থ্যালাসেমিয়ার বিস্তার রোধে প্রতিরোধ জরুরি

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
| আপডেট : ০৯ মে ২০২২, ১১:২০ | প্রকাশিত : ০৮ মে ২০২২, ০৮:৫২

থ্যালাসেমিয়ার মতো মরণব্যাধি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতেই প্রতি বছর ৮ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রক্তস্বল্পতার রোগ। এ রোগে আমাদের রক্তের ভেতরে যে লোহিত কণিকা থাকে তা ভেঙে যায়। রক্তে লোহিত কণিকার ভেতরে থাকে হিমোগ্লোবিন। এই হিমোগ্লোবিন আয়রন ও গ্লোবিন প্রোটিন দ্বারা গঠিত। আমাদের যেটা প্রধান গ্লোবিন, সেটা গ্লোবিনের দুই জোড়া চেইন দিয়ে গঠিত- আলফা ও বিটা (α2 β2)।

থ্যালাসেমিয়ায় যে সমস্যাটা হয়, তা হলো এই দুই জোড়া গ্লোবিনের যেকোনো এক জোড়ার তৈরি হওয়া কমে যায়। যাকে আমরা আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া বলি। উভয়েরই কারণ জেনেটিক মিউটেশন। মিউটেশনের মানে হলো জিনের ভেতরে স্বাভাবিকের বাইরে কোনো প্রোটিন তৈরি হওয়া। এটা বিভিন্ন কারণে হয়। আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির পরে কোটি কোটি বছর ধরে এই মিউটেশন হয়ে আসছে। অনেক বড় বড় প্রাণী প্রজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনও শোনা যায়, ভূমিকম্পের কারণেও মিউটেশন ঘটে।

কারণ যা-ই হোক, মিউটেশনের ফলে গ্লোবিন চেইনের তৈরি হওয়া কমে যায়। ব্যাপার হলো একজোড়া চেইনের তৈরি হওয়া যখন কমে যায় তখন সাথের অন্য জোড়ার তৈরি হওয়া বেড়ে যায়। বেড়ে যাওয়া গ্লোবিন Precipitation হয় যার ফলে লোহিত কনিকাটি ভেঙে যায়। আবার তার মধ্যে হিমোগ্লোবিনের পরিমানও কমে যায়। যার ফলে হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা কমে যায়।

আমাদের দেশে প্রধানত দুই ধরনের থ্যালাসেমিয়া দেখা যায়, যাদের ক্ষেত্রে সাধারণত রক্ত পরিসঞ্চালন দরকার হয় (Transfusion dependent thalassaemia)। এর বাইরেও হরেক রকম থ্যালাসেমিয়া আছে। এদের অধিকাংশেরই নিয়মিত রক্ত লাগে না। আমাদের দেশে β β-thalassaemia major এবং HB-E, β thalassaemia এর অধিকাংশ রোগী। যাদের নিজের রক্ত শরীরের খুব একটা কাজে লাগে না বরং ক্ষতি করে। অন্যের দেওয়া রক্তে তাদের বেঁচে থাকতে হয়।

বংশানুক্রমের ব্যাপার হলো বাবা-মা দুজনই যদি বাহক হয় তা হলে কিছু সন্তান সুস্থ হবে, আবার কিছু সন্তান রোগী অথবা বাহক হবে। বাবা-মা দুজনই যদি রোগী হয় তা হলে সুস্থ বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার যদি মা-বাবার একজন রোগী হয়, অন্যজন সুস্থ হয় তা হলে কিছু সন্তান বাহক হবে, কিছু সুস্থ হবে। তার মানে হলো রোগটি মা-বাবার থেকেই বাচ্চার মধ্যে সঞ্চালিত (Inherited) হয়।

তাই যদি বিয়ে করার আগে রক্তের পরীক্ষা করে নেওয়া যায় যে পাত্র-পাত্রী কেউই বাহক বা রোগী নয়, তা হলে রোগটি সঞ্চালিত হতে পারবে না। এটা বাচ্চা মায়ের গর্ভে আসার পরেও নির্ণয় করা যায় যা ব্যয়সাপেক্ষ। যদি দেখা যায় মায়ের গর্ভের বাচ্চা আক্রান্ত হয়েছে, তা হলে Pregnancy terminate করা যায়।

তবে যদি সমাজের সমস্ত লোকের এক বা একাধিক স্ক্রিনিং টেস্ট করা যায় তা হলেও বাহক বা রোগী শনাক্ত করা যায়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক বা সরকারি উদ্যোগ দরকার। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে একই বংশের ভাই-বোনের মধ্যে বিভিন্ন কারণে বিবাহের প্রচলন আছে। এটা থ্যালাসেমিয়া বিস্তারের কারণ। সে ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সামজিক সচেতনতা তৈরি করতে পারলে বিস্তারের ব্যপকতা কমানো সম্ভব।

প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজে থ্যালাসেমিয়া রোগী অথবা বাহকের সংখ্যা বাড়ছে, যার চিত্র খুব ভয়াবহ। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা হলো রোগীদের চিকিৎসা, পরামর্শ ইত্যাদি। আর বেসরকারি স্বেচ্ছা সংগঠনগুলোর ভূমিকা হওয়া উচিত মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা যাতে রোগটির বিস্তার রোধ করা যায়। রক্ত সংগ্রহের ব্যাপারেও তাদের ভূমিকা থাকতে পারে- যেমন মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করা। তবে রক্ত সংগ্রহের কাজটি তাদের না করাই ভালো, কারণ রক্তদানের কতগুলো নিয়ম-কানুন আছে, পরীক্ষা-নীরিক্ষা আছে যা স্পেশালিস্টদের কাজ। চিকিৎসার ক্ষেত্রে রক্ত দেওয়া ছাড়াও জমে যাওয়া আয়রন শরীরের ভিতর থেকে বের করতে হয়। না হলে থ্যালাসেমিয়ায় রোগীরা ৩০-৪০ বছরের বেশি বাঁচে না। এ ব্যাপারে স্বেচ্ছা সংগঠনগুলো উদ্যোগ নিতে পারে। সরকারকে পরামর্শ দিতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের শরীরে রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি হয় না। ফলে শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শরীরের দরকারি অঙ্গ যেমন- প্লীহা, যকৃত বড় হয়ে যায় এবং কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। মুখমণ্ডলের হাড়ের অস্থিমজ্জা বিকৃত হওয়ার কারণে শিশুর চেহার বিশেষ রূপ ধারণ করে।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। বারবার রক্ত নেওয়ার একটি বিপজ্জনক পাশর্^প্রতিক্রিয়া হলো বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যাওয়া। এর ফলে যকৃত বিকল হয়ে রোগী মারাও যেতে পারে। এ ধরনের জটিলতা প্রতিরোধে আয়রন চিলেশন থেরাপি দেওয়া হয় অতিরিক্ত লৌহ বের করে দেবার জন্য।

অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী চিকিৎসা যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে এর চিকিৎসা সব সময় সফল নাও হতে পারে। এ ছাড়া জিন থেরাপি এবং স্টেম সেল থেরাপিও থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী চিকিৎসা।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো প্রতিরোধ। এ ব্যাপারে আমাদের সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। না হলে হয়তো ভবিষ্যতে কোনো একদিন দেখা যাবে বাংলাদেশের সব লোক থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বা রোগী। তখন চিত্রটি কেমন হবে বলাই বাহুল্য। সেই পরিস্থিতি যাতে আমাদের সম্মুখীন হতে না হয় তা-ই আমাদের করণীয়।

থ্যালাসেমিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এ রোগের দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত এবং প্রতিহত করার মাধ্যমে সমাজে নতুন থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্ম হ্রাস করা যায়। সুতরাং আর দেরি না করে আজই থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস নামক পরীক্ষাটি করান এবং আপনার শিশুকে এর অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখুন।

ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অর্থাৎ যেসব পরিবারে স্বামী বা স্ত্রী দুজনই এ রোগের বাহক তারা গর্ভস্থ ভ্রুণ পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য থ্যালাসেমিয়া শিশু নির্ণয় এবং তা পরিহার করতে পারেন। গর্ভাবস্থার ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষাটি করালে ভালো হয়।

প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির সময় লোকের রক্তে হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষা করা যায়। স্কুলে ভর্তির সময় বাচ্চাদের এবং বাবা-মায়ের পরীক্ষা করা যায় এবং রেকর্ড নথীভুক্ত করা যায়। অনেক রকম স্ক্রিনিং টেস্ট আছে। প্রাথমিক কর্তব্য হলো একটি স্ক্রিনিং টেস্ট ঠিক করা এবং সে পথে আগানো। বসে থেকে কালক্ষেপণ হবে ভয়াবহ আত্মহনন।

প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান- যেমন মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা যেখানে মানুষ স্বাভাবিকভাবে সমবেত হয়, সেগুলোও কাজে লাগানো যায়। যেমন আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিবাহ বন্ধ করা। এসব ব্যবস্থা যদি আমরা নিতে পারি তাহলে হয়তো থ্যালাসেমিয়ার বিস্তার থেকে আমরা রেহাই পাব।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

স্বাস্থ্য এর সর্বশেষ

করোনায় ধূমপায়ীদের মৃত্যু হার ৩ গুণ বেশি: গবেষণা

বিদায়ী উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রশ্নে যা বললেন ডা. দীন মোহাম্মদ

বিএসএমএমইউতে নতুন উপাচার্যকে বরণ করতে ব্যাপক প্রস্তুতি  

অ্যানেস্থেসিয়ায় হ্যালোথেন ব্যবহার বন্ধ করতে বললো স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, কেন এ নির্দেশ?

হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় বাদাম!

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ইনসাফ বারাকাহ হাসপাতালে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প

বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসে জানুন সংক্রামক এ রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত

মৃগী রোগ সম্পর্কে কতটা জানেন? এর লক্ষণ আর চিকিৎসাই বা কী?

এক যুগ আগেই জানা যাবে আপনি মূত্রাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত কি না

কীভাবে চিনবেন প্রাণঘাতী অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার? বাঁচতে হলে জানুন

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :