ভ্রমণ

পর্বতচূড়ায় মেঘেদের ঘরবসতি

প্রকাশ | ২৮ এপ্রিল ২০২২, ০৯:৪০ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২২, ১০:৫২

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

পাহাড়ের মতো এত টকটকে রক্তজবা দেখিনি কখনো। গাঢ় সবুজের মাঝে লাল ফুলের ঝালর। কী সুন্দর! চৈত্রের রোদ্দুরে ঝিমিয়ে পড়া পাহাড়ের গায় ওইটুকুই সজীবতা। বসতের আঙিনা থেকে উঁকি দিচ্ছে পথে। ঠিক দুরন্ত শিশুদের মতো। যেন শোনে না কোনো বারণ। সর্পিল পাহাড়ি পথ। তার ধারে সেগুন, গর্জন, চম্পা-জারুলের সংসার। কখনো ঢালুতে, কখনো প্রান্তে। এই পথ ভেঙে চাঁদের গাড়ি চলছে নীলাচলে। যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পাহাড়। আমরা কজনা প্রকৃতিপ্রেমী গাঁথা পড়েছি এক সুতোয়। পাহাড় আর প্রকৃতি দর্শনে।

এক রাতের দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে পৌঁছেছি সকালে। রেইচা আর্মি ক্যাম্পের দুয়ারে যেতেই হাত তুললেন একজন সেনাসদস্য। রাতের দীর্ঘ ভ্রমণে গান-গল্প আর আড্ডায় যারা ঘুমোতে পারেননি, তাদের চোখ লেগে এসেছিল ভোরে। ভাঙল এক্ষণে। বাসের দুয়ার খুলে গেলে উঠে এলেন ওপরে। ‘আপনাদের কারা বান্দরবানে বেড়াতে এসেছেন?’ প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই একযোগে উঠে গেল সব কটি হাত। ‘কোনো ভিনদেশি সফরকারী এসেছেন কি না সঙ্গে?’ এই প্রশ্নে একবাক্যে ‘না’ বলতেই বাসের আগাপাশতলা একবার পায়চারি করে নেমে গেলেন সেনাসদস্য। ‘আপনাদের ভ্রমণ আনন্দদায়ক হোক।’

সদ্য ঘুম ভাঙা মনিষ্যিরা আড়মোড়া ভেঙে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন জানালার ওপাশে। দুপাশে অভেদ্য প্রাচীর। তাতাপোড়া বুকটা চিতিয়ে রেখেছে পাহাড়। একেবারে রুখু নয় অবশ্য। সেগুন, জারুল, পিয়াল, মহুয়ার সতেজ স্নিগ্ধতাও আছে কোথাও কোথাও। কিছু দূর যেতেই হাতের বাঁয়ে হাতছানি দিল মেঘলা পর্যটন স্পট। হাত নেড়ে কেউ কেউ বলল, ‘আসছি বাবা। দেখা হবে শিগগির।’ বলতে বলতে থেমে গেল নীল বাসের চাকা। ভেনাস রিসোর্ট। আয়োজকেরা জানিয়ে দিলেন, এখানেই হবে যাপন। দুই দিন, এক রাত। স্বল্পদৈর্ঘ্য এই ভ্রমণে সবাই সংবাদকর্মী। আয়োজক পিআর সংস্থা ইনফো পাওয়ার লিমিটেড।

পাহাড়ের সমতলে বেশ গোছানো ভেনাস রিসোর্ট। প্রাকৃতিক নৈসর্গকে কাজে লাগিয়ে দারুণ সজ্জা তার। খালের মতো ছোট্ট একটা জলাধারে ঘেরা রিসোর্টের একপাশ। তার পাশে পাশে ফুটে আছে রাধাচূড়া। অন্য পাশে পাহাড়। তার বুক কেটে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠেছে ওপরে। সেখানেও ছোট্ট কটেজ। আছে টকটকে ঝুমকো লতা, বাগানবিলাস আর নাম না জানা বুনোফুল। কৃত্রিম ফোয়ারা চত্বর। তার গায়ে শুভ্র পাখার পাথুরে দেবদূত শিশু। সকালের প্রাতরাশ, হোটেলের কক্ষ বরাদ্দ আর স্বল্প বিশ্রাম শেষে এবার বেরিয়ে পড়ার পালা। এরই মধ্যে হোটেলের আঙিনায় বসেছে চাঁদের গাড়ির হাট। উঠে পড়ার পালা। যে যার মতো চড়ে বসলে ছাড়ল গাড়ি। প্রথম গন্তব্য নীলাচল।

ঢালু আঁকাবাঁকা পথ। সাপের মতো বেয়ে বেয়ে উঠে যাচ্ছে চাঁদের গাড়ি। দক্ষ চালক না হলে কুপোকাত হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দক্ষতা যে বয়সে হয় না, এখানকার চালকদের দেখলেই তা সহজে অনুমেয়। এখনো দাড়ি-গোঁফের রেখা ভাসেনি মুখে, এমন কয়েকজনও আছে আমাদের বহরে। চালকজীবনের অভিজ্ঞতাও খুব যে বেশি তা নয়, তিন-চার বছর। তারপরও কী দুর্দান্ত সাহস তাদের!

পথের দুপাশে ঢালু পাহাড়ের গায়ে বসতি। কোনোটা পাকা। কোনোটা খড়, বাঁশ, বেতের। তার ছোট্ট উঠোন। ফল-ফলাদির গাছ। ফুল গাছ নেই, এমন বাড়ি চোখে পড়ল না মোটেও। উদরের খোরাকের মতো মনের খোরাকেও এঁরা খুব যত্নবান, বোঝা গেল তা। ছোট ছোট বাড়িগুলো একেকটা স্বর্গপুরীর মতো। তবে বর্ষায় পাহাড়ি ধসের ঝুঁকিও বাইরে নয়। উঠোনের কোথাও গবাদি পশু। জাবর কাটছে আপন মনে। কোথাও ডালিম গাছের ছায়ায় বসে কোমর তাঁতে চলছে পিনন-হাদি বুনন কাজ। মাঝবয়সী কর্মঠ নারী। তার পাশে বসে আছে ছোট্ট মেয়েটি। দেখছে কীভাবে এপাশ-ওপাশে দৌড়ে বেড়ায় চঞ্চল মাকু। হয়তো তার কোমরেও একসময় ঝুলবে এই তাঁত। নয়তো শিক্ষার আলো দেখাবে নতুন দিগন্তরেখা।

নীলাচলের দুয়ারে পা ফেলতেই হাত নাড়ে রক্তজবা। তার পাশে বুনোফুল। তাতে বসেছে প্রজাপতির মেলা। হলদে ফিনফিনে পাখায় কালচে আল্পনা। পাখায় পাখায় ছড়িয়ে দিচ্ছে রং। ফুলে ফুলে। পাতায় পাতায়। একটু উঠতেই নীলাচল লাভ পয়েন্ট। এখান থেকে নিচে তাকালে পাখির চোখে ধরা দেয় শহর। পাহাড়ের গায়ে অজগরের মতো পেঁচিয়ে আছে ঘর-বসতি, লোকালয়, পথ। বান্দরবান শহরটা এমনই। পাহাড়ের বুক কেটে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা লোকালয়। জন্ম পাহাড়ের ঔরসেই। লাভ পয়েন্ট কিংবা ঝুলন্ত নীলা থেকে দেখতে শহরের স্থাপনাগুলো একেকটি মিনিয়েচার। ঘন অরণ্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে বড় বড় দালান। যেমন মা পাখির ডানায় আশ্রয় খোঁজে ছানারা। প্রকৃতির কাছে মানুষ আর তার আবিষ্কার যে কতটা ঠুনকো, মনে পড়ে সে কথাই।

ঢালু পথ বেয়ে আরও কিছু দূর উঠতেই নজর কাড়ে ‘ব্র্যান্ডিং বান্দরবান’। ছোট্ট একটা বাঁশের কুটি। নিচের দিকটা বেশ প্রশস্ত। বিক্রয়কেন্দ্র। তার ওপরে দোতলা কটেজ। ঝুলবারান্দা। বাঁশের তৈরি স্থাপনা, তবে সবুজাভো কাচ বসানো জানালায়। তার পাশেই ল্যাম্পপোস্ট। এই পার্বত্য জেলার উদ্যোক্তাদের তৈরি পণ্যের বিক্রয় ও প্রদর্শনী করা হয় এখানে। খুব যে সাজানো-গোছানো, তা নয়। ঝুলছে বাঁশ আর বেতের তৈরি কিছু সরঞ্জাম। বিনি ধানের চাল আর মস্ত এক শুকনো গিলা ফল। খুব বেশি আগে করা হয়নি। এ বছরের শুরুতে হয়েছে উদ্বোধন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এখানকার দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসকদের অনেকের নাম খচিত আছে পাহাড়ের বুকে, ছোট ছোট নামফলকে। চোখে পড়ে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, জ্যেষ্ঠ সচিব পদমর্যাদার কর্তাদের দু-একজনের নামও।

নীলাচলে বিভিন্ন পয়েন্টে আছে নিরিবিলি সময় কাটানোর ব্যবস্থা। ছোট ছোট বেঞ্চি, কংক্রিটের সেন্টার টেবিলের চারপাশে আসন দেখলে একবার হলেও বসতে চাইবে মন। আমাদেরও ব্যতিক্রম হলো না। ক্লান্ত-পরিশ্রান্তদের অনেকেই কিছুটা সময় কাটালেন এখানে। কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মুহূর্তটা বন্দি করতে ফ্রেমে। এস এম আতিক ভাই উড়িয়ে দিলেন ড্রোন। পাহাড়ের চূড়া থেকে আরও কয়েক ওপরে, শূন্যে। যেতে যেতে একটা সময় হারিয়ে গেল সাদা মেঘের দেশে। আতিক ভাইয়ের হাতে রিমোট কন্ট্রোল। মুঠোফোনের স্ক্রিনে উবু হয়ে খুঁজছেন দুষ্টু ড্রোনটাকে। কোথায় গেল ফাঁকি দিয়ে! চোখেমুখে উদ্বেগ তার। অবশেষে মিলল সন্ধান। একটা পাখির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উড়ে গিয়েছিল দূরে! কান ধরে (রিমোট কন্ট্রোলে) হিড়হিড় করে টেনে আনলেন কাছে। স্বস্তির ফুল ফুটল তবে। গাজী মনসুর আজিজ ভাই। শান্তশিষ্ট মানুষ। বাংলাদেশের নাম খচিত টি-শার্ট তার গায়ে। ঘুরে বেড়াচ্ছেন ক্যামেরা হাতে। আপন মনে ক্লিক করছেন পছন্দের নিরিখে। তুলছেন পাহাড়, ফুল, পাখি আর প্রজাপতি। সঙ্গীদের অনুরোধ-উপরোধও দিচ্ছেন না ফিরিয়ে। তারপরও অনেকেরই অনুযোগ, ‘গাজী ভাই, আমার তো একটাও নিলেন না!’

নীলাচলে ‘অস্তাচল’ নামাঙ্কিত স্পটটিও বেশ নান্দনিক। চূড়ায় আছে গাছের গুঁড়ির ছাচে কংক্রিটের রেলিং দেওয়া ঝুলবারান্দা। যেখানে দাঁড়ালে প্রায় দেড় হাজার ফুট ওপর থেকে ধরা দেয় বান্দরবান শহর। চূড়ায় ওঠার ব্যবস্থা অবশ্য ভালো। প্রসর সিঁড়ি। রামধনুর রঙে সাজানো। এখানেও একদণ্ড জায়গা আছে বসার। গাছের ছায়ায়। কাচ রোদ্দুরেও গা জুড়ানো শীতল হাওয়া। খানিক সময় বসলে চোখ বুজে আসে হাওয়ার আদরে। কিন্তু সময় তো নেই খুব হাতে। ছুটতে হবে আরও দূরে। সেই নীলগিরির পথে। যেখানে আকাশ এসে মিতালি গড়েছে পাহাড়ের বুকে।

 

মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’, রাত বলেছে ‘যাই’...

আতপ চালের গরম ভাত, বেগুনভর্তা, কোরাল মাছের দোপেঁয়াজা আর বাঁশের ট্রেতে কাঁচা মরিচে রাঁধা মুরগি। নীলাচল ভ্রমণ শেষে বিরতি মধ্যাহ্নভোজের। মিলনছড়ায় পাহাড়ের চূড়ায় রেস্তোরাঁ। সমতল থেকে মাটিতে জুড়ে দেওয়া বাঁশের ধাপ পেরিয়ে ইট-পাথরের স্থাপনা। জানালা কাটা বড় বড়। বাতাস এসে উড়িয়ে নিচ্ছে সব। পাশেই বর্ধিত অংশ। খোলা জায়গা। বাঁশের পাটাতন। ওপাশের পাহাড়। হাতির কানের মতো সবুজ পাতা দোলাচ্ছে কলাগাছ। পাতাঝরা সেগুনবন। কেউ কারও চেয়ে কম নয় গায়ে-পায়ে। তার মাঝে ছোট ছোট খুপরি। উঁচু-নিচু চলার পথ। ভোজ শেষে কাঠের পাটাতনে গাছের নিবিড় ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছেন কেউ কেউ। ওপাশে একটা ঘরে পাতা আছে টেবিল টেনিস আর ক্যারাম বোর্ড। ভ্রমণসঙ্গী, বন্ধু আলাউদ্দিন আলিফের আগ্রহে হাত চলল টেবিল টেনিসে। ফের ছোটার পালা। গন্তব্য নীলগিরি।

বন্ধু আসাদুজ্জামান ‘সময় নেই’ গাড়ি ছেড়ে দেবে, বলতে বলতে নেমে গেল দৌড়ে। সবার আগে দখলে নিল চালকের পাশের আসনটি। পুরো ভ্রমণে এই আসনটি আর বেদখল হয়নি তার থেকে। অনুজ সহকর্মী রোহান ব্যস্ত ছবি আর ছোট ছোট ভিডিও ধারণে। তাকে তাড়া দিয়েও কাজ হলো না। অগত্যা নেমে এসে বসলাম চাঁদের গাড়িতে। নীলগিরির এই যাত্রায় আমাদের গাড়িতে ইনফো পাওয়ারের তারেক ভাই, সাখাওয়াত ভাই। আছেন সহকর্মী-বন্ধু সাদ্দাম ইমরান, হাসান জাভেদ, উজ্জ্বল গমেজ। অগ্রজ সহকর্মী কামরুজ্জামান বাবলু ও ইউসুফ আরেফীন ভাইসহ চেনামুখ আরও কয়েকজন।

 

বাতাসের দেয়াল ফুঁড়ে চলছে চাঁদের গাড়ি। চৈত্রের গনগনে রোদ ঝুলছে শূন্যে। অথচ শীতল বাতাসে শরীরজুড়ে পৌষের দাপট। মসৃণ পিচঢালা পথের কোথাও কোথাও ইস্পাতের কালভার্ট। ঝনঝনাঝন শব্দ তুলে গাড়ি চলে আরও প্রবল বেগে। পথের এক ধারে কখনো উঁচু পাহাড়ের দেয়াল। অন্য পাশে ঢাল। বেয়ে বেয়ে নেমে গেছে হাজার ফুট উচ্চতা থেকে। তার বুকে পাহাড়ি কলাবাগ। বাঁশ-বেতের রমরমা। একটা-দুটো বিচ্ছিন্ন বসতও চোখে পড়ে তার মাঝে। আবার দাঁড়িয়ে আছে পাতাঝরা একহারা সেগুনগাছ। তারও নিচে দুই পাহাড়ের সন্ধিতে আঁকাবাঁকা সাঙ্গু। কিছু দূর গিয়ে আড়মোড়া ভেঙে বয়ে যাচ্ছে নিটোল। আটকে থাকে চোখ। দেখতে দেখতে হারিয়ে যায়, পেরিয়ে যায় দূরে।

নীলগিরি যাওয়ার এই পথটা বেশ দীর্ঘ। শহর থেকে প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার। দীর্ঘ এই পথের দুই ধারে জনবসতি খুব একটা নেই। যা-ও আছে বেশ দূরে দূরে। চোখে পড়ে হঠাৎ হঠাৎ। কোনোটা প্রাণের অস্তিত্ব। কোনোটা নিঃসঙ্গ নিস্তরঙ্গ দুপুরের মতো। কেবল উঠোনে কিংবা দুয়ারে পাহারায় রানি গোলাপি বাগানবিলাস। দুলছে ফুরফুরে হাওয়ায়।

কিছু দূর গিয়ে গাড়িতে পাশ বদলে বসলেন সাদ্দাম ইমরান। কারণ ‘উচ্চতা-ভীতি’। নিচে তাকালে ভয় হয় তার। শূন্য হয়ে আসে ভেতরটা। এ নিয়ে খানিক রসিকতাও করলেন জাভেদ, ইউসুফ ভাই। কিছুক্ষণ পরপর সাখাওয়াত ভাই মাইলফলক দেখে দেখে বলছিলেন আর মাত্র ৩৫ কিলোমিটার, ৩০ কিলোমিটার, এই তো চলে এসেছি ২৩ কিলোমিটার। দীর্ঘ যাত্রার পুরো সময়টা চাঁদের গাড়ি মাতিয়ে রাখলেন বাবলু ভাই। গান, গল্প, কৌতুক ও তৎক্ষণাৎ হাস্যরসে। বাবলু ভাই যে ভালো গান করেন, এ কথা জানার সুযোগই হতো না, এই ভ্রমণে সঙ্গী না হলে। বরিশাল আর নোয়াখালীর মিঠেকড়া দ্বন্দ্ব তুঙ্গে তুলেছিলেন ভোলার জাভেদ আর সুবর্ণচরের ইউসুফ ভাই। নোয়াখালীর পক্ষে সাখাওয়াত ভাইও কম যাননি। বরিশালের পক্ষে ভোলার বাসিন্দা একাই ছিলেন এক শ। যদিও বৃহত্তর বরিশালের আরও দু-একজন ছিলেন সেখানে। যারা গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের দেশে মৌনতাতেই নিয়েছিলেন শেষ আশ্রয়। সব মিলিয়ে উপভোগ্য ছিল বেশ।

মানুষ আর প্রকৃতি একাকার এই পর্বতঘেরা অরণ্যে। চাপালিশ, তেলসুর, ঢাকিজাম কিংবা বাঁশ-বেতও এখানকার আদি বাসিন্দা। ঝিরঝিরে হাওয়ায় শাড়ির পাড়ের মতো উড়ছে কচি সবুজ পাতা। চিম্বুকে বুড়ো বটের ধারি সংসার। লাল বটফল জ্বলে আছে ঝাড়বাতির মতো। হঠাৎ একটা-দুটো ছোট বাজারও পড়ে নজরে। এখানকার বেশির ভাগ বাজারই গড়ে উঠেছে বড় গাছের ছায়ায়। মুদি-মনোহারি, পাহাড়ি কলা, পেঁপে, তেঁতুল আর সবজির পসরা। কোথাও কোথাও আছে কাপড়ের দোকানও। ভাঙা হাটের মতো। দু-তিন দোকানির চার-পাঁচজন ক্রেতা। কেউ গাছের ছায়ায় আসন পেতেছেন। কেউ গল্প করছেন দোকানির সঙ্গে। কারোরই যেন তাড়া নেই। তাড়া নেই বেচাকেনার, বাড়ি ফেরার।

পাবলা পাড়ায় এমনই একটি ছোট বাজার জেগে আছে পথের ধারে। ক্রেতাদের দু-একজন পাহাড়ি তরুণ। পিনন-হাদি জড়ানো গায়। সুডৌল দেহে চেকনাই রূপ। একটু দূরে কয়েকটি বসতি। এম্পু পাড়ায় পথের ধারে, লাল পিঁপড়ের মতো সারি বেঁধে আছে শিশুরা। পরনে রঙিন পাহাড়ি বসন। কী মিষ্টি চাহনি তাদের!

পাহাড়ের গায়ে আদিবাসী নারীরা ঘাম ঝরাচ্ছেন কায়িক পরিশ্রমে। পরনে থামি, কোর্তা। কোনো কোনোটার রং মলিন হয়েছে রোদে। এক টুকরো কাপড়ে বাঁধা চুল। পরিশ্রমী তামাটে শরীর বেয়ে ঝরছে ঘাম। তবু ক্লান্তি নেই, ক্ষান্তি নেই কাজে। চলার পথে হঠাৎ হঠাৎ ছবির মতো ভেসে ওঠে। আবার কোথায় হারিয়ে যায় যেন।

ভ্রমণ সহযাত্রী একজন কথা তুললেন, এত কিছু দেখলাম কিন্তু বানর কোথায়? বান্দরবানে এসে বানরই যদি না দেখি! আসলেই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ময়না, টিয়া কিংবা ঘুঘুর দেখা মিললেও পাওয়া যায়নি বানরের দেখা। অথচ কিংবদন্তি আছে, এই জেলার নামের পেছনে আছে বানর। উইকিপিডিয়া বলছে, একসময় এই অঞ্চলে ছিল অগুনতি বানরের বাস। শহরে ঢোকার মুখে ছড়ার পাড়ে লবণ খেতে আসত বানরের দল। একসময় লাগাতার বৃষ্টিতে টইটম্বুর হয় ছড়ার জল। সেই জল পেরিয়ে পাহাড়ে যেতে পারছিল না বানরেরা। পরে একে অন্যকে ধরে সার বেঁধে পার হয় ছড়া। এই দৃশ্য দেখেন স্থানীয়রা। পরে ওই জায়গাটির নাম তারা দেন ‘ম্যাঅকছি ছড়া’। মারমা ভাষায় ‘ম্যাঅক’ অর্থ বানর আর ‘ছি’ অর্থ বাঁধ। সময়ের তোড়ে বিভিন্ন ভাষাভাষির মুখ ঘুরে বানর বাদ হয়ে যায় ‘বান্দরবান’। সরকারি দলিলপত্রেও এই নামের ঠাঁই হয়। অতীতের বানরের নামে নামকরণ হওয়া এই জেলাকে এখন বানরশূন্যই মনে হয়। তা না হলে নীলাচল, মিলনছড়া কিংবা নীলগিরি দীর্ঘ ভ্রমণে কোথাও চোখে পড়বে না একটি বানরও? তা কী করে হয়!

পথ বেয়ে যত উঠছে চাঁদের গাড়ি, ততই হিমবায়ুর আলিঙ্গন। টুকরো টুকরো মেঘের মতো কী সব উড়ছে বাতাসে। ইতিউতি চোখ ফেলে বোঝা গেল, এগুলো কার্পাস তুলো। পথের ধারে শুকনো ডালপালার মাথায় ফুটে আছে সাদা মেঘের মতো। বাতাসে মাথা নাড়ছে ডানে-বাঁয়ে। দু-একটা খসে যাচ্ছে তীব্র হওয়ায়। তুলো ফুলের এই সাম্রাজ্যের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য কতটাই আর বলা যায় ভাষায়! দূর থেকে পাহাড়ের পথে তাকালে মনে হচ্ছিল, সত্যিই যেন নেমে এসেছে মেঘ। অনতিদূরেই মেঘেদের ঘরবসতি। কাছে গেলে মনে হয়, না আরও একটু দূরে। একজন বললেন, আর কদিন পর বর্ষায় এই পথে এলে ধরা যাবে মেঘ। সত্যিই তখন নেমে আসে হাতের কাছে।

যাত্রাপথে পেল্লাই এক ক্যাকটাস হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে। যদি কেউ তুলে নেয় সাথে! কিংবা ড্রাগনগাছ লকলকে সাপের মতো বাইছে খুঁটিতে। বাতাসে ডাক পাঠিয়েছে পাখির কুজন। হিসহিসে পাতার শব্দও। নৈসর্গিক প্রকৃতির সান্নিধ্যে ধুয়ে-মুছে একাকার হয়ে গেল মনোজগতের সব ধুলো-কালি। যেদিকে তাকাই কেবল বিশালতার চিহ্ন। মানুষ কতটা ক্ষুদ্র, কতটা অসহায়, ক্ষণে ক্ষণে মনে বুদ্বুদ কাটছিল সে কথাই।

চাকাগুলো জমে গেল নীলগিরির দুয়ারে। সূর্য তখন রওনা করছে পাটে। পাহাড়ের ওপর থেকে উঁকি দিচ্ছে নীল কমল ক্যাফে রেস্টুরেন্ট। তার পাশেই ‘ওয়েলকাম টু নীলগিরি’। তারও আগে আহ্বান করলেন পথের ধারের বাঁশের ছাউনির ছোট ছোট দোকানিরা। অধিকাংশই নারী। তাদের পরনে পাহাড়ি নীল-লাল বসন। গলায় পাথর-পুঁতির লম্বা মালা। কারও হাতে লাল-সাদার কয়েক গুচ্ছ চুড়ি। কড়ি, ফুল আর পাথুরে দুলের ভারে নেমে এসেছে কানের লতি। শক্ত হাতের পেশিতে শ্রমের চিহ্ন। পাকা পেঁপে, কলা, বুনো তেঁতুল, আর শুকনো হলুদের পসরা। তাদেরই একজনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এক পর্ব হয়ে গেল পেঁপে, কলার স্বাদ আস্বাদন। কী রসাল পেঁপে। কলাগুলোও খুব মিষ্টি। গলা শুকিয়ে আসা কেউ কেউ ডাব আর ঠান্ডা জলে মেটালেন তিয়াসা।

ধীরে ধীরে ‘নীলগিরিতে স্বাগত’ তোরণ পেরিয়ে উঠে গেলে মনে হলো, এ আরেক রাজ্য। প্রায় দুই হাজার ২০০ ফুট ওপর থেকে সবকিছু দেখতে কেমন ঠুনকো আর ছবির মতো। মেঘের একটি স্তরও চোখে পড়ল নিচে। তার নিচে পর্বতবেষ্টিত ঘন অরণ্য। ধূসর চাদরে ঢাকা। মেঘ ক্ষয়ে যাওয়া কোথাও কোথাও সবুজের হাতছানি। এ জন্যই কি বাংলাদেশের দার্জিলিং বলা হয় নীলগিরিকে?

নীলগিরি হিল রিসোর্ট বেশ পরিপাটি। কটেজগুলোর নামেও আছে নান্দনিকতা। পরিবেশ আর প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে এসব নামকরণের পাশাপাশি প্যাকেজ মূল্যেও আছে তারতাম্য। আকাশনীল, মেঘদূত, রংধনু, ধ্রুবতারা, নীলাঞ্জনা, নীলিমা শুকতারা, সন্ধ্যাতারা ইত্যাদি। সর্বোচ্চ ১৬ হাজার থেকে সর্বনিম্ন আট হাজার টাকায় এক দিন-এক রাত কাটানো যায় এখানে। পাহাড়ের ওপরে কয়েক ধাপে এই কটেজগুলোও পর্যটনের অংশ হয়েছে এর নান্দনিক স্থাপত্যের কারণে। মেঘদূত কটেজটা সবার উঁচুতে। পাকা সিঁড়ি ভেঙে উঠতেই হাতের বাঁয়ে বাতাসে দুলছে রক্তজবা। মেঘদূতের কাঠের রেলিংয়ে ঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্যের ছবি তুলছেন এক নারী। চোখে চোখ পড়তেই মৃদু হেসে বললেন, তার একটি ছবি তুলে দিতে নিচ থেকে। তিনি সূর্যের দিকে ফিরে দাঁড়ালে কাচ ভাঙা রোদ এসে পড়ল মুখে। ফ্রেমে বন্দি হলো সেই মুহূর্ত।

নীলগিরি ওপর থেকে যত দূর চোখ যায় কেবল ঝিরঝিরে মেঘ আর ধূসরে ঢাকা। প্রায় আড়াই হাজার ফুট ওপর থেকে পর্বতগুলোকে মনে হয় একেকটি দৈত্যদানো। ঘন সবুজ আচ্ছাদনের আলখেল্লা তাদের গায়ে। দূরে, বহুদূরে পায়ে হাঁটা পথের মতো রেখা। এই রেখা ধরে চোখ গিয়ে যেখানে থিতু হয়, দু-একটি বসতি জেগে আছে সেখানে। পাহাড়ের গহিন অরণ্যেও জাগে প্রাণ। এখানেও দিনের শেষে রাত নামে। ঘুমের দেশে ঢলে পড়ে মানুষ। তারাও নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখে। বন্য প্রাণী, বিশেষ করে বুনো হাতির ভয়, তবু এখানে বেঁচে থাকে স্বপ্নসারথিরা। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, মন্দ কি হতো এই পাহাড়ে বসতি হলে? কোলাহলমুক্ত নগরজীবনকে ছুটি দিয়ে যদি ঢেরা ফেলা যেত এখানটায়। আহ্! প্রতিবেশী পাহাড়ের সঙ্গে কত গল্প জুড়ে দিত মন। বিশালের মাঝে ক্ষুদ্র প্রাণ হয়ে বেঁচে যেতাম বহুকাল, হয়তো। মনে পড়ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই লাইনগুলো—

‘অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।

কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।

যদি তার দেখা পেতাম,

দামের জন্য আটকাতো না।

আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,

সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।’

সূর্যটা সেই কবেই নেমে গেছে পাহাড়ের আড়ালে। হলদে-লাল আভাও কেটে গেছে প্রায়। এখানে সন্ধ্যা নামে পাহাড়ের চূড়া বেয়ে সমতলে। সময় হলো ফেরার। আয়োজক দলের সদস্য আহমেদ আল-আমিন ভাই, আকিদুল ইসলাম দুবার ডেকে গেলেন, ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা সঙ্গীদের। নীলগিরির দুয়ারে অপেক্ষা করছে চাঁদের গাড়ি। ঘণ্টাখানেক আগেও দেখা গেল যাদের পেঁপে, পাহাড়ি তেঁতুল, কলার পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে, তাদের অনেকেই রওনা হচ্ছেন বাড়ির পথে। পিঠে বাঁশের বড় ঝুড়ি, শক্ত দড়িতে বাঁধা কপালে। শেষ মুহূর্তে পসরা গোছাচ্ছিলেন এক বুড়ো। তার কাছ থেকে কয়েকটি পেঁপে আর এক বোঝা তেঁতুল কিনে গাড়িতে চড়লেন ইমরান। ফেরার পথে সেই তেঁতুল সিটের নিচ দিয়ে চালান হয়ে গেল হাতে হাতে। জাভেদের কল্যাণে। ইমরান চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন। ভাবছিলেন, আর কেউ তেঁতুল কিনেছে বলে দেখেননি তিনি। তাহলে সবার হাতে হাতে কোথা থেকে? তেঁতুল দেখে শক্ত হয়ে এলো চোয়াল। জিহ্বা কি, মুখ ভরে গেছে জলে। কিন্তু যারা চুপিচুপি তেঁতুলের স্বাদ নিতে ব্যাকুল, তাদের মুখের মানচিত্র পাল্টে যেতে সময় লাগল না খুব। ওরেব্বাস! এ জন্যই হয়তো বলে, ‘বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল।’ গা শিউরে ওঠা টক!

 

এখানে রাত নামে পাহাড়ের চূড়ায়

স্বল্প সময়ের ভ্রমণকে হর্ষময় করার সব ধরনের চেষ্টাই ছিল আয়োজকদের। রাতে পাতে ছিল চায়নিজ রসনা। বারবিকিউ। আর ছিল পার্বত্য অঞ্চলের নাচ-গানে মুখর সন্ধ্যা। স্থানীয় শিল্পীদের গলায় নিজেদের ভাষার গানের পাশাপাশি ছিল জনপ্রিয় গানও। পাহাড়ি পোশাকে সেজেছিলেন শিল্পীরা। কৃত্রিম লেকের ওপর ঝুলন্ত রেস্তোরাঁ হয়ে উঠেছিল উৎসব কেন্দ্র। আমরা কজনা অবশ্য খানিক ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বান্দরবান শহর পরিক্রমায়। আলিফ, আসাদ, রোহান আর তানভীর। গাড়ির চালকের আসনে আলিফ। বেশ দক্ষ চালকই বটে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ তার একেবারেই হাতের মুঠোয়। গাড়ি চলল, শহরের মাঝ দিয়ে।

বুদ্ধ ধাতু জাদির (স্বর্ণমন্দির) গা-ঘেঁষা পথে বালাঘাটার বাকীছড়া গন্তব্য। সেখানে স্থানীয় এক দোকানের সামনে থামল গাড়ি। আলিফ দিল অসাধারণ এক খাবারের সন্ধান। টক দই দিয়ে চিড়া। সঙ্গে নারকেল, চিনি আর কলা। টক দই দিয়ে চিড়ার স্বাদ আস্বাদন এটাই প্রথম। এককথায় অমৃত। ফেরার পথে আরও একদণ্ড জমল গাড়ির চাকা। অপূর্ব এক দৃশ্য ধরা দিল চোখে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে রংবেরঙের আলোকসজ্জা। মনে হচ্ছে, উজ্জ্বল একটি ক্রিসমাস ট্রি। এখানে রাত নামে পাহাড়ের চূড়ায়। অপরূপ এই দৃশ্য কোনো শব্দে, বাক্যে প্রকাশ করা যায় না। উঁচু থেকে রাতের বান্দরবান দর্শন শেষে আমরা ফিরলাম উপজাতি পাড়ার ভেতর দিয়ে। পথে পড়ল পার্বত্য অঞ্চলের বুদ্ধ ধর্মীয় গুরু উ চ হ্লা ভান্তের নিবাস। সদর দুয়ার থেকে চোখে পড়ছে আলোকসজ্জা। ধর্মীয় এক আবহ বাড়িজুড়ে। স্বর্ণমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। আলিফ জানাল, উ চ হ্লা ভান্তে একসময় বিচারক ছিলেন। পরে ১৯৯০ সালের দিকে চাকরি ছেড়ে নিবেদিত হন ধর্মসাধনায়। গড়েন দ্য ওয়ার্ল্ড বুদ্ধ শাসন সেবক সংঘ, বুদ্ধ ধাতু জাদি (স্বর্ণমন্দির) এবং রাম জাদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।

পথে ক্ষণিকের জন্য হাজির হলাম সচিত্র মৈত্রীর সকাশে। বান্দরবান থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা। সম্পাদক অধ্যাপক ওসমান গনি। সহকর্মী-বন্ধু আলিফের বাবা। খালি মুখে ফিরে আসতে দেবেন না তিনি। ধরেছেন খুব করে। শেষে পরদিন সকালে দেখা হবে, ন্যাচারাল পার্কে, এমন আশ্বাসে মুক্তি মিলল। যদিও পরদিন আর দেখা হয়নি। সময় সংকটে ঘোরা হয়নি ন্যাচারাল পার্ক। প্রাকৃতিক আবহে গড়া পার্কটি আলিফদের পারিবারিক উদ্যোগ। শহর পরিক্রমা শেষে রাতে যখন রিসোর্টে ফিরলাম, তখনো চলছে সংগীত আয়োজন। তবে শেষ দিকে। ততক্ষণে গেয়েছেন শিল্পীরা। পরিবেশন করেছেন পার্বত্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যও। টেবিলে যখন পাত পেড়েছি, তখন মঞ্চে ইনফো পাওয়ারের নাবিলা আপু। ‘এখন তো সময় ভালোবাসার, এ দুটি হৃদয় কাছে আসার...’। তার গানেই যবনিকা অনবদ্য আয়োজনের।

 

এই ‘মেঘলা’ দিনে একলা...

পাহাড়ের গায়ে বড় বড় আমগাছ। মুকুল উতরে ছোট ছোট গুটি ঝুলছে ডালে। কোনো কোনোটায় আছে মুকুলও। ঝরে গেছে বৃষ্টিতে। যতটুকু আছে, তাতেও কম নয়। ভ্রমণের শেষ দিন পাহাড় দর্শনে গন্তব্য মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র। তৈরি হয়ে সবাই ছিল বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। দেরি হচ্ছিল বাস আসতে। ইনফো পাওয়ারের অনন্যা আপুর কাছে অভিযোগও করছিলেন কেউ কেউ। বেড়াতে এসে বসে থাকতে ভালো লাগে কার! অপেক্ষার পালা ফোরাল রিসোর্টের দুয়ারে এসে ভিড়লে গাড়ি। তড়িঘড়ি উঠে পড়লেন সবাই। যে যার আসনে। নীলরঙা বাস দুটো ঢিমেতালে গিয়ে থামল মেঘলার দুয়ারে। গোছানো এই পর্যটন কেন্দ্রে ওপর থেকে নেমে যেতে হয় নিচে। পথটি বেশ রোমাঞ্চকর। খাড়া পথ। ঢুলতে ঢুলতে নামতে লাগলেন সবাই। সে অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা। শরীরের ভারসাম্য রেখে হেঁটে যাওয়া, শূন্যে হেলান দিয়ে।

মেঘলায় প্রাকৃতিক লেকের ওপর আছে ঝুলন্ত দুটি সেতু। বড়টি দিয়ে পার হয়ে যেতে হয় ওপারে। যেখানে আছে ক্যাবল কার। অন্যটি ছোট। খুব একটা গতায়াত নেই মানুষের। লেকের স্বচ্ছ সবুজ জলে আছে বোটিংয়ের সুযোগ। ঝুলন্ত সেতুতে পারাপারেও পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড়। দুপাশে মানুষের ঢলে দুলছে তো দুলছেই। সেতুর ঠিক মাঝখানটা একটা বড় দোলনার মতো। রেলিং না ধরে ফেলা যায় না এক পা-ও। মেঘলায় সব থাকলেও এক টুকরো মেঘের দেখা মিলল না। খাঁ খাঁ রোদ। গিলে খাচ্ছে সব। চিটপিটে গরম। কেবল ঝিলের জলে তাকালে প্রশান্তি মিলে হৃদয়ে। কী টলটলে জল! তাতে ভাসছে বেশ কয়েকটি বোট। চঞ্চল হয়ে উঠল মন। সাদ্দাম ও ইউসুফ ভাইকে সঙ্গী করে নেমে পড়লাম বোটিংয়ে। দুজন আগে-পিছে, মাঝে আমি। ফাইবারের নৌকো ভাসছে হাওয়ায়। বৈঠাগুলো হাঁসের পায়ের আদলে। জলের বুকে ঘাই দিলে চ্যাল চ্যাল করে ভাসে নৌকা। পশ্চিম থেকে বাইতে বাইতে নৌকা গেল পুবে। ইউসুফ ভাইয়ের মুঠোফোনে তখন, ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলায় নেব সখী তোমার কানের সোনা, সখী গো ও আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি...।’ আমরা তাল মেলাতে মেলাতে পুব থেকে বেয়ে গেলাম উত্তরে। সেখান থেকে দখিনে এসে ভিড়িয়ে দিলাম নাও। চলছে হাঁকডাক। ফুরিয়ে এলো সময়। রওনা হতে হবে ঢাকায়। তার আগে মধ্যাহ্নভোজ। একটি দলীয় ছবি বন্দি হলো ফ্রেমে। সময় যেন কেটে গেল, ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে। ডাকছে কর্মব্যস্ত নগর। ফিরতে হবে রাত ঘন হওয়ার আগে।

(ঢাকাটাইমস/২৮ এপ্রিল/এইচএফ)