রবীন্দ্র নৃত্যভাবনা

প্রকাশ | ০৮ মে ২০২২, ১৪:১৪ | আপডেট: ০৮ মে ২০২২, ১৪:২৪

শেখ মেহেদী হাসান

উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। শিল্প-সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর প্রবল উপস্থিতি। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, গান, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য ইত্যাদি রচনা এবং পরিণত বয়সে চিত্রকলাচর্চা-বাঙালির সকল আনন্দ-বেদনায়, সংকটে তাঁকে পেয়েছে পথিকৃতের ভূমিকায়। বাঙালির আধুনিক নৃত্যচর্চায়ও তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের গ্রামবাংলার সাধারণ জনজীবনের সঙ্গে নাগরিক কবি রবীন্দ্রনাথের নিবিড় পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিল জমিদারি দেখাশোনার সুবাদে। এই কাজের সুবাদে তিনি দশ বছর ছিলেন পূর্ববঙ্গে-বর্তমানে যা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাঁর রচনাবলীর অনেকাংশের ভিত্তি হলো পূর্ববাংলার মানুষ ও প্রকৃতি। এই পূর্ববাংলায়Ñসিলেটের মাছিমপুর বস্তিতে মণিপুরি নৃত্য দেখে তিনি শান্তিনিকেতনে নাচ শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি রচনা করেন নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘শ্যামা’, ‘নটীর পূজা’ ও ‘শাপমোচন’। মূলত নৃত্যনাট্য নামের শিল্পটি তাঁরই উদ্ভাবন। বর্তমান নিবন্ধে ‘রবীন্দ্র নৃত্যভাবনা’ বিষয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে।

 

২.

১৯১৯ সালের মাঝামাঝি শিলংয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শিলং থেকে সিলেট বেশি দূরের পথ নয়। ওই সময় সিলেট ব্রাহ্মসমাজের পক্ষে গোবিন্দনারায়ণ সিংহ কবিকে সিলেটে আসার আমন্ত্রণ জানান। আসাম-বেঙ্গল রেলপথ ছাড়া চেরাপুঞ্জি দিয়ে থাবায় (মানুষবাহিত পালকিসদৃশ এক রকমের যান) বসে খাসিয়াদের (সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত লঘু নৃগোষ্ঠী) পিঠে চড়ে আসার ব্যবস্থা ছিল। কবি মানুষের পিঠে চড়তে রাজি হননি। তিনি রেলপথেই এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। সিলেটে আসবার আগেই আসামের বদরপুর জংশনে কবিকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন জমিদার সুধীন্দ্রনারায়ণ সিংহ; কুলাউড়া স্টেশনে ছিলেন হরেন্দ্রচন্দ্র সিংহ, ধর্মদাস দত্তসহ অন্যান্য রবি-অনুরাগী সিলেটবাসী। বদরপুর রেলওয়ে জংশনের কোয়ার্টারে বাসকারী শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র মনোরঞ্জন চৌধুরী সপরিবারে কবির সহযাত্রী হয়েছিলেন। ৫ নভেম্বর ১৯১৯, বুধবার ভোরে কবি সিলেটে পৌঁছান। সুরমা নদীর ঘাট থেকে শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে শোভাযাত্রাসহ তাঁকে সিলেট শহরে আনা হয়। তিনি উঠেছিলেন নয়াসড়ক টমাস সাহেবের বাংলোয়। ওই দিন ব্রাহ্মমন্দিরে কবির উপাসনার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে ভিড় জমেছিল উৎসুক মানুষের। সন্ধ্যা সাতটায় কবি মন্দিরে এসেছিলেনÑগৈরিক বসনে বৈদিক ঋষির মতো। 

