বইপত্র

বইয়ের জীবন, জীবনের বই

প্রকাশ | ৩০ এপ্রিল ২০২২, ১০:৫৯

কুমার চক্রবর্তী

কেন আমরা বই পড়ি, এর উত্তর হয়তো এই, বইয়ের মধ্যে আমরা নিজের জানা এবং অজানা জগতের খোঁজ করি । নিজের জানা বিষয়কে দৃঢ়ীকরণ করি আবার অজানা এলাকাকে জানা এলাকায় আনার চেষ্টা চালাই। এই অর্থে গ্রন্থরচনা ও গ্রন্থপাঠ মানে এক অভিযান, অন্তর্দেশে অভিযান। এই অভিযানকারী প্রথমত লেখক, পরত্র পাঠক। আমাদের আছে এক জীবন, কিন্তু গ্রন্থে থাকে দুই জীবন। দুই জীবন নিয়ে গ্রন্থের এক যুগ্ম জীবন। গ্রন্থকে জীবন দান করেন লেখক ও পাঠক, আবার তাঁরাও গ্রন্থের কাছ থেকে নতুন জীবন পান। বই তাই আমাদের জীবনের প্রতিস্ব। আমাদের জীবনের পুনর্নির্মাণকারী। বইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক বাইনারি। আহা বই আমার!

২.

প্রায় সারা জীবনই বই কিনেছি আমি, কিছুটা অভ্যাসবশে হলেও এখনো কিনে চলেছি। লেখা শুরু করার বহু আগ থেকেই, বলা যায় স্কুলের উচ্চ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই চলছে এই কেনাকাটা।  এ যেন এক মায়াপ্রপঞ্চ, এক মাধুকরি।  কিন্তু কেন, কেন কিনে গিয়েছি বই? বই সম্বন্ধে  কোনো পবিত্র ধারণার বশবর্তী হয়ে? না, তা নয়। ‘আদিতে ছিল শব্দ, আর শব্দ ছিল ঈশ্বরের সাথে, আর শব্দই ছিল ঈশ্বর’, বা ‘শব্দই ব্রহ্ম’ বা ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে’ ইত্যাদি  থেকেই সম্ভবত বইবিষয়ক পবিত্র ধারণার উদ্ভব। অর্থাৎ শব্দপবিত্রতা থেকেই অনেকাংশে বইপবিত্রতার জন্ম, যেহেতু বই শব্দের ধারক। ‘রিলিজিঅন অব বুক’ বাদ দিলেও, সব যুগে, সব স্থানেই বইয়ের সাথে পবিত্রতা বা ঈশ্বরসূত্রতার বিষয়টি ছিল। রোমানরা গ্রিক পুরোহিতদের দৈববাণীসমৃদ্ধ ‘সিবিলিন বুক’কে ভক্তি করত।  গ্রিকদের মধ্যে পবিত্র পুস্তক বা টেক্সটের ধারণা না থাকলেও তারাও হেসিয়দ বা হোমারের গ্রন্থকে পবিত্রতার কাছাকাছি কিছু একটা ভাবত। আমরাও ছোটবেলায় দেখতাম, বই মাটিতে পড়ে গেলে তা উঠিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে (কখনো মাথায় বা বুকে ঠেকিয়ে) যথাস্থানে রাখা হতো। সরস্বতী পূজার দিন বইগুলোর ভেতরে পুষ্পাঞ্জলির কিছুটা রেখে দেওয়া হতো।

বই সম্পর্কে পবিত্র ধারণার সংস্কারের মধ্যে থেকেও বইকে আমি গুরুত্ব দিতাম এ কারণে যে, সত্যিকার অর্থে বইয়ে আমি শারীরিকভাবে স্থির হতাম, বাইরের হট্টগোল আর মানুষ থেকে নিজেকে দূরে রেখে আত্মকেন্দ্রিকতাকে উপশম দেওয়ার জন্যই আমি একটি প্রতিন্যাস সৃষ্টি করতে চাইছিলাম মনে মনে। প্রয়োজন হতো নিজেকে আড়াল করার, তারই উপায় হিসেবে হয়তো ঢুকে পড়েছিলাম বইয়ের রহস্যবিশ্বে। বই ছিল, হয়তো এখনো, বাইরের পৃথিবীকে প্রত্যাখ্যানের বা মুখোমুখিতার বা সামাল দেওয়ার এক বর্ম । হয়তো মন্থরতার যে দর্শন আমার ভেতরে জন্ম নিয়েছিল, বই তাকে জল-হাওয়া জোগাত।

