স্বপ্নের মহাসেতুর নন্দিত মহাযজ্ঞ
প্রকাশ | ১২ মে ২০২২, ১২:১৮ | আপডেট: ১৬ মে ২০২২, ১৭:৫৭
আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু !
কোটি মানুষের স্বপ্নের মহাসেতু!!
২০২২ সালে- এ বছরই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আমাদের স্বপ্নের সেই মহাসেতুর !!!
হয়তো জুন মাসে না হয় ডিসেম্বর মাসে সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে! কিন্তু আমাদের এই শুভক্ষণ, মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা যুগ যুগ ধরে ।
কোন এককালে জীবনবাজি রেখে কাঠের লঞ্চে করে ভয়ংকর প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দেওয়া আর আজ এই মহাযজ্ঞময় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে সেই একই পদ্মার বুকেই ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই স্বপ্নের মহাসেতু কয়েক মুহূর্তে পার হওয়া সময়ের মহাবিবর্তন!
আমরা আমাদের স্বপ্নের সেতুটি উদ্বোধনের পর যে ঐতিহাসিক মহাবিবর্তনের এক মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হতে চলছি। এই মহাযজ্ঞের, মহাআয়োজনের এক মহাআয়োজক বা শ্রেষ্ঠজনের প্রতি আমার/ আমাদের একান্ত গভীর কৃতজ্ঞতা, সশ্রদ্ধ ভালোবাসা প্রকাশের জন্য আমার সচক্ষে দেখা কালের বিবর্তনের সেই বাস্তব সত্য গল্প আমি লিখে রাখতে চাই।
১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত অসুস্থ আমাদের আব্বার মুখে (তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত) আশ্বাস বাণী শুনতাম "দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমাদের শেখ মুজিব (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) ক্ষমতায় এসেছে, দেখবা পদ্মার ওপর একসময় ব্রিজ হবেই, আমরা এক সময় ব্রিজের ওপর দিয়েই মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা পৌঁছে যেতে পারব...।”
পদ্মার ওপর সেতু নিয়ে আব্বার এই আশ্বাস বাণীর অনেক কারণ ছিল-
তখন ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর অসুস্থ আব্বার চিকিৎসার জন্য আমাদের বারবার গোপালগঞ্জ-ঢাকা- গোপালগঞ্জ আসা-যাওয়া করতে হতো, কি দুর্গম ছিল সেই যাত্রা! এক্ষণও সেসব মনে করলে শিউরে উঠি ...।
তখন ছোট "কাঠের বডি" লঞ্চগুলো গোপালগঞ্জ-ঢাকা- গোপালগঞ্জ চলাচল করতো (যদিও আব্বা-মা'র মুখে গল্প শুনেছি যে কোনো এক সময় যখন মধুমতী প্রমত্তা ছিল তখন নাকি গোপালগঞ্জ লঞ্চঘাট হয়ে ঢাকা-মোংলা-খুলনা বড় বড় স্টিমার চলাচল করতো ) ।
দুই কেবিনের ছোট লঞ্চগুলো, একটি কেবিন পুরুষদের জন্য, অন্য একটি মহিলাদের জন্য, বাকি অংশ রেলিং ঘেরা সরু বারান্দা, খোলা জায়গা বা ডেক যা সাধারণ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত বা ইচ্ছা করলে বিছানা বিছিয়ে বসে বা শুয়ে থাকতে পারতো। আমাদের কেবিন থেকে নড়তে দেওয়া হতো না কারণ যদি রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে পানিতে পড়ে যাই সেই ভয়ে! দুই দিন, এক রাত্রির দুর্বিষহ জার্নি- অসীম ধৈর্য পরীক্ষা, রাতে বসার সিটের ওপর বিছানা বিছিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হতো। খাওয়ার জন্য শুকনা খাবার (বিস্কিট, ড্রাই কেক, চানাচুর, বাদাম ইত্যাদি) সাথে রাখা হতো এছাড়াও দুই দিনের জন্য রান্না করা খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে করে নেওয়া হতো, অনেক সময় সে খাবারও নষ্ট হয়ে যেতো...। সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল লঞ্চের "ওয়াশ রুম"! লঞ্চের মূল কাঠামো থেকে প্রায় আলাদা একটি অংশ। রেলিং ছাড়া সিঁড়ি দিয়ে মূল অংশ থেকে নিচে নেমে ছোট করিডোর পেরিয়ে যারপরনাই অতি ছোট একটি কমন ওয়াশ রুম! মনে হতো করিডোর দিয়ে গড়িয়ে পানিতে পড়ে তলিয়ে যাবো যে কোনো সময় ! অথবা খুব ভাগ্য ভালো হলে কেবিনের পাশেই একটি ওয়াশ রুম থাকতো যার সামনে সারাক্ষণই নারী-পুরুষ, শিশুদের অপেক্ষার লাইন... ! কি ভয়ংকর সেই জার্নি- আমি ঢাকা যাবার কথা শুনলেই খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে কেঁদে দিন কাটাতাম, বয়সও এমন ছিল না যে মা'কে ছাড়া বাসায় থাকবো। আব্বার জন্য মা'কে বারবার ঢাকা যেতেই হতো, সাথে আমরাও। স্বাধীনতার আগে ঢাকা যাবার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা খুব স্পষ্ট করে মনে নেই, তবে ভয়ে কান্নাকাটি করতাম সেটা মনে আছে।
