিটি মেন্টেন করেছে। আর বসের কাছে সেরা এমপ্লয়ি হয়ে থেকেছে। এর বাইরে তো আর কিছু নয়।

অথচ মারুফ, দিব্যি অফিস করছে, অফিসের ভেতর আড্ডা মারছে, আমোদ ফুর্তি, হাসিঠাট্টা সবকিছুই করছে সে। কই তার তো কোথাও কিছু থমকে যায়নি।

সকাল সাতটা। বিলু ঘুমাচ্ছে। শেফালী বেগম রুমে এসে উঁকি দিলেন। মেয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চলে গেলেন। ভাবছেন আজ বোধ হয় অফিস নেই। ওরা সবাই নাশতা খেতে বসেছে। সাবের হোসেন বিলুর কথা জিগ্যেস করতেই শেফালী বেগম বললেন, ও ঘুমুচ্ছে।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, কী বলো বিলুর মা! মেয়ে এতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার কথা না। অসুখ করেছে? দেখেছো?

-না, দেখিনি।

না দেখেই বলে দিলে? যাও গিয়ে জিগ্যেস করো। তা ছাড়া অফিস থেকে ছুটি নিল কি না জেনে এসো। সময়মতো যেতে না পারলে আমাদের দোষ হবে। ছুটি নিতে দেখিনি তাকে কোনো দিন, তাই অবাক লাগছে।

শেফালী বেগম এসে দেখে বিলু রেডি হচ্ছে।

-কী রে তোর অফিস আছে?

হুঁ মা।

-তাহলে এত দেরিতে জাগলি যে? শরীর খারাপ? তুই তো সকাল ছয়টাতেই উঠে পড়িস।

-না মা শরীর ঠিক আছে। এত ছোটাছুটি করে কী হবে? একটু রয়েসয়ে যাব ভাবছি। মেয়ের কথা শুনে শেফালী বেগম অবাক। কী বলছে সে। অবাক ভাব না দেখিয়ে বললেন, ও আচ্ছা। ঠিক আছে। ডাইনিংয়ে নাশতা দেওয়া আছে। তোর বাবা বসে আছে। আয়। খাব সবাই।

-ঠিক আছে যাও, আসছি।

বিলু নাশতার টেবিলে। তিন বছর পর একসঙ্গে সবাই ডাইনিং টেবিলে নাশতা খেতে বসেছে। ডাইনিং টেবিলে বসে বিলু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হায় এতটি বছর! কাজ কাজ করে সে পারিবারিক মণ্ডল থেকে নিজেকে কত বঞ্চিত করেছে। টাটকা রুটি ডিম পরোটাভাজি, গাঢ় দুধের কড়া লিকারওয়ালা চা থেকে কত বঞ্চিত হয়েছে। কাজ আর অফিস তাকে জীবন থেকে কত দূরে নিয়ে গেছে। বন্ধের দিনগুলোতে ঘুমিয়ে থাকে। কারও সঙ্গে দেখা হয় না। তেমন আলাপও হয় না। একরকম একপেশে জীবন হয়ে গেছে। বোনগুলো যে যার মতো সরে গেছে। সবাই ঠিক আছে। শুধু সে আলাদা হয়ে গেছে সবার থেকে। মারুফ ছেলেটা তাকে কোনো শিক্ষা দেয়নি। অথচ জীবন কেমন হওয়া উচিত, সে কথা হাসতে হাসতে বলে গেছে। মারুফের কথা মনে হতেই সে নাশতা শেষ করে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। আজ তাকে যেন ঘামে রাঙা করে ফেলে সে জন্য সানস্ক্রিন ক্রিম মুখে মাখেনি। বিলু চায় আজ তাকে খুব ঘামাক। চোখে কাজল পরে। ঠোঁটের ওপর র‌্যাভলনের হালকা প্রলেপ। তাতেই চোখসারা। অপূর্ব, মায়াবী, মনকাড়া রূপসী বিলু মনের ভেতর আনন্দ দুলিয়ে অফিসের উদ্দেশে রওনা দেয়।

বিলু কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। মেইলগুলো চেক করে। টুকটাক কাজের বিবরণ দেখে। প্রুফ করে। আর কতক্ষণ পরপর গুনগুন গান গায়। সে গান গাইছে কেন? ভেতরে কি বসন্ত এসেছে? নাকি কোকিল এসেছে মনপাড়ায়? গানের ফাঁকে চায়ের তৃষ্ণা পায়। একটু চা খেলে মন্দ হয় না। একা খেতে ইচ্ছে করছে না। সে কারও জন্য অপেক্ষা করে। এলে একসঙ্গে খাবে। কিন্তু না, কেউ এলো না। উঠে গিয়ে ওই টেবিলে যাবে, তা-ও সম্ভব না। বহুদিনের সংকোচ আর দ্বন্দ্বকে সে এড়াতে পারে না। বড় কঠিন নিজেকে ভাঙা। এত সহজ? কাজের ঝামেলা হবে মনে করে সে নিজেই এই রুম বেছে নিয়েছে। কেউ যেন তাকে বিরক্ত করতে না পারে। সবার থেকে আলাদা থাকতে চেয়ে বসও মেনে নিয়েছে। কারণ, বস জানে বিলু কাজের প্রতি সিরিয়াস। একটু ছাড়ও দিতে রাজি নয়। এখন সেই বিলু টেবিল রেখে ওখানে যায় কী করে? সবাই অবাক হবে না? মারুফের জন্য একরকম অপেক্ষা করে সে কাজে মন দেয়।

দুপুরটা আজ একটু দেরি করেই এলো। বিলুর তাই মনে হয়। গতকাল মারুফ তাকে দুপুর ডেকেছিল। সে রোদ সইতে পারে না। আজ রোদের ভেতর হাঁটছে। সমস্ত মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। গালে রোদ পড়ায় জ্বালাপোড়া করছে। ক্যান্টিনে পৌঁছে মারুফকে খোঁজে। ওর আগে এলো কি না দেখে।

নাহ, সে নেই। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে টেবিলে আসতেই দেখে মারুফ হইহই রইরই করে ঢুকছে। পাশে রব্বানী। আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে কথা বলছে। বিলুকে দেখে হো হো করে উঠে বলে, কাজলা মেয়ে কেমন আছেন? শ্বেতবিন্দুময় রমণী এই ক্যান্টিনে রোদফোয়ারায় ভিজে জলকণা বয়ে এনেছে। অপূর্ব! কী অপূর্ব সৌন্দর্য! মারুফের কথায় বিলুর বুক হু-হু করে ওঠে। গলা শুকিয়ে আসে। ওর এমন লাগছে কেন? সকাল থেকে দুপুর মনে হয় কত অজস্র বছর সে মারুফকে দেখেনি।

কথা আসছে না বিলুর মুখ থেকে। গতকাল রাতেও ঘুম কম হয়েছে। অস্থিরতার ভেতর ভোররাতে চোখ লেগে আসে। তার নিউরোট্রান্সমিটারে আকস্মিক হামলা করেছে ডোপামিন, অক্সিটোসিন, সেরাটোনিন ইত্যাদি উপাদান, যা তাকে প্রেমকাতর করে তুলছে। যাহ! সে এসব কী ভাবছে। নিজেকে সংযত করে বিলু।

মারুফ আবার বলে কী হে মায়াবতী? কেমন আছেন?