৬ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় স্থানীয় টাউন হল প্রাঙ্গণে শ্রীহট্টবাসী (সিলেট) জনসাধারণের পক্ষ থেকে কবিকে সংবর্ধনা জানানো হয়। সংবর্ধনায় ‘বাঙালির সাধনা’ শীর্ষক প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতা করেছিলেন তিনি। ওই দিন বেলা দুটোয় ব্রাহ্মসমাজ গৃহে তাঁকে পুনরায় সংবর্ধনা দেয় শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি। ওই অনুষ্ঠানে কবির আসনের সামনে টেবিলে মোড়ানো ছিল মণিপুরি মেয়েদের তৈরি টেবিলক্লথ। তার বয়ননৈপুণ্য কবি-মনে মণিপুরিদের তাঁত ও জীবনযাত্রা দেখার আগ্রহ জন্মে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেটের উপকণ্ঠে মাছিমপুর পূর্বমণ্ডপ গোপীনাথ জিউরত মন্দিরে (প্রতিষ্ঠা ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ)। এই মন্দিরে তিনি উপভোগ করেন মণিপুরি কিশোরদের রাখালনৃত্য। সন্ধ্যায় সিলেটের টাউন হলে বক্তৃতা শেষে রাতে বাংলোয় ফিরে দেখেছিলেন রাসনৃত্য। রবীন্দ্রনাথ তখনই স্থির করেছিলেনÑশান্তিনিকেতন আশ্রমে নাচ শেখানোর একজন শিক্ষক সঙ্গে নিবেন।

কবি সিলেট থেকে ত্রিপুরায় গিয়ে মহারাজা বীরেন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরকে অনুরোধ করেন একজন নাচের শিক্ষক দেওয়ার জন্য। মহারাজা কবির অভিপ্রায়ে সাড়া দিয়ে মণিপুরি নৃত্যগুরু বুদ্ধমন্ত্র সিংহকে শান্তিনিকেতনে পাঠালেন ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। তখন ত্রিপুরারাজকে ধন্যবাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি লিখেছিলেন-‘মহারাজ বুদ্ধমন্ত্র সিংহকে আশ্রমে পাঠাইয়াছেন সেজন্য আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ হইয়াছি। ছেলেরা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত তাহার নিকট নাচ শিখিতেছে। আমাদের মেয়েরাও নাচ ও মণিপুরি শিল্পকার্য শিখতে ঔৎসুক্য প্রকাশ করিতেছে। যদি মহারাজ বুদ্ধমন্ত্র সিংহের স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবার আদেশ দেন তবে আমার উদ্দেশ্য সাধিত হইবে।...’ রবীন্দ্রনাথের এই চিঠির মধ্যে মেয়েদের নৃত্য ও কারিগরি শিক্ষার তাগিদ স্পষ্ট হয়েছে। বুদ্ধমন্ত্র সিংহের আগমনে ৮ থেকে ১৬ বছরের একদল ছাত্রকে বাছাই করা হয় নাচ শেখার জন্য। কবি নিজেও মহড়াকক্ষে নাচের অনুশীলন দেখতে আসতেন। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই ছেলেদের নাচ শেখা নিয়ে বিরূপ সমালোচনা ওঠে। সমালোচনা এড়াতে বিদ্যালয়ের মাসিকপত্র ‘শান্তিনিকেতন’-এ (১৩২৬ বঙ্গাব্দ, ফাল্গুন সংখ্যা) সংবাদ প্রচার করা হয়-‘ত্রিপুরাধিপতি মহারাজ বাহাদুরের দরবার হইতে দুইজন কলাবিদ আশ্রমে আসিয়াছেন। আশ্রম বালকেরা তাঁহাদিগের নিকট হইতে মৃদঙ্গসহযোগে সাঙ্গীতিক ব্যায়াম শিক্ষা করিতেছে।’ অন্যদিকে বিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে লেখা হলো-‘শ্রীযুক্ত ত্রিপুরেশ্বর মহারাজ বাহাদুরের প্রেরিত বুদ্ধিমন্ত্র সিংহের পরিচালনায় গত মাঘ হইতে চৈত্র মাস পর্যন্ত আশ্রম বালকেরা মৃদঙ্গের তালের সঙ্গে ব্যায়াম শিক্ষা করিয়াছিল।’ এ প্রতিবেদনের কোথাও কিন্তু ‘নৃত্য’ বা ‘নাচ’ শব্দটি উল্লেখ হয়নি। এই প্রতিবেদন থেকে বুঝা যায় শান্তিনিকেতনের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকের মন তখনও নাচকে সম্মানজনক শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। বুদ্ধমন্ত্র সিংহ ওই বছর গরমের ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে আর শান্তিনিকেতনে ফিরেননি।

 

৩.

১৯২০ সালে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো নাচ শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে গৃহীত হয়। প্রতিমা দেবীর মতে-‘শান্তিনিকেতনের বর্ষামঙ্গল উৎসবগুলোর মধ্যে নৃত্যের প্রথম আকুতি দেখি।’ অর্থাৎ বর্ষামঙ্গল দিয়ে শুরু হয় আধুনিক নৃত্যচর্চা। অতঃপর ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এবার তিনি চেষ্টা করলেন উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চার বিশ্ব-চিন্তার সমন্বয় ঘটাতে। তাঁর বিশ্বাস ছিল সংগীত, নৃত্য, নাট্য, চিত্রকলা শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রকৌশল চর্চার মাধ্যমে তৈরি হবে নতুন জ্ঞান-কাঠামো। কেবল নাচ শেখানোর জন্য পর্যায়ক্রমে মণিপুরি, ভরতনাট্যম, কথাকলি নাচের গুরুদের নিয়ে এসেছিলেন বিভিন্ন স্থান থেকে। ১৯২২ সালে ‘শারদোৎসব’ নাটক ‘ঋণশোধ’ নামে মঞ্চস্থকালে তার গানগুলো উপস্থাপন করা হয় গুজরাটি লোকনাচের কম্পজিশনে। ১৯২৩ সালে বর্ষামঙ্গলের সময় ‘বসন্ত’ (উৎসর্গ: কাজী নজরুল ইসলাম) নাটকের দুটো গানে নাচ যুক্ত হয়েছিল। এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই অংশ নিয়েছিলেন গানের দলের কর্মী হিসেবে। ওই বছর অধ্যাপক প্রোস্টেন কোনের বিদায় সংবর্ধনায় পরিবেশিত হয়েছিল গুজরাটের গরবা নাচ। গান ও নাচের সম্মিলিত রঙে-রেখার দৃশ্যপট থেকে আমরা খুঁজে নিয়েছি আমাদের চিন্তার ভূমি। একজন বিদেশির বিদায় সংবর্ধনা অনুুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রকাশ পায় তা বাঙালির আত্ম-আবিষ্কারের পথ।

১৯২৪ সালে বিশ্বভারতীর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন মুন্বাইয়ের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর ভকিল। এই পার্শিয়ান ভদ্রলোক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক। তাঁর স্ত্রী গুজরাটের গরবা ও কাথিয়াবাড় নাচ জানতেন। মিসেস ভকিল প্রতিমা দেবীর অনুরোধে মেয়েদের আনুষ্ঠানিক গরবা নাচ শেখান। তাঁর কাছে গরবা নাচ শেখেন গৌরী ও যমুনা দেবী, অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা অমিতা সেন এবং রবীন্দ্রনাথের নাতনি নন্দিতা দেবী (বুড়ি) ও বিদ্যালয়ের ছাত্রী লতিকা রায়। এমনকি ‘যদি বারণ করো’, ‘মোর বীণা ওঠে’, ‘দুই হাতে কালের মন্দিরা’ প্রভৃতি গানের সঙ্গে গরবা গানের নাচের আদর্শে নৃত্যবিন্যাস করা হয়। ওই বছর (১৯২৪) মঞ্চস্থ হয় ‘অরূপরতন’। এটি মূলত ‘রাজা’ নাটকেরই রূপান্তর। এ নাটকের নতুন গানগুলোর নৃত্যবিন্যাস করা হয়েছিল কাথিয়াবাড় ও গুজরাটের লোকনৃত্যের আদর্শে। তার সঙ্গে ছিল একটুখানি ‘ভাও’ বাৎলানো নৃত্য পদ্ধতি। এই ভাও বাৎলানো নৃত্য পদ্ধতি কত্থক। কত্থক নৃত্যের অভিনয়াংশের একটি অংশ গৎভাও।

ইতালিয়ান অধ্যাপক জোসেফ তুচ্চি এবং কার্লো ফার্মিকি অনেক বইপত্রসহ শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯২৫ সালে। ওই বছর শ্রাবণ মাসে ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের কিছু গানের সঙ্গে একক ও দলবদ্ধ নাচ প্রদর্শিত হয়। অক্টোবরে এলেন মণিপুরি নৃত্যগুরু নবকুমার সিংহ ও তাঁর ভাই বৈকুণ্ঠনাথ সিংহ। তাঁদের কাছে নাচ শেখেন আচার্য নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরি, শ্রীমতি দেবী, নন্দিতা দেবী, অমিতা দেবী ও যমুনা দেবী। প্রতিমা দেবীর তত্ত্বাবধানে তাদের নাচ শেখানো হতো শান্তিনিকেতনবাসীর দৃষ্টির আড়ালে। সমালোচনা এড়ানোর জন্য। ১৯২৬ সালে চালু হয় নৃত্যকলা বিভাগ। এ বছর ‘নটীর পূজা’ নৃত্যনাট্যের নৃত্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন নবকুমার সিংহ ও প্রতিমা দেবী। ‘নটীর পূজা’র একাধিক গান নৃত্যের মাধ্যমে অভিনীত হয়েছিল। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত সাধক শান্তিদেব ঘোষ বলেনÑ‘এখানকার নাচকে তার এবং তাঁর আদর্শকে ঠিকমতো বুঝতে পারলে আমরা দেখতে পাব শান্তিনিকেতনে নাচের শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা কেবল নাচিয়ে তৈরি গুরুদেবের উদ্দেশ্য ছিল না, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত শিক্ষার দ্বারা জ্ঞান ও অন্যান্য কলাবিদ্যা সমাজ জীবনকে যেমন উন্নত শান্তিময় করে তোলে, নৃত্যকলাকেও যেন তাই করে।...’ রবীন্দ্র নৃত্যভাবনার অন্তরের ভাব ধরা পড়েছে শান্তিদেবের কথায়।

১৯২৭ সালের জুলাই মাসে বাসুদেবন নামে দক্ষিণ ভারতীয় এক শিক্ষার্থী কলাভবনে চিত্রকলা বিভাগে ভর্তি হয়। তার গায়ের রং ছিল প্রায় ব্রঞ্জের মতো। বাসুদেবন শান্তিনিকেতনে ছাত্র হওয়ার আগ পর্যন্ত বিশ্বভারতীর ছাত্ররা ভাবতো নাচ কেবল মেয়েদের জন্য; ছেলেদের উপযোগী নয়। কিন্তু বাসুদেবনের নাচ দেখার পর ছাত্রদের ধারণা বদলে যায়। সে স্নেহাসিক্ত হলো শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর। রবীন্দ্রনাথ তখন আশ্রমে ছিলেন না। তিনি ফিরেই বাসুদেবনের খবর পেয়েছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ স্থির করলেন ‘নটরাজ’ পরিবর্তিত ‘ঋতুরঙ্গ’ নাটকের মুখ্য ভূমিকায় নৃত্যাভিনয় করবেন বাসুদেবন। তার উল্লেখযোগ্য নৃত্য ছিল ‘যেতে যেতে একলা পথে’ গানের নৃত্যবিন্যাস। কোনোখানে তিনি একা নেচেছেন আবার কোথাও তার সঙ্গী হয়েছেন আশ্রমের এক-দুজন শিক্ষার্থী। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় শিষ্য শান্তিদেব ঘোষের নৃত্য শিখবার প্রেরণা এই বাসুদেবন। পরে নৃত্যগুরু ই. কৃষ্ণ আয়ার কিছুদিন ভরতনাট্যম নৃত্য শিখিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে।

১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে জার্মানিতে পাঠিয়ে Rudolf Von Laban, Marry Wigman এবং Kurt Joss কর্তৃক প্রবর্তিত ইউরোপীয় Modern Dance শিখিয়ে আনেন। তিনি দেশে ফেরেন ১৯৩০ সালে। আর এভাবে উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী ও লৌকিক নৃত্যের সঙ্গে পশ্চিমা মডার্ন-ড্যান্সের চর্চার সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি শিক্ষার্থীদের উৎসাহ জোগাতে তিনি নৃত্যগীতি পরিবেশনায় অংশ নেন ১৯২৮ সালে দোলের দিন শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে কারমাইকেল বেদীর সামনে ‘ফাল্গুনী’ নাটকে ‘অন্ধ বাউল’ চরিত্রে। ১৯২৯-এ কলকাতার জোড়াসাঁকোয় ১১ মাঘ উৎসবে ‘নটরাজ’ ও ‘ঋতুরঙ্গ’ পরিবেশনায় ছাত্রীরা নেচেছিল মণিপুরি ও গরবা নাচ। এর নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রতিমা দেবী। অনুষ্ঠানটি দর্শকরা টিকিট কেটে দেখেছিল। দর্শনীর বিনিময়ে নৃত্যচর্চার ধারণাটিও কিন্তু রবীন্দ্রনাথের। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজে মন্দির বা রাজ-দরবার কেন্দ্রিক যে নাচের চর্চা হতো তার পরিবর্তে নাচকে দিলেন নতুন মর্যাদা। সাধারণ মানুষকে তার পৃষ্ঠপোষক বানিয়ে দিলেন। এভাবে ক্রমে দূর হয় নাচ সম্পর্কে মানুষের কলুষ ধারণা।   

 

৪.

রবীন্দ্র নৃত্যভাবনা সংক্রমিত হয়েছিল ভারতীয় নৃত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার উদয়শঙ্করের মধ্যে। নৃত্যাচার্য উদয়শঙ্কর পশ্চিমা আধুনিক নৃত্যপদ্ধতি আয়ত্ত করে সবেমাত্র কলকাতা ফিরেছিলেন ১৯২৯ সালে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন শান্তিনিকেতনে। উদয়ের নাচ দেখে রবীন্দ্রনাথ অসম্ভব খুশি হয়ে তাঁকে শিবের সঙ্গে তুলনা করলেন কবি। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতো ইউরোপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিমা দেবী, নন্দিনী ও সচিব শ্রী আর্যনায়কম। ইংল্যান্ডে পৌঁছে মি. এলম্হার্সট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ডাটিংন্টনহল বিদ্যালয়ে তারা অবস্থান করেন। প্রতিমা দেবী ওই স্কুলে আগ্রহসহকারে ব্যালে নৃত্য শেখেন। এবার তিনি নৃত্যনাট্য বিন্যাসের ক্ষেত্রে স্থান দিলেন ব্যালে নাচ ও সারাড বা খেলানাট্য। অর্থাৎ নৃত্যনাট্য কেবল গাননির্ভর নাচের আঙ্গিকাভিনয় নয় এর সাথে যুক্ত হলো মডার্ন ব্যালে ও ক্রীড়া। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় ১৯৩১ সালের মে মাসে দার্জিলিংয়ে ‘বিদায় অভিশাপ’ পরিবেশনাকালে। সেখানে প্রতিমা দেবী ব্যালে পরিবেশন করেছিলেন বিদায় অভিশাপের কবিতা আবৃত্তির সঙ্গে। অথচ কবিতা নিছক বাচিক অভিনয় এর সঙ্গে যুক্ত হলো নাচ। ওই  বছর বর্ষামঙ্গলে ‘ঝুলন’ কবিতার আবৃত্তি এবং ‘এসো নীপবনে’ গানের সঙ্গেও একই বিষয় লক্ষ্য করা যায়।

রবীন্দ্রনাথের ৭০তম জন্মজয়ন্তীতে প্রদর্শন করা হয় ‘নটীর পূজা’। এখানে নৃত্যবিন্যাসের পাশাপাশি স্থান পেয়েছিল মূকাভিনয়। ১৯৩২ সালে রুশ দেশীয় লোকনৃত্যে পটু এক মার্কিন দম্পতি বছরখানেকের জন্য শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ড. টিম্বার্সের কাছে শেখা রুশ লোকনৃত্য পরিবেশন করেন শান্তিদেব ঘোষ, মাঘীপূর্ণিমার রাতে। ১৯৩৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘তাসের দেশ’ ও ‘চণ্ডালিকা’ রচনা করেন গীতিনাট্যের আদলে। ১৯৩৪-এর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে কেরালার তৎকালীন কোচিন রাজ্যের মহারাজা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে কল্যাণী আম্মা নামে একজন নৃত্যকীকে শান্তিনিকেতনে পাঠান। তার খরচ বহন করেন মহারাজা নিজেই। তিনি আশ্রমের ছাত্রীদের শিখিয়েছিলেন স্বরম, কইকুট্টিকলি ও কলাম্মুলি নামে কিছু লোকনৃত্য। কল্যাণী আম্মার সঙ্গে গায়ক ও বাদক না থাকায় তিনি বেশি অভিনয়সমৃদ্ধ নৃত্য শেখাতে পারেননি। এ বছর মার্চ মাসে নবকুমার সিংহ আবারও আশ্রমে আসেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র নরেন্দ্র সিংহ। তিনি খাঁটি মণিপুরি নৃত্যভঙ্গিতে আশ্রমের শিক্ষার্থীদের বেশকিছু নাচ তুলে দেন। ১৯৩৫-এর আগস্ট মাসের ১১ এবং ১২ তারিখে সিংহসদনে পরিবেশিত শ্রাবণগাঁথায় মোট ২৪টি নৃত্যগীতি পরিবেশন করা হয়। ১৯৩৫ সালের মার্চে দোল উৎসবে পুনরায় মঞ্চস্থ হয় ‘চণ্ডালিকা’।

১৯৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিমা দেবী স্থির করেন ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের নৃত্য ও মূকাভিনয় করাবেন ছাত্রীদের দিয়ে। দ্বিতীয় সপ্তাহে মহড়া শুরু হয়। আর ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয় ৮ ফাল্গুন, ১৩৪২ কলকাতায়। ১১ মার্চ নিউ এম্পায়ার রঙ্গমঞ্চে ‘চিত্রাঙ্গদা’র প্রথম অভিনয় হয়। পরবর্তীকালে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয় বাংলাদেশের খুলনা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহে। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘শ্যামা’ এবং পরবর্তীকালে ‘চণ্ডালিকা’ রচনা করেন। নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’তে প্রথমবারের মতো ভারতের চারটি ধ্রপদী নৃত্যধারার সমন্বয় ঘটে। বজ্রসেন চরিত্র রূপায়িত হয়েছিল ভরতনাট্যম ও কথাকলি নৃত্যধারায়, উত্তীয় কত্থক নৃত্যধারায়, প্রহরী কথাকলি নৃত্যধারায় এবং শ্যামা চরিত্র মণিপুরি নৃত্যধারায়। অর্থাৎ শান্তিনিকেতনে মিশ্র পদ্ধতির নৃত্যচর্চা ‘শ্যামা’ প্রযোজনার মাধ্যমে শুরু হয়। নৃত্যগুরু কেলু নায়ার ১৯৩৯-১৯৪০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত চিত্রাঙ্গদায় অর্জুনের ভূমিকায় কথাকলি নৃত্য ভঙ্গিমায় অভিনয় করেন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চার বছরে চিত্রাঙ্গদার অভিনয় হয়েছিল মোট চল্লিশ বার। ১৯৪০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি শান্তিনিকেতনে ‘চণ্ডালিকা’ অভিনীত হয় মহাত্মা গান্ধীকে দেখাবার জন্য। ‘চণ্ডালিকা’ প্রশংসিত হয়েছিল।

 

৫.

১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ-অবধি শান্তিনিকেতনের প্রতিটি ঋতু উৎসব, বসন্ত উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নৃত্য ছিল প্রধান আকর্ষণ। আজও সে চর্চা অব্যাহত রয়েছে। রবীন্দ্র-নৃত্যভাবনায় বহির্ভারতীয় প্রচ্ছন্ন ছাপ থাকলেও মূলত ভারতীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে। সেখানে ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের মতো কোনো সুনিয়ন্ত্রিত ব্যাকরণ মানা হয় না। তারপরও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগ ভারতীয় তথা বাঙলার নৃত্যকলা উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজে পছন্দ করতেন ব্যালে, জাভা-বালির নাচ, শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি ও সিলেটের মণিপুরি নাচ। পাশ্চাত্য নাচ সম্পর্কে তাঁর অভিমত ছিল এরকমÑ‘আধখানা ব্যায়াম, আধখানা নাচ, তার মধ্যে লম্ফঝম্প, ঘুরপাক, আকাশকে লক্ষ্য করে লাথি ছোঁড়া, আবার জাপানের নাচকে বলেছেন-দেহভঙ্গির  সংগীত।....ভঙ্গিবৈচিত্র্যের পরস্পরের মাঝখানে কোনো ফাঁক নেই...একসঙ্গে দুলতে দুলতে সৌন্দর্যের পুষ্পবৃষ্টি করছে।’ তবে বাংলার নৃত্যকলা পশ্চিমা ব্যালে প্রভাবিত নয়। নিজস্ব পাঁচালী, যাত্রা, রাঁয়বেশে, খেমটা, ঝুমুর প্রভৃতি মৌলিক উপাদানে গঠিত বাংলার নাচ। ফলে প্রাচীন বাংলার নৃত্যরীতি পদ্যছন্দে ভাবানুগ এবং আনুষঙ্গিক বাদ্যযন্ত্রে লঘু দৃষ্টিভঙ্গি বর্জিত প্রয়োগ কলা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতিনাট্যের সুরশৈলীকে যথার্থ সামঞ্জস্য রেখে নৃত্যনাট্যের উপযোগ সৃষ্টি করেন। তারপরও শান্তিনিকেতনের নৃত্যপদ্ধতি নির্দিষ্ট কোনো রীতি মেনে চলেনি। মণিপুরি, কথাকলি, ভরতনাট্যম, এলাহাবাদের কত্থক, জাভা-বালির নৃত্য, হাঙ্গেরির লোকনৃত্য, শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিনাচের এক সম্মেলক রূপ।

প্রতিমা দেবীর মতেÑ‘শান্তিনিকেতনের নাচে বাজনার বৈচিত্র্য তেমন হয়নি; তার কারণ গুরুদেবের সংগীত ও সুর বাজনার অভাব পুরিয়ে দেয়। এখানে তাঁর সুরের ও গানের সঙ্গে প্রাচীন নৃত্যের এক অভাবনীয় মিলন হয়েছে। এই ত্রিবেণীসঙ্গমের ধারা এক নূতন রসসৃষ্টির পদ্ধতিকে অনুসরণ করে। এই সংগীত ও নৃত্যের অপূর্ব ঐক্য এখানে কেউ কাউকে পূর্ণ প্রকাশের পথে বাধা না দিয়ে নিজের শক্তির মধ্যে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ করেছে।...’ শান্তিনিকেতনের নাচের সংলাপ রবীন্দ্রনাথের গান, আর অভিনয়রীতি হলো নৃত্য। তাছাড়া তাঁর নাটকগুলো গদ্য-পদ্যের আদলে লিখিত। তাঁর ব্যঞ্জনা প্রকাশ হতো কবিতা এবং গানে। তাঁর নৃত্যভাবনায় ভাবের ব্যঞ্জনা বেশি এজন্য ব্যাকরণ দুর্বল। সর্বত্র তাঁর কাব্যরস। ধ্রুপদী নৃত্যের নির্দিষ্ট কোনো আঙ্গিক, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, নৃত্য পরিবেশনে আবশ্যকীয় ব্যবহার্য গ্রহণে শিথিলতা লক্ষ্যণীয়। সৃজনশীল এই সম্মেলক নৃত্যে মুদ্রা (হস্ত), পদসঞ্চালন ও চারী ব্যবহারে ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের বৈপরীত্য দেখা যায়। ভারতীয় ধ্রুপদীনৃত্যে তাল বোল বলতে হয় কিন্তু রবীন্দ্রনৃত্যের বেলায় শিল্পীকে শুধু গান জানলেই চলে। শৈলজারঞ্জন মজুমদার শান্তিনিকেতনের এই চর্চাকে চিহ্নিত করেছেন ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ হিসেবে। সরাসরি গানের বাণী, সুর ও ছন্দে নাচের বিন্যাস ঘটালেই তাকে ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ বলা যাবে কি? ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ থেকে রবীন্দ্রনাথের গান সরিয়ে অন্য কোনো গীতিকবির গান বসিয়ে অনায়াসে যে কেউ মিশ্ররীতির নাচ কম্পোজিশন করতে পারবেন। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনৃত্যের কোনো ব্যাকরণভিত্তি নেই। এ নৃত্য চলমান। এ নৃত্যধারায় প্রচলিত কোনো পদ্ধতিকে হুবহু মেনে চলবার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির বলা হয় না। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ নৃত্যকে অভিনয়ের উপযোগ দিয়ে নৃত্যনাট্যে নৃত্য-সমাবেশ করেছেন। রবীন্দ্র নৃত্যভাবনার এই সম্মেলক রূপকে ‘রবীন্দ্র গীতিনৃত্য’ বলা চলে। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এ নাচের সূচনা। তবে সংমিশ্রণের কোনো জগাখিচুড়ি নয় বরং সুর, কাহিনি, ভাব ও রসের এক নান্দনিক ঐকতান। এটিই রবীন্দ্র গীতিনৃত্যের স্বাতন্ত্র্য। রবীন্দ্র গীতিনৃত্যের মধ্য দিয়ে বিরহ-মিলন ও ছন্দের অন্তর্গত সম্বন্ধ গড়ে ওঠে। দেহের গতিচাঞ্চল্যের রূপরেখা ছন্দে গ্রন্থিত হয়ে সৃষ্টি হয় রবীন্দ্র গীতিনৃত্য।

 

৬.

পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্রসংগীতের মতো রবীন্দ্র গীতিনৃত্যের কোনো স্বরলিপি নেই। তাই একদিকে নৃত্যশিল্পীর স্বাধীনতা যেমন, দায়বদ্ধতাও তেমনই। মঞ্চসজ্জা, পোশাকের রুচিশোভনতা, ছন্দ, সুর এবং দেহভাষার নান্দনিক নবজাগরণ শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ; সে আন্দোলনকে কেবল ইতিহাসের দোহাই দিয়ে রুদ্ধ করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথই বাঙালির আধুনিক নৃত্যচর্চার পথিকৃৎ। তিনি আমাদের চেতনার অংশ। মননের সঙ্গী।