এ ছিল আমার দেখা ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সালের লঞ্চ জার্নি, তখন গ্রীষ্ম-বর্ষাকালীন লঞ্চ জার্নি হতো একরকম আর শীত বা শীতের আগে-পরে লঞ্চ জার্নি হতো আর এক রকম। শীতে মধুমতী শুকিয়ে যেতো, গোপালগঞ্জ ঘাটে তখন সরাসরি ঢাকাগামী লঞ্চ ভিড়তে পারতো না, তাই প্রথমে নৌকায়/ ছোট লঞ্চে করে সম্ভবত ২-৩ ঘণ্টা ধরে জার্নি করে গোপালগঞ্জ থেকে "হরিদাশপুর" লঞ্চঘাটে যেতে হতো। সেখান থেকে আবার আর একটি লঞ্চে করে দুই দিন পার করে ঢাকা "সদরঘাট" পৌঁছানো হতো । অনেক সময় আবার পদ্মার চরে লঞ্চ আটকে গেলে যাত্রার সময়কাল অনিশ্চিত হয়ে যেতো ! লঞ্চ চর থেকে পানিতে টেনে নামাতে সারাদিন লেগে যেতো ! এ সময় প্রায় না খেয়েই কাটিয়ে দিতে হতো!! তার ওপর ছিল লঞ্চডুবিতে মৃত্যু ভয়! এর কারণ অবশ্য আমার বড় বোনের স্বামী যিনি ছিলেন সাবেক পাকিস্তান সরকারের অধীন একজন ইপিসিএস ( প্রশাসন ) কর্মকর্তা , তিনি স্বাধীনতার আগে কোনো এক সময় ঢাকা থেকে একা গোপালগঞ্জ আসার সময় পদ্মায় লঞ্চডুবির শিকার হয়েছিলেন। পদ্মায় মাছ ধরার জেলেরা তাঁকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করে তাদের বাড়িতে রেখে সুস্থ করে ঢাকায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। আমি তখন মা'র সাথে খুলনা মামা বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম । খবরটি শুনে মা অনেক কান্নাকাটি করে গোপালগঞ্জ ফিরে এসেছিলেন। মা'র সেই ভীষণ কান্না ছোটবেলা হতেই আমার মনে পদ্মায় ডুবে মরে যাবার আতংক তৈরি করেছিল !
এরপর ১৯৭৪ সালের পর হতে ১৯৭৭-৭৮ সালের মধ্যে কোনো একসময় সম্ভবত গোপালগঞ্জ মধুমতী নদী "ড্রেজিং"-এর পর কিছুদিন "স্টিল বডি হাইস্পিড লঞ্চ" চলাচল শুরু করেছিল। এসময় লঞ্চ ডুবে যাবার ভয় কিছুটা কম নিয়ে গোপালগঞ্জ- ঢাকা-গোপালগঞ্জ চলাচল করলেও ২-১ বার লঞ্চ চরে আটকে যাবার ভয়ংকর বিপত্তি সহ্য করতে হয়েছে ।
আমার বিয়ের পর সম্ভবত ১৯৮২-৮৩ সালের পর শুরু হলো আরেক ধরনের জার্নি বিপত্তি বা প্রহসন- যাকে বলা হতো গোপালগঞ্জ-ঢাকা "বাই রোড" জার্নি! জার্নি ছিল এরকম যে, স্কুটার ধরনের যানবাহনে ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে ভয়ংকর ঝাঁকি সহ্য করে " গোপালগঞ্জ থেকে টেকেরহাট " পৌঁছানো, সেখান থেকে প্রায় ভাঙা বাসে করে ফরিদপুর, আবার ফরিদপুর থেকে অন্য বাসে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট, ফেরি পার হয়ে আরিচা পৌঁছে অন্য বাসে ঢাকা। না বুঝে এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা একবারই হয়েছিল ।
বিয়ের পর ১৯৮৩ সালে মা’র মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মাত্র ২ বার গোপালগঞ্জ গিয়েছিলাম বরং মা-ই ঢাকা এসে বেড়াতেন আমাদের কাছে । মা'র মৃত্যুর পর ২০০০ সাল পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় গোপালগঞ্জ গিয়েছি খুলনা হয়ে । এরপর ২০০৪ সাল থেকে গাড়ি নিয়ে ঢাকা থেকে আরিচা হয়ে ফরিদপুর হয়ে গোপালগঞ্জ--মোটেও আরামদায়ক জার্নি না বরং ফেরি পারাপারের জন্য মহাবিরক্তিকর আর বিষাদময় সে জার্নি ।
২০০৮ সাল হতে মাওয়া ফেরিঘাট হয়ে গোপালগঞ্জ গিয়েছি কয়েকবার ।
২০১৮ সালে হজে যাবার আগে গোপালগঞ্জ বেড়াতে যাবার পথে ফেরিতে বসে দৃশ্যমান নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর কিছু অংশ দেখে অভিভূত হয়ে যাই ! মা-আব্বার জন্য কান্না পায়, কি অমানবিক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাঁদের গোপালগঞ্জ-ঢাকা-গোপালগঞ্জ যাতায়াতকালে!! মৃত্যুর ঠিক আগে ভীষণ দুর্বল, শীর্ণ স্বাস্থ্যের আব্বার পক্ষে অবশেষে দীর্ঘ সময় ধরে সীমাহীন কষ্ট করে ঢাকা যাতায়াত প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে তিনি শেষবারের জন্য একদিন ঢাকার উদ্দেশে ছোট লঞ্চে করে হরিদাশপুর পর্যন্ত গিয়ে আবার গোপালগঞ্জ ফিরে এসে গোপালগঞ্জ মিশন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন , কিন্তু ভর্তি অবস্থাতেই চিকিৎসাধীন থাকাকালীন ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন । শুধু মনে হতো- পদ্মার ওপর একটি ব্রিজ থাকলে হয়তো আব্বাকে এভাবে অল্প বয়সে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হতো না...! আমরা হয়তো অতি দ্রুত তাঁকে ঢাকা নিয়ে যেতে পারতাম ।
আব্বার স্বপ্ন ছিল পদ্মা সেতু দেখার। তাঁর বিশ্বাস ছিল "আমাদের শেখ মুজিব একদিন পদ্মা ব্রিজ বানাবেনই, তোমরা দেখো, তখন আমাদের ঢাকা যাতায়াতের সব কষ্ট লাঘব হয়ে যাবে !!" তাঁর সেই স্বপ্ন ছিল দুর্বলমনের সুখ কল্পনা, এই কল্পনার বাস্তবায়ন হবে আমরা তখন ভাবতেও পারতাম না !
২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে আমি আপাতত শেষ গোপালগঞ্জ গিয়েছি। করোনা মহামারির আগে আমার একমাত্র ভাইয়ের "হার্ট এটাক"-এর খবর শুনে আমি কাঁদতে কাঁদতে আমার স্বামীকে নিয়ে গোপালগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলাম, সাথে ছিল আমার সদ্য প্রয়াত ছোট বোন তার স্বামীসহ। মাওয়া ফেরিঘাট থেকে ফেরিতে উঠার পর পদ্মা সেতুর কয়েকটি দৃশ্যমান "Span" দেখে আমার ছোট বোন আনন্দে অভিভূত হয়ে যায়! সে বাচ্চাদের মতো আনন্দ করতে থাকে, পদ্মা সেতুকে পেছনে রেখে অনেক ছবি তুলতে থাকে , এরপর একটি Span -এর নিচে দিয়ে যখন ফেরিটি পার হয়ে যাচ্ছিল তখন সে আনন্দে চিৎকার করে বলছিল " ছোট আপা দেখ দেখ আমরা পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে যাচ্ছি, কি আনন্দ যে লাগছে আমার ।" সে মহাআনন্দে আরও বলতে থাকে "ছোট আপা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পরদিনই তুই এইভাবেই আমাকে সাথে নিয়ে গোপালগঞ্জ যাবি ...।"
পদ্মা পার হয়ে গোপালগঞ্জের দিকে অভূতপূর্ব "approach Road " দেখে আমি আর আমার বোন অভিভূত হয়ে যাই, আমার আনন্দে থাকে নিঃশব্দ কৃতজ্ঞতা! আমার আদরের ছোট বোন সশব্দে, অট্টহাসিতে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে আর আমি তার আনন্দটুকু ভিডিও করে রাখি। তার মৃত্যুর পর যখন খুব মন খারাপ লাগে তখন তার সেদিনের সেই অট্টহাসির ভিডিও শুনে মন ভালো করার চেষ্টা করি। সেই ছিল তার শেষ গোপালগঞ্জ যাত্রা, এরপর মহামারি করোনার ভিতরই সে মারা যায় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে । পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গাড়িতে করে পার হয়ে গোপালগঞ্জ যাবার স্বপ্ন নিয়েই সে দুনিয়া ছেড়ে চলে যায় ।
আমি খুবই সংক্ষিপ্তভাবে আমাদের স্বপ্নের সেতুর বাস্তব গল্প লিখেছি, আমাদের কালের বিবর্তনের বাস্তব গল্প লিখেছি! এরকম কোটি মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প আছে এই স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে ঘিরে !
আমার মতো কোটি মানুষের শুকরিয়া, কৃতজ্ঞতা, অন্তরের অন্তস্থল থেকে দোয়া, সশ্রদ্ধ ভালোবাসা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুকন্যা, সুলক্ষণা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী "শেখ হাসিনার" প্রতি ! আমাদের মহাবিবর্তনের স্বপ্ন পূরণের মহানায়কের প্রতি ।
মহান আল্লাহ তাঁকে সুদীর্ঘজীবী করুন, সুস্থ রাখুন ।
তিনি বেঁচে থাকুন আমাদের সব স্বপ্ন পূরণের দিকনির্দেশনার বাতিঘর হয়ে !
লেখক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট , বাংলাদেশ