সপ্তাহে দুই দিন আজিজ মার্কেটে গিয়ে বই না দেখলে ভাত হজম হয় না। আগে যেতাম নিউ মার্কেটেÑ জিনাত-এ, খুব ভালো ইংরেজি বই পাওয়া যেত সেখানে। তারও আগে স্টেডিয়ামের ম্যারিয়েটায়। পরে যখন বাইরে যাওয়ার সুযোগ হলো তখন আরেক দুনিয়ার সন্ধান পেলাম। কী বিশাল বইয়ের দোকান! একবার লন্ডনে গিয়ে ফয়েলসের প্রধান শোরুমে কাটিয়ে দিয়েছিলাম পুরো একটি দিন। বাইরে গেলে হন্যে হয়ে খুঁজি বিরল বইগুলোÑ বর্ডার্স, কিউকোনারাইয়া, ফয়েলস-এ, বা কলেজ স্ট্রিটে। কিছু পাই কিছুবা অর্ডার দিতে হয়।  কয়েক বছর আগে লন্ডনে গিয়ে শুনি যে বর্ডারস উঠে গেছে।

চাকরি সূত্রে বাইরে যখন ছিলাম তখন এক-দুই সপ্তাহ পর ঢাকায় এসে বোঝাই করে বই নিয়ে যেতাম, পড়ার আগে টাটকা বইগুলোর গায়ের গন্ধ নিতাম, কী অদ্ভুত আর উত্তাপগ্রাহী ছিল সেই অভিজ্ঞতা। যে বই টাকার অভাবে বা সিদ্ধান্তহীনতায় কেনা হতো না, তার চিন্তাও আমাকে গ্রাস করে রাখত। এখনো এ অভ্যাস রয়ে গেছে। বই পড়তাম ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে, যেন তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে না যায়। কিছুক্ষণ পড়ার পর বইটি গুটিয়ে রাখতাম আর ভাবতাম অন্তর্বস্তু নিয়ে। কখনোই পৃষ্ঠা ভেঙে রাখতাম না, ফলে পরে আনুবৃত্তিক পাঠ বের করতে কিছুটা সময় লাগত। তারও একটি পদ্ধতি ছিল আমার। পাঠ্যবইটি রেখে দিতে চাইতাম নতুন করে, ছোট্ট দাগও ফেলতাম না, রেখাঙ্কিত করার তো প্রশ্নই ছিল না। ফলে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় অংশ যখন খুঁজে বের করতাম, তা ছিল পুনরাবিষ্কারের মতোই এক আনন্দের ব্যাপার।

শোপেনহাওয়ার আমার প্রিয় দার্শনিকদের অন্যতম, তার মানে তাঁর দর্শন যে আমি সর্বৈব সমর্থন করি তা নয়, তাঁকে পছন্দ করি তাঁর নান্দনিক ও সহজবোধ্য ভাষার জন্য, জার্মান তথা বলা যায় পৃথিবীর দর্শনকেই পাঠযোগ্য করেছেন তিনি। তাঁর একটি রচনায়Ñ‘অন বুকস অ্যান্ড রাইটিংস’-এ যা রয়েছে তাঁর এসেইস অ্যান্ড অ্যাফোরিজম গ্রন্থেÑ তিনি বলেছেন, বই লেখকের চিন্তার প্রতিরূপ ছাড়া বেশি কিছু নয়। এসব চিন্তার মূল্য রয়েছে হয় বিষয়ে যা লেখক  ভেবেছেন, বা রচনাশৈলীতে, অর্থাৎ যেভাবে বিষয়কে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার মানে যেভাবে লেখক চিন্তা করেছেন। শোপেনহাওয়ারের কথা ধরে আমরা বলতে পারি, বইয়ের মাধ্যমে অসংখ্য চিন্তাকে আপনি পাচ্ছেন আপনার মাথার কাছে, যা মাথায় প্রবেশের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বইয়ের পক্ষে বলতে গিয়ে জাক দেরিদা বলেছেন, একজন যা ভালোবাসে এবং ভালোবেসে আসছে, যা ভালোবাসতে শিখেছে বা তাকে শেখানো হয়েছে ভালোবাসতে, তা পরিহার করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বই বসবাস করার, বেঁচে থাকার, আতিথেয়তা দেখানোর মাধ্যম। দারিদা ভালোবাসা অপ্রয়োজনীয় হলেও তাকে রক্ষার কথা বলেছেন। আমরাও বলতে পারি, বই হলো পাঠের এক  বিমা। বই থাকা মানে পাঠ থাকা, বই পাঠকে নিশ্চিত করে। আর বই তা করে থাকে দুভাবে: আরোহী ও অবরোহী। প্রয়োজন থেকে বই কিনি আমরা, আবার  বই নিজেই প্রয়োজন সৃষ্টি করে। আর একটি কথা, দার্শনিকের উক্তির মতো শোনালেও বলতেই হয়, বই হলো মৃত্যু থেকে পালাবার এক আশ্রয়, এমনকি মৃত্যুবিষয়ক বই পড়েও তা করতে চাই আমরা। মৃত্যুকে যে আমরা মেনে নিতে পারি না, সেই বেদনা থেকেই সৃষ্টি হয় চিন্তার, আর চিন্তার চিরন্তন ধারক হলো গ্রন্থ। এ চিন্তা থেকে মানুষকে ভুলে থাকতে হয়। ফলে মৃত্যুতে মোকাবিলার জন্য সে সৃষ্টি করে নানা প্রতিচিন্তা। নতুবা তাকে হতে হতো পাগল। এছাড়াও সাংস্কৃতিক চর্চার অংশ হিসেবে বই পালন করে বিশাল ভূমিকা। সংস্কৃতির প্রয়োজন কেন? কারণ সুখ ব্যাপারটা ইন্দ্রিয়ই শুধু নয়, চিন্তাগতও। গ্রিক একটি প্রবাদ আছে যে, প্রাণ হলো প্রকৃতির উপহার আর সুন্দর জীবন হলো জ্ঞানের।

সেই কবে কুমিল্লা শহরে প্যানোরমা বা রহমান ব্রাদার্স বা বইঘর থেকে বই কেনা শুরু করেছিলাম মুক্তধারার পেপার ব্যাক সিরিজের বইগুলো। সেই সূত্রেই পড়ে শেষ করেছিলাম বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সব উপন্যাস। আরেকটি দোকান আমাকে টানত, রেল স্টেশনের সেই বুক স্টলটি যেখানে একদিন পেয়ে গিয়েছিলাম লরেন্সের লেডি চার্টালিস লাভার-এর বাংলা অনুবাদটি, কেনার পর যা লুকিয়ে রেখেছিলাম বুকশেল্ফের পেছনে, যেন বড়োরা না দেখতে পায়, কিন্তু দেখে ফেলেছিল। কিছুই বলেনি আমাকে, শুধু তাদের মুখ ভিন্ন এক বেদনার্ত  নিস্তেজনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল ক্ষণকালের জন্য। তখনই তারা হয়তো বুঝতে পারল যে আমি সাবালক হয়ে গেছি। সুতরাং বলা যায় একটি বই-ই আমাকে প্রাপ্তবয়স্কের সনদ দিয়ে বসেছিল। রেল স্টেশনের সেই দোকানটিতেই পেয়েছিলাম দস্তইয়েভস্কির বঞ্চিত লাঞ্ছিত উপন্যাসটি। সেই প্রথম পরিচয় দস্তইয়েভস্কির সাথে।  উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসটা আমাকে যেন বিবশ করে রাখল অনেক দিন। এখনো মনে আছে চরিত্রের নামগুলো: ভানিয়া, নাতাশা, নেল্লি, আলিওশা...। মনে পড়ছে উপন্যাসের শেষটা:  ‘‘সব, সবকিছু,’’ নাতাশা বললে, ‘‘গত বছরটার সবকিছুই। তোমার সুখ আমি কেন নষ্ট করেছিলাম ভানিয়া?’’ ওর দু চোখে লেখা: ‘‘চিরকাল সুখী হতে পারতাম আমরা দুজনে।’’ 

কখনো কোনো বই চুরি বা অফেরত করিনি আমি, শুধু একটি বই ছাড়া। সেই বইটা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে আমার কাছে এবং এখনো শ্রেষ্ঠতম বই: রণেশ দাশগুপ্ত সম্পাদিত জীবনানন্দ কবিতা সম্ভার। বইটি আমার এক বন্ধুর বাসায় পেয়ে নিয়ে আসলাম, আর ফেরত দিলাম না। জীবনানন্দ দিয়েই আমার কবিতার ভালোলাগার নোঙর, আর তখন আমার প্রিয় কবিতা ছিল ‘লোকেন বোসের জার্নাল’। কারও বই আমি মেরে দিইনি বলতে গেলে, শুধু সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতাসমগ্র বইটি ছাড়া। যা আমি এক বন্ধুর কাছ থেকে এনে মেরে দিয়েছিলাম। বইটি ছিল ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের,  বন্ধুর বড়ভাই পড়ত সেই কলেজে, সেই সূত্রে বইটি বন্ধুটি পেয়েছিল। মনে আছে কলেজে পড়ার সময় আমাদের এক বন্ধু বলেছিল তার কাছে পথের পাঁচালী আছে। যেই বলা আমিও নাছোড়। পিছ নিলাম তার, তার বাসার সামনে পাক্কা এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে পেলাম বইটি। আনন্দে কাঁপতে কাঁপতে বাসায় এসে খুলে দেখলাম বইটির শেষ দিকের কিছু পৃষ্ঠা নেই। কী যে দুঃখবোধ জন্মাল। তবু ধীরে ধীরে বইটি পড়লাম। বই আর বই। এ এক অভিযাত্রা যেখানে বই পালন করছে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা। কত বই, কত লেখক: কবি, দার্শনিক, কথাসাহিত্যিক, বিজ্ঞানলেখক, নাট্যকার এবং ঈশ্বর। হ্যাঁ, ঈশ্বরও লেখক, লিখেছেন কত না বই। বলা যায়, বইয়ের শর্তহীন পরাবর্তে আমি আটকে আছি। মনে পড়ে সার্ত্রের কথা। তিনি বলেছিলেন, জীবনের প্রথম তিরিশটি বছর বই দিয়েই পৃথিবীকে জেনেছিলেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রেও দেখা যায় বই। মদ্ভাগবতগীতা তো যুদ্ধক্ষেত্রেই রচিত। একসময় যুদ্ধক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিও থাকত। রিলকের প্রেমগাথা ও কর্নেট ক্রিস্টোফার রিলকের মৃত্যু কবিতা-বইটি সৈনিকেরা যুদ্ধক্ষেত্রে সঙ্গে নিয়ে যেত।

বেশ কিছুদিন আগে, ২০০৮ সালে দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে  একজন ভবিষ্যদ্বাণী বলেন যে, আগামী পনেরো বছরের মধ্যে চারটি বিশেষ বাস্তবতা পৃথিবীকে  দারুণভাবে বদলে দেবে: প্রথমটি হলো, তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম হবে ৫০০ মার্কিন ডলার, দ্বিতীয়টি, জলও তেলের মতো বাণিজ্যিক পণ্য হয়ে উঠবে এবং শেয়ার বাজারে দরদাম চলবে তার, তৃতীয়টি হলো আফ্রিকার অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে অনিবার্য আত্মপ্রকাশ আর চতুর্থটি হলো বইয়ের অন্তর্ধান। এই পেশাদারী ভবিষ্যৎ বক্তার কথা যদি ফলে, তাহলে এক দিক থেকে রক্ষা হয় যে নতুনভাবে বই কেনার আর সম্ভাবনা থাকবে না। কিন্তু ওই বক্তার ভবিষ্যদ্বাণীর পর আট বছর গত প্রায়, বই বিলুপ্তির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।  তবু প্রশ্ন তাই থেকে যায়, বই কি তা হলে পড়ার মাধ্যম হিসেবে চলতে থাকবে নাকি অন্য কোনো মাধ্যমের আবির্ভাব ঘটবে? এ বিষয়ে উমবের্তো একো বলেছেন, বই হলো চামচ, হাতুড়ি বা কাঁচির মতো, একবার আবিষ্কারের পর তার আর তেমন উন্নয়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সাফল্য অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। বই বিলুপ্তির যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় তা এসেছে ইন্টারনেটের কারণে বা মূলত ই-পাঠের বিষয়। এক সময় সিনেমা, রেডিও বা টেলিভিশনকেও ভাবা হয়েছিল বইয়ের ঘাতক। কিন্তু এগুলো বইকে মোটেই ধর্মচ্যুত করতে পারেনি। একো আরও মনে করেন, বই হলো চাকার মতো, আদ্দিকালের চাকা আর আধুনিক চাকা মোটের ওপর একই। কিন্তু তার আগে আমরা ভাবতে পারি, বই লেখারই বা কী প্রয়োজন? চিন্তা বা তথ্য বই ছাড়া অন্য কীভাবে উপস্থাপন বা সংরক্ষণযোগ্য তার যদি সমাধান পাওয়া যায় তাহলে বই মাধ্যমটির অবসান হলেও হতে পারে। কিন্তু সেটি অন্য বিবেচনা। প্রযুক্তি বইকে প্রতিস্থাপিত করবে বলে আমার মনে হয় না। বই আসলে আমাদের মানসিক অভ্যাসের একটি বিষয়। প্রযুক্তি এমনভাবে কোনো কিছুর আবির্ভাব ঘটায় যেন তা দু-এক বছরের মধ্যেই বাতিল হয়ে যায় এবং তার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বই প্রযুক্তি নয়। তা প্রযুক্তিকে ব্যবহারও করে খুব কম আকারে। আগের কাল আর বর্তমান কালের প্রধান পার্থক্য হলো, আগের কাল ছিল স্থির, আর বর্তমান কাল পরিবর্তনশীল। ফলে মাধ্যমগুলোর ব্যাপারে আমরা উৎকণ্ঠায় থাকি। বইয়ের ব্যাপারে এই উৎকণ্ঠা আরও বেশি, কারণ এর সাথে জড়িত আছে পবিত্র বা বিশুদ্ধ বা জ্ঞানের আকরতা-বিষয়ক যৌথ অবচেতনিক ভ্রমবাতুলতা। কিন্তু একটা গভীর সত্য হলো, এখন যে বই আমরা দেখি তার আবিষ্কার হলো আমাদের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার, কারণ এর ফলেই নিশ্চিত হয়েছিল পাঠের সর্বজনীনতা। তার আগে যেভাবে বই ছিল তা কখনোই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ পেত না। রচনা লিখতে হতো হাতে, আর অনুলিপি করতে হলে বারবার লিখতে হতো। রচনার লিখিত রূপ দেওয়া ছিল ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। উপাদান হিসেবে প্যাপিরাস জন্মাত নীল নদের ব-দ্বীপে, আনা ছিল কষ্টসাধ্য। প্যাপিরাসে লেখা স্থায়ী হলেও খোদ প্যাপিরাস টেকসই ছিল না। প্যাপিরাসের ফালিগুলো ছিল দীর্ঘ, এক ফুট প্রস্থ আর দশ গজ দৈর্ঘ্যরে এই ফালির ওপর লেখা আর যা-ই হোক আমজনতার হাতের নাগালে কখনোই আসত না। ভারতবর্ষে ভূর্জপত্রে লিখে রাখা হতো শ্লোক, সেগুলোও ছিল কষ্টসাধ্য আর যারপরনাই মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের পুঁজি।  মোদ্দাকথা, তখনকার বই ছিল মুষ্টিমেয় মানুষদের আয়ত্তে। এখনকার বইয়ের আবিষ্কারের ফলেই পাঠ হয়েছে গণমুখী, বই হয়েছে টেকসই ও ব্যক্তিক, এবং ঘরে ঘরে সংরক্ষণ উপযোগী।

 

৩.

বেশ কিছু বই সংগ্রহ করেছি বটে কিন্তু পড়া হয়ে উঠছে না। এর প্রধান কারণ পড়া এগোয় না। তারও কারণ, রচনা  শুরু থেকেই অবোধ্য, বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না।  যেমন ফিনেগানস ওয়েক। আবার কিছু বই বৃহৎ হওয়ায় খেই হারিয়ে বসি। যেমন রবার্ট মুসিলের আ ম্যান উইদাউট কোয়ালিটিস ধরে পরম্পরা রক্ষা করতে পারি না এখন। আবার হাইডেগারের বিং অ্যান্ড টাইম পুরোটা না পড়ে চুম্বক অংশগুলো পড়ি। তবে দর্শনের মূল বই পড়ার আগে ধারণাদায়ী বই পড়ে নেওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়, তারপর সেরা লেখকদের গর্ভগৃহে প্রবেশ সহজতর হয়ে পড়ে। কিন্তু ব্যতিক্রম শোপেনহাওয়ার বা নিট্শে বা কিয়ের্কেকাদ। এদের বই আমি পড়ি, বুঝতেও পারি নিজের মতো, দর্শন যে এত প্রিয়পাঠ্য হতে পারে, এই লেখকেরা না এলে তা থাকত অপরীক্ষিত। দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল অ্যান্ড রিপ্রেজেনটেশান বা দাস স্পাকে জরাথ্রুস্ট্র পড়তে অসুবিধা হয় না, হয় না বুঝতে আইদার/অর। এঁদের দর্শনের ভাষা সাধারণ শিক্ষিতের বোধগম্য। আর কিছু বই একেবারেই পড়া হয় না: অভিধান, কারণ অভিধান দেখতে হয়। আর হ্যাঁ,  চৌদ্দ লক্ষ শব্দের প্রুস্তের ইন সার্চ অব লস্ট টাইম বা রিমেমব্রেন্স অব থিংস পাস্ট পড়েছি এবং লিখেছিও, কিন্তু যুদ্ধ ও শান্তির অরুণ সোমের অনুবাদটি পড়া হয়নি। এখন বেশি দীর্ঘ উপন্যাস পড়ি না। পরম্পরা রক্ষা করার ধৈর্য রাখতে পারি না। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, পড়া কমে গেছে, পড়ার বই সংখ্যার দিক থেকে কমে গেছে কিন্তু তীব্রতার দিক থেকে নয়। প্রতিটি পড়ুয়া মানুষই শুরুর দিকে থাকে সহজাত ও সাবলীল পাঠক, কিন্তু ধীরে ধীরে সে  হয়ে ওঠে নির্বাচিত ও আত্মসংবৃত পাঠক। ফলে তার পাঠ হয় পছন্দের ও প্রয়োজনের। আবার কিছু রচনা যতটা না পড়ার জিনিস, তার চেয়ে অধ্যয়নের।  রচনাটি একটানে শেষ করা যায় না। রেড ওয়াইনে ছিপ দেওয়ার মতোই একটু একটু করে নিতে হয় তার স্বাদ, আবার অনেকবার করেও পড়তে হয় তাকে। যখনই মনে হবে এইমাত্র বুঝতে শুরু করেছি, তখনই বোধগম্যতাকে নিরেট করার জন্য পড়ে নিতে পারি কিছু ভাষ্য বা প্রদায়ী বই। মূল বইটাকে তখন মনে হবে কাছের ও প্রেমের আর নিজেকে মনে হবে বইটির সত্যিকার প্রেমিক।

বই পড়ার বিষয়ে সাবধানও হতে হয়। বিশেষত লেখকদের থাকতে হয় সচেতন। বই হলো লেখকদের জন্য উপায়, গন্তব্য নয়। বই যদি নিজ চিন্তা বিকাশে সহায়ক না হয়ে বাধার সৃষ্টি করে, তাহলে বই না পড়াই ভালো। সবসময় অন্যের চিন্তা নিয়ে মশগুল হলে নিজের চিন্তা অবিকশিত বা অর্ধবিকশিত থাকতে পারে। এজন্যই শোপেনহাওয়ার বলেছেন, ‘আমরা যখন পড়ি তখন অন্য একজন আমাদের হয়ে চিন্তা করে, আমরা তার মানসক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করি।...কেউ যদি পড়ে পড়েই সমস্তটা দিন অতিবাহিত করে...তবে সে ক্রমে ক্রমে চিন্তাশক্তিটই হারিয়ে ফেলে।’

বই সংগ্রহে মানুষ যেমন বিকারগ্রস্ত তেমনই তার ধ্বংসেও সে কম যায়নি। বঙ্কিমচন্দ্রের এক উপন্যাসে দেখা যায়, পণ্ডিত যখন বুঝতে পারলেন যে শুধু গ্রন্থকীট হওয়ার কারণে তার স্ত্রীর প্রতি মনোশারীরিক দায়িত্ব পালন করেননি তিনি, সেই  দুঃখে সারা জীবনের সংগ্রহ মূল্যবান পুঁথি গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করে দেন তিনি। এটি ছিল তার জীবনকে ফাঁকি দেওয়ার শাস্তি। এখানে  শোপেনহওয়ারের মতোই আমরা মনে রাখব, বইয়ের আগে জীবন। কিছু লেখক সমূহ অর্থহীনতা থেকে নিজের রচিত বই ধ্বংস করে ফেলার অভিলাষ ব্যক্ত করেছিলেন: র্যাঁবো তাঁর নরকে এক ঋতু ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, কাফকাও বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সব লেখাকে পুড়িয়ে ফেলতে, আর ভার্জিলও তাঁর মৃত্যুকালে ইনিদকে পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিলেন। এগুলো কি ছিল তাঁদের ধ্বংসাবাসনার স্বপ্ন! তাঁরা কি মনে করতেন যে নিজের মৃত্যুর সাথে জগতেরও মৃত্যু হয়! প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যত না বই ধ্বংস হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংস হয়েছে মানুষের হাতে। আলেকজান্দ্রিয়ার পাঠাগারের ধ্বংসযজ্ঞ  থেকে এখন পর্যন্ত সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞগুলো এ কথাকে এক মারাত্মক সত্যে উপনীত করেছে। বইয়ের ইতিহাসে এসবই হয়েছে আগুনের দ্বারা। নাৎসিরা ডিজেনারেট আর্ট বা অপজাত শিল্প আখ্যায়িত করে বোনফায়ার বা বহ্ন্যুৎসবের আয়োজনের মাধ্যমে ধ্বংস করত সব মহৎ লেখাকে। ক্রোসেডারদের হাতে জেরুজালেমের পতনের সময় ধ্বংস হয়েছে লক্ষ লক্ষ বই। ২০০৩ সালে বাগদাদে আমেরিকানদের হাতে বিখ্যাত জাদুঘরের পাশাপাশি ধ্বংস হয়েছে অনেক পাঠাগারও। এটা নতুন নয়। ত্রয়োদশ শতাব্দে মোঙ্গল ও ক্রুসেডারদের হাতে বাগদাদ নগরীর পতন হলে ধ্বংস হয় বিখ্যাত সব লাইব্রেরি। অন্ধ উন্মাদনায় হারিয়ে গেছে অসাধারণ সব চিন্তাভাণ্ডার। একটি গবেষণায় দেখা যায়, এ সময় তাদের হাতে তিরিশ লক্ষ বই ধ্বংস হয়েছিল। যে ফরাসি দেশ বিখ্যাত মুক্তচিন্তা ও স্বাধীনতার জন্য, সেখানে সরকারিভাবে বই পোড়ানো হতো: ১৭৮৮ সালের দিকে সরকারি জল্লাদেরা শুরু করে বইপত্র পোড়াতে, যা ১৮১৫ সালের পুনঃসংস্কারের পরও  চালু থাকে।

 

৪.

আমি ভাবি, আমার মৃত্যুর পর এত ভাবস্রোত সৃষ্টি  করা বইগুলোর কী হবে? যাদের নিয়ে বেঁচে আছি, যাদের কাছে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, সেই বইগুলোর কী অবস্থা হবে ভেবে আমি বিচলিতবোধ করি। শুনেছি আমাদের এক কবি মারা যাওয়ার পর তাঁর সব বই সের মাপে বিক্রি করে দিয়েছিল তাঁর সন্তানেরা। হয়তো আমার ক্ষেত্রে তা-ই ঘটতে পারে।  না-ও ঘটতে পারে।  নিজের মৃত্যু মানে জগতের মৃত্যু যদি ভাবি, তাহলে এই দুশ্চিন্তাও হাস্যকর। এউরিপিদেসের ছিল বিশাল গ্রন্থগৃহ, আরিস্তোতলেরও তা-ই ছিল যাকে প্লাতোন বলেছিলেন ‘পাঠভবন’।  আজ তা কোথায়? কিন্তু কথা হলো এ সমস্যার সৃষ্টি কেন করলাম আমি। অর্থাৎ কেন বই কিনলাম আর জমিয়ে রাখলাম!  কেনার সময় কি আমি ভাবিনি যে আমিও একদিন মরে যাব? কেন ভাবিনি? যাদের বই আমি কিনেছি,  কেনার সময় তাদের অধিকাংশই মৃত  ছিলেন শারীরিক অর্থে। জীবিত লেখকদের বই আমরা কমই কিনি কেননা মৃত্যুর পরই একজন প্রকৃত লেখক হয়ে ওঠে। জীবিতাবস্থায় চলে লেখক হওয়ার মহড়া। কিনছি মৃতদের বই আর ভাবছি আমি যে কখনো মরব না! মৃত্যুচেতনা বা অস্তিত্ববিষয়ক নিরর্থকতা তখন এলে আমি হয়তো এত বই কিনতাম না। বা ঈশ্বরের গুটিকয় বই পড়েই কাটিয়ে দিতে পারতাম জীবন। কিন্তু তা হয়নি। কিনেই চলেছি বই আর বই। অধিকাংশই মৃতদের বই। আমার মনে হয়, আমাদের অবচেতনে মৃত্যুর প্রতি এক মোহ কাজ করে। মৃতদেহ আমরা বেশিক্ষণ দেখতে চাই না কিন্তু মৃতদের গান, কবিতা, শিল্প আমরা আনন্দের সাথে উপভোগ করে যাই। কেন? আমরা জীবিতরা হয়তো মৃতদের সাথে যোগাযোগ করে যাই, তাদের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যাই তাদের লেখা পড়ে, গান শুনে বা ছবি দেখে, সার্বক্ষণিক। কারণ এ পৃথিবীতে মৃতরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, জন্মগ্রহণকারীর মধ্যে মৃতরাই অধিক। এ পৃথিবী জীবিত আর মৃতদের। যারা আজ জীবিত তারা কাল মৃত। জীবনের সকল আস্ফালন তো মৃত্যুরই বস্তু-সম্বন্ধ। তাই অস্তিত্বের পূর্ববর্তী অবস্থা পরবর্তী অবস্থার প্রতি রেখে দেয় এক অভীষ্ট ভাবনা। এটা বর্তমান  আর অতীতের এক জেলোটাইপিয়া। বইগুলো হলো জীবন আর মৃত্যুর, বর্তমান আর অতীতের, অস্তিত্বের আর অনস্তিত্বের এক ঝুলন্ত সেতু। আমি যখন মরে যাব তখন আমার বইগুলো যোগাযোগ করে যাবে জীবিতদের সাথে। বইগুলো খুব সম্ভবত হয়ে উঠবে মৃতের জীবনের সাথে জীবিতের জীবনের এক অদৃশ্য ভাবানুষঙ্গ।