মারুফের দ্বিতীয় ডাকে বিলুর হুঁশ আসে।

-এই তো বেশ আছি। কিন্তু চেপে যায়, আপনি আমাকে ঘোড়ার ডিম ভালো রেখেছেন। সকাল থেকে অপেক্ষার তেতো ফল খাইয়ে বলছেন কেমন আছি? বিলুর জবাব শুনে মারুফ ধড়াম করে চেয়ার টেনে বিলুর পাশে বসে।

ছেলেটির কোনো স্থিরতা নেই। নদীর জলের মতো। কেবল সামনে এগোবে। ওয়েটার খাবার নিয়ে এলে বিলু অবাক হয়ে বলে, একি! আমি তো এসব অর্ডার দিইনি।

-আহা রূপশালী সাদা ভাতের ঘ্রাণময় মেয়ে! চুপ করুন দয়া করে। এই খাবার আমি অর্ডার করেছি। এবার খেয়ে নিলে ধন্য হই।

দুজনে খাচ্ছে। তবে বিলু লোকমা তুলতে পারছে না। ওর সমস্ত শরীর থমকে আছে। ছেলেটা আসার পর ওর গতি থেমে গেছে। দ্রুতমানবী আর দ্রুতগামী ট্রেনের মতো বিজয়ী বিলুর কেমন দশা করে ছেড়েছে ছেলেটা!

মারুফ মাংসের হাড় চিবুতে চিবুতে বলে, আজ আপনার ওখানে চা খেতে যেতে পারলাম না। আনিস স্যারের ফাইল চেকআউট করতে হয়েছে। তবে বিকেলে যাব। এখনো অনেক কাজ পড়ে আছে। চার হাতে শেষ করতে হবে।

বিলু মনে মনে বলে, এলে এমন কী ক্ষতি হতো? পাঁচ মিনিটের জন্য কি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত? মনের কথা মনে চেপে বিলু ভাতের দলা পাকিয়ে বলে, তাহলে খাবার শেষ করুন দ্রুত।

-উঁহু, এটা সম্ভব নয় লাবণী! সামনে বিলোলিত আর আলোককন্যা রেখে মারুফ পৃথিবীকে ঠকাতে চায় না। এমন সুন্দরী রমণীর সঙ্গে আলাপচারিতায় সময়কে আটকে দেওয়ার অধিকার পৃথিবীর আছে।

-পৃথিবী তো দেখছি না! বিলু বলে।

-কী বলেন মিস বিউটি! আমিই তো পৃথিবী। কেন আমাকে পুরুষ ভাবছেন? পৃথিবীর সমস্ত ভার আমার ওপর অর্পিত হয়েছে এই রমণীকে বোঝাতে যে পুরুষও প্রকৃতি হয়। কেন, আমার হাসিতে কি আপনি উত্তাল বাতাসের ঝনঝনানি শুনতে পাচ্ছেন না? বা নদীর জলস্রোতের কুলুকুলু শব্দ? দেখুন, মহীয়সী, এই যে সামনে আপনি এখান থেকেই ফুরফুরে হয়ে কাজে ডুবে যাব। তার আগে মগজে আমার ফুয়েল চাই। মিস বিলু আমাকে ফুয়েল দিচ্ছে। আচ্ছা, কখনো আপনি আর কোনো পুরুষকে প্রকৃতি ভেবে তার সবুজ ছায়ায় বসেছেন?

বিলু অবাক হয়। ছেলেটির কথা শুনে। ডিভোর্সের পর কোনো ছেলের দিকে তাকায়নি সে। ইচ্ছে জাগেনি। তার কেবল মনে হতো ছেলেরা বদ আর পাজি। ভালোবাসতে জানে না। মেয়েদের ওপর প্রভুগিরি করে। এটিই অসহ্য লাগে বিলুর কাছে। ছেলেরা যখন প্রভু হয়ে ওঠে, নারী তখন ক্রীতদাস। সেখানে আর ভালোবাসা থাকে? সেই থেকে বিলু পুরুষদের এড়িয়ে গেছে।

-কী হলো, কথা বলছেন না কেন? পুরুষদের ভয় পান? পুরুষদের প্রশংসা করতে কার্পণ্য লাগে?

-পুরুষদের এমন কী গুণ আছে যে প্রশংসারযোগ্য? শুধু মেয়ে পটানোর কৌশল ছাড়া ওরা আর কী জানে? বিলুর কাঠখোট্টা জবাব।

-তা ঠিক বলেছেন ম্যাম। এই যে আমি এখানে বসে এত কথা বলছি, তা কিন্তু আপনাকে পটানোর কৌশলও আছে কিছুটা। তবে কি জানেন, নারীকে পটানো এত সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে ওই নারীর যদি স্পেশালিটি থাকে। ছ্যাবলানো আর ছোঁক ছোঁক করা পুরুষগুলো নারীর সাইকোলজি যদি পড়তে জানত, তাহলে পৃথিবী প্রেমে ভরে যেত। পুরুষ নারীকে পড়তে জানেনি বলেই অপবাদ দিয়েছে, নারীর মন স্বয়ং ঈশ্বরও পড়তে জানে না। আসলে এটা ভুল। পুরুষের অসভ্যতাই নারীকে তাদের কাছে রহস্যময়ী করেছে। আপনার ব্যাপারটাই যদি বলি, এত সুন্দরী রমণী একটি অফিস দখল করে আছে অথচ তার কাছে কোনো পুরুষ ভিড়তে পারছে না, এটা পুরুষ জাতি হয়ে আমার কাছে বেমানান লেগেছে। বলতে পারেন এটা পুরুষ জাতের অক্ষমতা।

মারুফের কথা শেষ হতে না দিয়ে বিলু বলে, পুরুষ জাতকে উদ্ধার করতে এসেছেন? নিজের ক্ষমতা দেখাতে এসেছেন?

মারুফ এবার হো হো করে হেসে পুরো ক্যান্টিন কাঁপিয়ে তোলে। রিয়েলি, ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট লেডি। আই লাইক ইউর কমেন্ট। অন দ্য ওয়ান হ্যান্ড ইউ আর রাইট। অন দ্য আদার হ্যান্ড, ইউ আর নট রাইট।

-যেমন?

যেমন? এই ধরুন মেয়েদের দেখলে বেশির ভাগ পুরুষ ছোঁকছোঁক করে। গায়ে পড়তে চেষ্টা করে। ছ্যাবলামি করে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। এসবের কারণে তাবৎ পুরুষের কলঙ্ক। অন্যদিকে এসবের বাইরেও কিছু পুরুষ আছে তারা অন্যরকমভাবে নারীদের আবিষ্কার করে। বুঝতে চায়, জানতে চায়। ওই পুরুষ চায় সে এমন একটি নারীর সন্ধান পাক, যে আর সব নারীর থেকেই আলাদা। ওই নারী হবে স্পেশাল। তার স্পেশাল মাইন্ডের জন্য ও রকম নারীকে সে মহামূল্যবান মনে করে। তখন সে হয়ে ওঠে দেবী। সাক্ষাৎ ঈশ্বর। কাক্সিক্ষত নারীকে যখন একটি পুরুষ পেয়ে যায়, তার মতো মহাসৌভাগ্যবান দ্বিতীয়টি নেই। ওই নারীর ভেতর সে ঈশ্বরের সন্ধান পেয়ে যায়।

-বাহ, আপনি তো নারীদের নিয়ে বেশ গবেষণা করেছেন।

মারুফ আবারও দুনিয়া কাঁপানো হাসি হেসে বলে, দেখুন অপরূপা! পৃথিবীর সব নারীই নারী না। সব পুরুষও পুরুষ না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নারী, কেউ কেউ পুরুষ। ওই কারও কারও মধ্যে যখন সাক্ষাৎ ঘটে, তখন দৈববাণী আসে। এই বাণী হৃদয়ের গভীরে ঘটে।

তখন হৃদয় বলে, প্রেমে পড়েছি। আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। আমাকে গ্রহণ করো।

বিলু চোখ বড় করে বলে বাহ, সুন্দর বলেছেন।

মারুফ এবার চোখ রাখে বিলুর চোখে। তারপর বলে, আপনি সত্যিই সুন্দর। আপনার চোখ অসাধারণ। পৃথিবীর ছোঁকছোঁক পুরুষগুলো ওই চোখ দেখে অনেক আগেই মরে ভূত হয়ে গেছে নিশ্চয়ই! বাকি যে কজন আছে, তাদের হাল কল্পনা করছি।

বিলু ফিক করে হেসে ওঠে মারুফের কথা শুনে।

-দেখুন বেলাবোস, আপনার যতই পার্সোনালিটি থাকুক, গম্ভীরতা থাকুক, নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে রাখার চেষ্টা থাকুক দিন শেষে আপনিও কাউকে চেয়েছেন। একদম আপনার মতো করে। যে আপনাকে রাঙাবে, ভাঙাবে, গড়ে নেবে, প্রেমে প্রেমে ভরিয়ে তুলবে। আপনার সমস্ত দেয়াল ভেঙেচুরে আপনাকে আপনার ভেতর থেকে বের করে নেবে, আপনিও এ রকম কাউকে চেয়েছেন। আপনি খুঁজেছেন। কিন্তু পাননি বলে দিনের পর দিন নিজের ভেতর সেঁটে গেছেন। গুটিয়ে গেছেন। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন। যতই দিন গেছে, ততই নিজের ভেতর ডুবে গেছেন এবং এই ধারণাও আপনার ভেতর দেবে গেছে আপনাকে পড়া বা জানার মতো এ রকম কেউ পৃথিবীতে নেই। অথচ আপনিও জানেন না, আপনার মতো এ রকম কাউকে পাওয়ার জন্য পৃথিবীতে কিছু পুরুষ প্রকৃতি হয়ে পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছে। মারুফ থামে। খাওয়ায় হাত চালায়। দুজনের মাঝে নিস্তব্ধতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। এ মুহূর্তে নীরবতাই হলো হৃদয়ের সবচেয়ে পুরোনো ভাষা। ভাষাহীন এই সময়টা দুজনের হৃদয়ে স্কুল খুলে দিয়েছে। দুজনেই ছাত্র। অলক্ষ্য হতে কোনো এক দৈব শিক্ষকের মতো বলছে,

প্রেমের অপূর্ব শিখা চিরদিন জ্বলে,

স্বর্গ হতে আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে।

পরদিন অফিসে আসে বিলু। কলাপাতা রঙের জর্জেট শাড়ি আর লাল ব্লাউজ পরেছে। অন্যদিন সে টপস জিনস পরে অফিস করে। কিন্তু তার কী মনে হলো আজ সে শাড়ি পরবে। বাঙালি মেয়েরা প্রেমে পড়লে কি শাড়ি পরে? বিলু আবার ভাবে, যাহ, আমি কি প্রেমে পড়েছি নাকি? দুপুর গড়ায়। সে অস্থির হয়ে আছে কখন ক্যান্টিনে যাবে।

ক্যান্টিনে বসে সে অপেক্ষা করে। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, বিশ মিনিট। নাহ, মারুফের দেখা নেই। এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। সে কি আগে খেয়ে নিয়েছে? তার কি খুব তাড়া ছিল? নাকি অফিসের কাজ শেষ হয়নি? বিলু না খেয়ে উঠে আসে। সরাসরি ওর রুম হয়ে আসে। দেখে ওখানে মারুফ নেই। ব্যাপার কী? কোথায় গেছে সে? কাউকে জিজ্ঞেস করবে কেউ নেই। লাঞ্চ টাইম। যে যার মতো খাবারে ব্যস্ত। বিলু নিজের রুমে আসে। চেয়ারে ঠেস দিয়ে মারুফের হাওয়া হয়ে যাওয়া নিয়ে ভাবছে। কোথায় যেতে পারে সে? স্যারের রুমে? হতে পারে মারুফ বলেছে, কাজ শেষ করতে চার হাত লাগাতে হবে। তার কাজের চাপ কি বেশি ছিল? বিলু আর না ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় স্যারের রুমে যাবে। যাওয়ার সময় মারুফের রুম হয়ে যাবে। সে দাঁড়ায়। উঠতেই তার টেবিলের ওপর একটি খাম দেখে। খামটি নেয়। খুলে পড়তে শুরু করে। তাতে লেখা:

মিস বিলু,

আজ হয়তো ক্যান্টিনে আমাকে খুঁজেছেন। না পেয়ে বিষাদ আর ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছেন। আমি আসলে কেউ নই। আমি আপনার সত্তা। পুনর্জাগরণ। আমি খুব কম সময়ের জন্য পৃথিবীতে আসি। আমি আসি আপনাদের মতো মানুষের জন্য। মিস বিলু, নিজেকে জাগিয়ে রাখতে হয়। আপনি ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। এভাবে যদি ঘুমিয়ে পড়েন পৃথিবী তার চেইন অব রোলিং ডিসপ্লে হারাবে। আপনি এই প্রকৃতির একজন। প্রকৃতিতে থেকে প্রকৃতির হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসাকে অস্বীকার করে আপনি থাকতে পারেন না। আপনি দিন দিন স্টিলে দণ্ডায়মান মূর্তি হয়ে যাচ্ছিলেন। আপনার ওই স্টিলমূর্তি কোনো মিউজিয়ামও রাখবে না। আপনি এ রকম হয়ে গেলে আপনার দেখায় অফিসের বাকি স্টাফগুলো ধীরে ধীরে এমন হয়ে যাবে। কারণ, আপনার ইনফ্লুয়েন্স ক্ষমতা বেশি। আপনার এই বৈশিষ্ট্য আপনার বসকে প্রভাবিত করেছে। যার জন্য তিনিও আপনার মতো হয়ে উঠছিলেন। আপনার অফিস কিছুদিনের ভেতর সেই কঠিন অভিযোজনে পড়ে যেত। ধীরে ধীরে সবার মুখের হাসি চলে যেত। ওরা হয়ে উঠত এক একটি যন্ত্রমানব। প্রকৃতি এসব মানে না। হয়তো বলবেন, প্রকৃতিও নিয়ম মেনে চলে। ঠিকমতো সূর্য ওঠে, ডোবে। দিনরাত আসে। চাঁদ-তারা আকাশে ওঠে। মিস বিলু, এই নিয়মের মাঝেও অনিয়ম আছে। প্রকৃতির এই কাজগুলো একটি প্রক্রিয়ামাত্র, যা সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখে। আপনি খেয়াল করলে দেখুন, একমাত্র পূর্ব দিকে সূর্য ওঠা আর পশ্চিমে ডোবা ছাড়া প্রকৃতির আর কোনো কিছুই ঠিক নেই। প্রকৃতি হচ্ছে খেয়াল। সেখানে আপনি যা খুশি তা করতে পারেন না। এই যে আপনি এত দিন দমবন্ধ হয়ে থেকেছেন কী পেয়েছেন জীবন থেকে? আর আজ দুই দিন নিজ সত্তার ভেতর হারিয়ে গিয়ে কেমন লেগেছে? আসল কথা হচ্ছে, প্রকৃতি তার সৃষ্টির ভেতর সবকিছু দিয়ে পাঠিয়েছে। সে চায় এগুলোর ব্যবহার হোক। আপনি দিন দিন যে রকম কাঠখোট্টা হয়ে উঠছিলেন, প্রকৃতি রেগে যাচ্ছিল আপনার ওপর। তার একই কথা, সে আমার সৃষ্টিকে নিয়ে মজা করতে পারে না। তাই আমি এলাম। প্যারালাল পৃথিবী থেকে। ওটা আরেকটা জগৎ। আবার কখনো এলে জানাব ওখানকার অবস্থা। আপনি খুব সুন্দর। প্রকৃতি পৃথিবীতে কিছু সুন্দর তৈরি করে তার অহংকার প্রকাশের জন্য। আপনিও তেমন একটা সৃষ্টি। সুতরাং অফিসকে হাসিময় করে তুলুন। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরে তুলুন। এটাকে যন্ত্র বানাবেন না। প্রকৃতি চায় আনন্দ-উল্লাস ঘাত-প্রতিঘাতের জীবন। আর রব্বানী নামের কেউ নেই। সে পৃথিবীর ভাঁড়। তার কাজই হচ্ছে সংখ্যা উল্টে দেওয়া। মাঝে মাঝে পৃথিবীও উল্টে যায়। কেউ টের পায় না। তখন সবাই ঘুমে অচেতন থাকে। পৃথিবীকে উল্টে দিয়ে প্রকৃতি পৃথিবীর সক্ষমতা যাচাই করে।

অনেক বলে ফেলেছি। আপনাকে কলাপাতা শাড়িতে কাশ্মীরি রমণীর মতো লাগছে। যেন বহুদূরের পাহাড়।

সবুজের সমারোহে গুল্ম আর তৃণেরা পাহাড়ে ম-ম করছে। আবার কখনো শাড়ি পরলে লাল টিপ পরবেন। দিগন্ত বিস্তৃত কোনো খোলা মাঠে ডুবে যাওয়া সূর্যের পাশে দাঁড়াবেন। আমি নিশ্চিত আপনার কপালজোড়া টিপের সৌন্দর্য দেখে অস্তগামী সূর্যটা তাড়াতাড়ি ডুবে যেতে চাইবে কোনো সমুদ্র গহ্বরে। আমি আবারও আসব। তবে মারুফ হয়ে নয়। অন্য কেউ হয়ে। আরেকটি কথা, জীবনের গতি কিছুটা শ্লথ করতে হয়। আপনি বর্তমানে চড়েই অতীত আর ভবিষ্যতে পাড়ি দিতে পারেন। তবে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। আপনি নিগূঢ় হয়ে যে কাজ করেন দৌড়ের ওপর সময়ের রশি টানতে চান, আসলে সময় তার নিয়মেই চলছে। আপনি সবার আগে অফিসে আসেন। তার মানে আপনার কলিগদের আগে ভবিষ্যতে পৌঁছে যান। তখন ওরা অতীতে পড়ে থাকে। ওরা আসার আগে আপনি কাজ শুরু করেন। ওরা আপনার পরে এসে করে। ওদের কাজ আর আপনার কাজের পার্থক্য খুঁজলে কিছুই পাওয়া যাবে না। আপনি যে কাজ আগে শুরু করেন, ওই কাজও ওরা করে। হয়তো আপনি ধীরে করেন, ওরা দ্রুততার সঙ্গে করে। এটিই পার্থক্য। কিন্তু কাজ হচ্ছে। এখানে সময় শুধু নিরূপিত হচ্ছে গতির ওপর। আপনি কখন কীভাবে ছুটছেন তার ওপর কাল বা সময় নির্ধারিত হয়। আর কিছু না। তবে আপনি কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নিজের গতি হারিয়ে ফেলেছেন।

যাক, এই নিয়ে আবার কখনো কথা হবে। অবশ্যই হবে।

আমি তো আসছিই এই পৃথিবীতে। বিলু, সোনা মেয়ে মন খারাপ করে না।

বিলু চিঠিটা কয়েকবার পড়ে। বিশ্বাস করতে চাইছে না মারুফ নেই। বা মারুফের মতো কেউ এসে চলে গেছে। সে চিঠিটা হাতে নিয়ে ওর টেবিলের দিকে দৌড়ায়। অন্য এমপ্লয়িরা কাজ করছে আর কী দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বিলু ওখানে গিয়ে বলে, রব্বানী আছে রব্বানী? আমি একটি সংখ্যা উল্টে দিতে চাই।

সংখ্যাটি আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে।

অন্য এমপ্লয়িরা বিলুর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে আবার হো হো করে হেসে ওঠে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :