ওয়াসার কারণে থমকে মেট্রোরেলের কাজ, কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়ায় যানজটের বিড়ম্বনা

প্রকাশ | ১৩ মে ২০২২, ১৭:৪৪ | আপডেট: ১৩ মে ২০২২, ১৮:৫৩

শেখ সাইফ, ঢাকাটাইমস

মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের কাজ অনেকটাই শেষ পর্যায়ে। এই অংশের বেশির ভাগ এলাকা থেকে সড়ক থেকে নিরাপত্তা ব্যারিকেড সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম কাজিপাড়া-শ্যাওড়াপাড়ার প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা। এখানে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। মেট্রোরেলের নির্মাণসামগ্রী, ব্যারিকেডের পাশাপাশি ওয়াসার বিশাল বিশাল পিপা সড়ক জুড়ে। তাদের কাজের জন্য আটকা পড়েছে মেট্রোরেল। ফলে কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া স্টেশনের ওপরের কাজ শেষ হলেও সিঁড়িসহ নিচের আরও কিছ কাজ বাকি আছে। তাতে প্রলম্বিত হচ্ছে এ এলাকার যানজটের দুর্ভোগ।

সরেজমিনে ঘুরে এমনই চিত্র দেখেছেন এই প্রতিবেদক। এ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নানা জনের সঙ্গে। সজল শিকদার নামের এক ব্যক্তি মিরপুর সড়কের বর্তমান সংকট হিসেবে কাজীপাড়া-শ্যাওড়াপাড়া এলাকার যানজটকে বড় করে দেখছেন। এ জন্য মেট্রারেলের ব্যারিকেড আর ওয়াসার কাজকে দায়ী করেন।

রমজানে রাজধানীতে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। বিশেষ করে মেট্রোরেল নির্মাণ হচ্ছে যেসব এলাকায়, সেখানকার জ্যাম ভেঙে গন্তব্যে পৌঁছাটা ছিল এক দুরূহ কাজ। মিরপুর ১২ থেকে মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া- এই রোডে মেট্রোরেলের কাজে সড়কের বড় একটা অংশ দখল করে রাখা হয়েছে কংক্রিটের ব্যারিকেড। আবার সড়কের এক পাশ বন্ধ থাকায় কেবল অন্য এক পাশ দিয়েই ডবল লেন করে রিকশা, ভ্যান, প্রাইভেটকার, গণপরিবহন যাতায়াত করছে।

কথা প্রসঙ্গে কাজী রাশেদ নামের একজন মেট্রোরেল নির্মাণকর্মী বলেন, উত্তরা থেকে মিরপুর দশ পর্যন্ত যতগুলো মেট্রোরেল স্টেশন আছে, তার সব কটির কাজ শেষ হতে চলেছে। লিফট লাগানোর কাজও প্রায় শেষ। কাজীপাড়া ও শ্যাওড়াপাড়া স্টেশনের কাজ অনেক বাকি। এই দুই স্টেশনের কাজ শেষ হলেই সড়কের ব্যারিকেডগুলো সরিয়ে দেওয়া হবে। আর তখন এ রকম জ্যাম তৈরি হবে না।

কাজীপাড়া ও শ্যাওড়াপাড়া সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সারি সারি রাখা কংক্রিটের ব্যারিকেড, কোথাও রড ঝালাইয়ের কাজ চলছে, কোথাও বা বড় গর্ত খোঁড়া রয়েছে। আবার কোথাও বা ওয়াসার কাজ চলছে। সড়কের পাশে সারি সারি করে রাখা ড্রেনেজ সিস্টেমের ম্যানহোলের জন্য কনক্রিটের বড় বড় পিপা। কোথাও কোথাও ইট-বালির স্তূপ। বড় বড় ভেকু মেশিন গাড়ি। এসবের জন্য সড়ক অনেক সঙ্কুচিত হয়ে আছে। দেখে মনে হয় না এটা কোনো সড়ক।

এসব ব্যারিকেড কবে নাগাদ সরতে পারে? জানতে চাওয়া হয়েছিল মেট্রোরেল নির্মাণকাজে নিযুক্ত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সাত্তারের কাছে। তিনি বলেন, ‘এখন মূলত ৭ ও ৮ নম্বর স্টেশনের (কাজীপাড়া ও শ্যাওড়াপাড়া) কাজ চলছে। কিন্তু আমাদের কাজ থেমে আছে ওয়াসার কাজের জন্য। ওয়াসা তাদের কাজ শেষ করে আমাদের বুঝিয়ে দিলেই আমাদের কাজ পুরোদমে করা যেত। কিন্তু ওয়াসা কাজ করছে ধীরগতিতে। বলা চলে মেট্রোরেলই এখন নিজেদের গরজে ওয়াসার সমাপ্ত কাজগুলো করছে।’

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সাত্তার আরও বলেন, ‘আমাদের এসটিবি প্লান্টের (সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) কাজ বাকি আছে। ওয়াসার ম্যানহোলের কাজ বাকি রয়েছে। ওয়াসা রোড ব্যাক পাইলিং না করেই চলে গেছে। আমরা নিজেদের তাগিদে সেগুলো করে রোড ডাইভারশন করে দিয়েছি। কারণ একপাশের রোড বন্ধ রেখে আর একপাশ দিয়ে ডবল লেন করে গাড়ি চলতে দেওয়া আমাদের সমস্যা হচ্ছে। ওয়াসা তাদের কিছু ম্যানহোলের স্লাবগুলো বসাইনি। ওগুলোর উপর আমরা স্টিল প্লেট দিয়ে ওয়ান ওয়ে করে কাজ চালাচ্ছি, যেন মোটামুটি গাড়ি চলতে পারে।’

মেট্রোরেলের স্টিল পিকচার ওয়ার্কার হিসেবে কর্মরত সাহাদত হোসেন বলেন, তিন বছর ধরে মেট্রোরেলে কাজ  করছি। কাজ তো প্রায় শেষের পথে। ঈদের ছুটিতে কাজ কম হচ্ছে। লোকজন আইলে আবার কাজ শুরু হবে। খুব তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হবে। তখন রোড ফাঁকা হলে আর জ্যাম লাগব না।                

মেট্রোরেল থেকে যানজট নিরসনের দায়িত্বে থাকা রাব্বি মিয়া জানান, ‘কয়েক কোম্পানি মিলে মেট্রো রেলের কাজ চলছে। সব কোম্পানি তো আর এক রকম না। তাই কাজের গতিও অনেক সময় কম-বেশি হয়। আবার আমাদের সব শ্রমিক দক্ষ না। যেসব জনবল দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে তারা যদি এই কাজে এক্সপার্ট হতো তাহলে কাজ আরও এগিয়ে যেত। জনভোগান্তি অনেক আগেই কমে যেত। যেখানে যেখানে ব্যরিকেডগুলো আছে এগুলো উঠে গেলেই রাস্তা আরও ফাঁকা হবে। তখন জ্যাম একদম কমে যাবে।’

ঈদের পর ইতিমধ্যে ফার্মগেট-কাওরান বাজার-বাংলামোটর অংশে ব্যারিকেড তুলে নেওয়া হয়েছে। এতে সড়ক ফিরে পেয়েছে তার প্রশস্ততা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে বাকি অংশগুলো থেকেও উঠে যাবে শিগগির।

ফার্মগেটের মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে থাকা কাজী বিপ্লব বলেন, সিগনালের জ্যাম এত সহজে কমবে না। তবে রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে গেলে অনেক গাড়ির গমনাগমন সহজ হবে। এখন তো মেট্রো রেলের জন্য রাস্তা অনেক জায়গায় ব্লক হয়ে আছে। ব্যারিকেড দেওয়া। এর জন্য জ্যাম সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো সরে গেলে অনেকটা যানজট কমে যাবে।’

সরকারের ঘোষণামতো, আগামী ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও (১ থেকে ৯ নম্বর স্টেশন) পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হবে। কাজীপাড়া ও শ্যাওড়াপাড়া স্টেশনের কাজ কিছু বাকি থাকলেও ট্রেন চালু‍ুহবে বলে সূত্রে জানা গেছে।

কাজীপাড়া ও শ্যাওড়াপাড়া এলাকার কাজের অগ্রগতি নিয়ে সিভিল সুপারভাইজার মোহাম্মাদ রেজাউল করিম বলেন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কৌশল অনুযায়ী ১ থেকে ৯ নম্বর স্টেশনের কাজ আগে শেষ করা হবে। যেহেতু এই স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন ডিসেম্বরে চলাচল করবে। ৭ ও ৮ নম্বর স্টেশন ছাড়া অন্যগুলোর শেষ করা হয়েছে। আর ট্রেন চলাচল করতে করতে এই দুই স্টেশনের যদি কিছু কাজ বাকি থাকে তাহলে সেগুলো শেষ করা হবে।’ 

চলমান কাজের বিষয়ে এই সিভিল সুপারভাইজার বলেন, মূলত সব স্টেশনের প্রধান প্রধান কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। কাজীপাড়া ও শ্যাওড়াপাড়া স্টেশনের কাজ সমানতালে একই প্লানে চলছে। এখানে এখন স্টেয়ার (উপরে উঠার সিঁড়ি), স্কেলেটর ও লিফট এগুলোর কাজ চলছে। এসটিবি প্লান্টের (সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) কাজ চলছে। এছাড়া ফিনিশিং, কোডিং , পেইন্টিং এসবের কাজ বাকি আছে।

মেট্রোরেলের কাজের জন্য সৃষ্ট যানজট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রোজার সময় যে রকম যানজট ছিল, সেটা এখন অনেকটায় কমে এসেছে। যেখানে যেখানে কাজ শেষ হচ্ছে সেখানকার সড়ক থেকে সবকিছু সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কাজিপাড়া থেকে শ্যাওড়াপাড়া এক কিলোমিটারের মতো দূরত্বটুকুতে এখনো জ্যাম লাগছে। কিছুদিনের মধ্যে এখান থেকেও নির্মাণ সামগ্রী সরিয়ে নেওয়া হবে, তখন  আর জ্যাম থাকবে না।’        

জানা গেছে, দেশের বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে হলঘরের ছাদ, প্ল্যাটফর্মের ছাদ, ইস্পাতের ছাদ ও আইকনিক স্টেশনের মাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬-এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে।

নির্মাণপ্রক্রিয়া-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, ইতোমধ্যে সার্ভিস ট্রান্সফার, চেক বোরিং, টেস্ট পাইল, মেইন পাইল, পাইল ক্যাপ, আই-গ্রিডার, প্রিকাস্ট সেগমেন্ট কাস্টিং ও সব স্টেশনের জন্য সাব-স্ট্রাকচার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।

এ ছাড়া কনকার্স রুফ, প্ল্যাটফর্ম রুফ, স্টিল রুফ স্ট্রাকচার, আইকনিক স্টেশন স্থাপনসহ সব স্টেশনের জন্য কনকার্স রুফ ও রুফ স্টিলের নির্মাণকাজও সম্পন্ন হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, নির্মাণকাজের চলমান গতি অব্যাহত থাকলে আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।

উত্তরা সেক্টর-৩ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে, যা কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত বর্ধিত হবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল-কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত মোট ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার মেট্রোরেলের সার্বিক নির্মাণকাজ ৭৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। অন্যদিকে উত্তরা ও আগারগাঁওয়ের মধ্যবর্তী রেললাইনের ৯২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৭৮ দশমিক ১৯ শতাংশ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে।

মোট ১৬টি স্টেশনের মধ্যে নয়টির প্রবেশ ও বাহির পথের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে, আর ছয়টি স্টেশনের প্রবেশ ও বাহির পথ নির্মাণকাজ চলছে।  

(ঢাকাটাইমস/১৩মে/মোআ)