উল্টাপাল্টা গন্তব্যহীন যাত্রা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১০ মে ২০২২, ১৪:২৯

আজ থেকে ২০ বছর আগেও বাংলাদেশে সয়াবিন তেল ব্যবহার করা হতো না। তখন গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িই ছিল একটি করে খামার। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সরিষা, ভুট্টা, মূলা, হলুদ, আদা, আলু, ডাল, বেগুন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সবজি চাষ হতো এবং নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়ে স্নো-পাউডার, শাড়ি কিনে আনা হতো।

দুই দশক আগে থেকে বাংলাদেশ হঠাৎ গন্তব্যহীন উন্নয়নের মহাসড়কে পথ চলতে শুরু করলো। কিন্তু বাংলাদেশ জানে না গন্তব্য কোথায়? কখনো সুইজারল্যান্ড, কখনো সিঙ্গাপুর, কখনো আমেরিকা হওয়ার বাসনা নিয়ে উল্টাপাল্টা গন্তব্যহীন যাত্রা শুরু করলো বাংলাদেশ।

'গ্রাম হবে শহর'- স্লোগানে বদলে যেতে শুরু করলো গ্রাম। রাস্তাঘাট পাকা হলো। বাড়িঘর দালান হলো। কিন্তু মানুষগুলোর উন্নয়ন হলো না। চিন্তায় মননে মানুষগুলোর মূল্যবোধের আরও অবক্ষয় হলো। শিক্ষা-সংস্কৃতির কোনো উন্নয়ন হলো না। লোক ঠকানো শিখে গেল গ্রামের সাধারণ-সহজ-সরল মানুষটিও।

আগে গ্রামের বাড়িতে ঈদের সময় পিঠা বানানো হতো। হাতে বানানো সেমাই রান্না হতো। সেসবও বন্ধ হয়ে গেল। এখন শহরের আদলে গ্রামেও নুডলস, চটপটি, চিকেন ফ্রাই, গ্রীলসহ বাহারি খাদ্যাভ্যাস তৈরি হলো। গ্রামের বাজারে ঢুকে গেল কর্পোরেট কোম্পানি। চালের রুটি, আটার রুটির পরিবর্তে গ্রামে এখন বিক্রি হতে শুরু করলো বিভিন্ন কোম্পানির রেডি পরোটা, প্যাকেটজাত খাবার। বাড়ির আঙিনায় স্তুপ বাড়ে বিভিন্ন কোম্পানির প্লাস্টিক, পলিথিনের প্যাকেট।

যে গ্রামগুলো একদিন নিজের উদপাদিত পণ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। নিজের উদপাদিত পণ্য বিক্রি করে সংসারের অন্যান্য খরচও নির্বাহ করতো। সেই গ্রাম এখন শহরের কারখানা, অন্য জেলার ফ্যাক্টরিতে উদপাদিত পণ্যের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে গেল। এমনকি গ্রামেও এখন সবাই প্যাকেটজাত গরুর দুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে গেল।

সরিষার তেল হটিয়ে দিয়ে কর্পোরেট ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সয়াবিন তেল দিয়ে বাজার দখল নিয়ে নিল। গ্রামের পুকুর ভরাট করে, খাল-বিল ভরাট করে বাড়ছে দোকান, ফ্যাক্টরি। আর সেই ফ্যাক্টরিতে উদপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে সমানতালে। এখন সয়াবিন তেলের দাম বাড়লে দম বন্ধ লাগে। চালের রুটি, আটার রুটি ছেড়ে ছেলেমেয়েদের সয়াবিন তেলে রেডি পরোটায় অভ্যস্ত করানোর পর সয়াবিন তেলের দাম বাড়লে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখতে হয়।

প্রকৃতি যে আমাদের জীবনকে কতভাবে সহজ করে রেখেছিল। আমরা সেটা বুঝি না। আমরা প্রকৃতি নষ্ট করি। নদী, খাল, বিল, পুকুর নষ্ট করে নিজেরাই বন্দি হয়ে যাচ্ছি। যে শহরগুলোর ফুসফুস ছিল এক সময় গ্রাম। আমরা সেই গ্রামগুলো নষ্ট করে শহর হওয়ার পথে হাঁটছি। এতে করে আমাদের বিদেশ থেকে এবং শহর থেকে আমদানি পণ্যের উপর নির্ভরতা বাড়ছে। আমরা বন্দি হয়ে গেছি আমদানি সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের জালে। যখনই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায় আমরা অসহায় হয়ে যায়।

আমাদের নদীতে মাছ নাই, কারণ নদী খনন হয় না। আমাদের পুকুরে দেশি মাছ নাই। কারণ ফ্যাক্টরি, দোকান বানাতে গিয়ে পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। আমাদের গাছে পেঁপে নাই, জমিতে সরিষা, ভুটা, গম, পাট, আদা, রসুন, পেঁয়াজ নাই। আমাদের চাষের জমি প্লট বানিয়ে ফেলে রেখেছি। একদিন সেখানে ডুপ্লেক্স বাড়ি বানাবো, বড় ফ্যাক্টরি বানাবো বলে।

আমাদের যেটুকু চাষাবাদ হয়, সেই ফষলের লাভ নিয়ে যায় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। কৃষকেরা অসহায়। কারণ সরকার কৃষকের পক্ষে নয়, ব্যবসায়ীদের পক্ষে কথা বলে।

একদিন আমাদের গ্রামগুলো নিজেদের উদপাদিত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। এখন আমরা খাদ্যেও শহর নির্ভর হয়ে গেছি। এক সময় ভালো খাবারের জন্য শহর তাকিয়ে থাকতো গ্রামের দিকে। এখন শহর হচ্ছে বিদেশ নির্ভর, আর গ্রাম হচ্ছে শহর নির্ভর।

যে জাতি নিজের সক্ষমতা না বাড়িয়ে, নিজের শক্তির উপর আস্থা না রেখে পরনির্ভর হয়, সেই জাতি সয়াবিন তেলের দাম বাড়লে তো মরবেই। আমরা সরিষার সোনালী দিনকে হত্যা করেছি, পাটের সোনালী দিনকে হত্যা করে পলিথিন ব্যবহার বাড়িয়েছি। আটার রুটি, চালের রুটির দিনকে হত্যা করে রেডি পরোটায় ঝুঁকেছি।

আমরা কী শ্রীলংকার পথেই হাঁটছি?

শ্রীলংকা নিজের উদপাদন বাদ দিয়ে বিদেশি পর্যটকের ডলারের উপর নির্ভরশীল হয়েছিল। আমরাও কি নিজের উদপাদন কমিয়ে বিদেশি আমদানির উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছি? বিদেশের ফ্লাইট বন্ধ হলে, বিদেশে যুদ্ধ হলে আমার ঘরের খাবারের দামও কেন বেড়ে যায়?

লেখক: পাভেল রহমান, গণমাধ্যমকর্মী

(ঢাকাটাইমস/১০মে/এসকেএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মুক্তমত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা