ভ্রমণ

জার্মানির নিউশওয়ানস্টেইন ক্যাসেল প্রেমহীন নগরে রোমান্সের উত্তাপ

প্রকাশ | ২৮ এপ্রিল ২০২২, ১০:৩৫ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২২, ১২:৫৭

ইমদাদ হক

গাড়ির মৃদু ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকাই, সামনে বিশাল পাহাড়। আমাদের গাড়ি যেন ঢুকে যাচ্ছে সেই পাহাড়ের পেটের ভেতর। নৈসর্গিক দৃশ্য। সবুজ প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে পাকা রাস্তা। যে রাস্তা দিয়ে শাঁ শঁাঁ করে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। সামনে যতই এগোই, পাহাড় ততই কাছে আসে। দু চোখ কচলে নেই, ঠিক দেখছি তো!

রোদের আলোছায়ায় পাহাড়ের বুকে সৃষ্টি হয়েছে কালচে রঙের অবয়ব। পাহাড়ের ঘাড়ের ওপর সাদা তুষারের স্তূপ। তার মাঝে লালচে রঙের ভবন। জার্মান চিত্রশিল্পী কিমো ফন রেকভস্কির যত্নের শিল্পসৃষ্টির প্রতিরূপ! প্রকৃতির নয়নাভিরাম ফ্রেমের মাঝে রং, ধ্বনি আর আলোর প্রতিফলনের দারুণ প্রতিবিম্ব। এবার সত্যি করেই আঙুলে চিমটি কাটি, ব্যথা লাগে। এর অর্থ সুস্থ আছি, জেগেই আছি। আমরা ঠিক কোথায় যাচ্ছি তখনো জানি না।

জার্মানির মিউনিখে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী ‘মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স’। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের নেতৃত্বে একটি দল। সেই দলের আমি একজন সদস্য। সম্মেলনের এক ফাঁকে আমাদের ঘোরাঘুরির আয়োজন।

ছোটখাটো এই সফরের পুরোটাই প্রোগ্রাম দিয়ে ঠাসা। অল্প সময়ে তাই পরিকল্পনা মিউনিখ শহরটি ঘুরে দেখার। গাড়িতে ওঠে বসার আগ পর্যন্ত তাই জানি। গাড়ি চলতে শুরু করল, কখন যে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেছি! তন্দ্রাচ্ছন্নভাব কেটে গেলে দেখি শহরের বদলে পাহাড়ের সারি। জবাব পাই ড. রুবাইয়াত ইসলাম সাদতের কাছ থেকে। অতিরিক্ত যানজটের কারণে শহর ঘুরে দেখার কর্মসূচি পরিবর্তন হয়েছে। আমরা যাচ্ছি নিউশওয়ানস্টেইন ক্যাসেলে। এর অবস্থান শোয়ানগাউ প্রদেশে। বুয়েটের সাবেক এই শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানি আসেন। পরে চাকরি জুটিয়ে সেখানেই থিতু হন।

২.

সড়কের দুপাশে সবুজ মাঠ। মাঝে সবুজ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে হলুদ ও সাদা ফুলের বাহার। আগাছা ও ফুলের মিশেলে সবুজ তৃণভূমির বিশাল আস্তরণ। দূরে কোথাও পাতাবিহীন ইন স্টার্ক আইস নামের শক্তিশালী ওকগাছ। নির্দিষ্ট দূরত্বে একাকী দাঁড়িয়ে বসন্তের প্রহর গুনছে, অপেক্ষা দখিনা বাতাসে সবুজ পত্রপল্লবের শোভার মাতম সৃষ্টির।

মিউনিখ শহর থেকে নিউশওয়ানস্টেইন ক্যাসেলের দূরত্ব ১২৮ কিলোমিটার। গাড়িতে সময় লাগে দু ঘণ্টার মতো। সড়কের দুপাশে তৃণভূমি। মাঝেমধ্যে গরুর পাল। আপনমনে ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছে গরু। লাল, সাদা, সাদাকালো, খয়েরি রঙে একই বাংলাদেশের গরুর মতোই। তবে আকারে ভিন্নতা ঢের, এক্কেবারে ঢাউস সাইজের। স্বাস্থ্যে পুষ্ট আর উঁচু লম্বা। গরুর গা-ভর্তি যেমন মাংস, তেমনি ওলানভরা দুধ। গরুর পালের আশপাশে সবুজ মাঠের বুক চিড়ে দাঁড়িয়ে একটা দুটা করে ঘর। ইউরোপীয় কায়দায় তৈরি ঘরের বেশির ভাগই একতলা বা দুইতলা। ড্রাইভার বেনেডিক্ট সেদান জানালেন, ‘এসব ঘরে রাখালরা থাকে। সকালে গরু ছেড়ে দেয় মাঠে। নিজেদের মতো করে টইটই করে ঘুরে বেড়ায়, খাওয়াদাওয়া করে। দিন শেষে রাখাল গিয়ে ঘরে নিয়ে আসে।’

‘রাতের বেলায় গরুর পালকে রাখে কোথায়?’

‘ওই যে দূরে গ্রামের মতো দেখছ, ওগুলো কৃষকদের গ্রাম। সেখানে গরুর খামার আছে।’

সড়ক থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে কৃষকের গ্রাম। লাল-নীল বা সবুজ রঙের ঘরবাড়ি। সব একতলার বাড়িঘর। জব বা গমের শস্যক্ষেত পার হয়ে দৃষ্টি চলে যায় এসব বাড়ির ছাদে। বাংলাদেশের রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাইলের পর মাইল সরিষাক্ষেতের মতো। সব ছাপিয়ে দূরে সাদা, নীল, আকাশি বা কলাপাতার রঙের আকাশ। স্বচ্ছ আকাশে দাদু বুড়ি যেন বসে আছেন কতকাল ধরে! নাকি নদীর তীর বা সাগরপাড়ের স্পষ্ট অবয়বই বুঝি দেখা মেলে গগনের প্রান্তে। মনে হয়, জাহাঙ্গীরনগরের পাশে বিরুলিয়া বিলের আকাশেরই হুবহু প্রতিচ্ছবি। দুনিয়ার সব দেশের আকাশের দৃশ্য কি একই রকম!

জার্মানির সমতল জমিতে গম, শাকসবজি, সিরিয়াল আর চিনির বীটের চাষ করা হয়। সবজির মধ্যে রয়েছে গাজর, ওটস, পেঁয়াজ। আঙুর, আপেল, ট্রিটিকেলের মতো ফল উৎপাদনে বিশে^র শীর্ষ তালিকায় রয়েছে জার্মানি। সামনে যে পাহাড়, তার পাদদেশে শাকসবজি জন্মে। শূকর আর গরুর পালের জন্য পাহাড়ি অঞ্চলই বিখ্যাত। সব বড় শহরেই রয়েছে ফলের বাগান আর সবজির ক্ষেত। ওয়াইন চাষের জন্য নদ-নদীর উপত্যকা প্রসিদ্ধ। দেশটির বর্তমান লোকসংখ্যা সোয়া আট কোটির মতো। সেখানে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত মাত্র ১০ লাখের কাছাকাছি। জার্মানিতে কৃষিতে উৎপাদন, বিপণন, ভর্তুকি, দ্রব্যমূল্য বাড়বে কি কমবেÑসব ঠিক হয় একটি নির্ধারিত পলিসি দিয়ে। এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ব্রাসেলসে, যা মেনে নেয় সব ইউরোপিয়ান দেশ।

 

৩.

যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, তা বাংলাদেশের কালো পিচের কার্পেটিংয়ের মতো নয়। কেমন একটা ধূসর রঙের। সড়কের মাঝে মাঝে ঝকঝকে বিভাজক। মাঝখানে লাগানো ফুল গাছ। পুরো সড়কের কোথাও কোনো গর্ত নেই, পুরোটাই মসৃণ। এই সড়কে গাড়িতে বসে আরামে বই পড়া যায়। বিভাজকের ওপর বা রাস্তার দুপাশে লাগানো ফুলের গাছগুলোও মানানসই। বনসাইয়ের মতো গাছগুলো সব একই মাপের। বাংলাদেশের রাস্তা খানাখন্দে ভরা। ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ সড়কেই গর্ত, উঁচুনিচু, এবড়োখেবড়ো। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তাই সড়ক উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপের কথা প্রায়ই বলতে হয় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের রাজনীতিকদের। চলচ্চিত্র নায়িকার গালের মতো মসৃণ সড়ক তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায়ই হাস্যরসের সৃষ্টি করেন সেই দেশের রাজনৈতিক নেতারা। ২০২১ সালে ভারতের রাজস্থানের পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী রাজেন্দ্র সিং নায়িকা ক্যাটরিনা কাইফের গালের মতো মসৃণ রাস্তা তৈরির ঘোষণা দেন। একই বছর একই রকম ঘোষণা আসে ঝাড়খণ্ডের কংগ্রেস বিধায়ক ড. ইরফান আনসারির কাছ থেকেও। তিনি রাস্তা বানাতে চান নায়িকা কঙ্গনা রানাওয়াতের গালের মতো করে। এর আগে বিহার রাজ্যের সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের ঘোষণা ছিল, বিহারের সব সড়ক হবে হেমা মালিনীর গালের মতো মসৃণ। তবে বাস্তবে ফল মেলেনি, ভাঙাচোরা রাস্তার দুর্ভোগ আর কমেনি।