দাপুটে লিয়াকত কনডেম সেলে, জানুন তার অতীত

প্রকাশ | ১৫ মে ২০২২, ০৭:৪৬ | আপডেট: ১৫ মে ২০২২, ১৮:৩১

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পেয়ে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে যোগদানের সাত মাসের মধ্যেই তিনি এলাকায় হয়ে ওঠেন মূর্তিমান আতঙ্ক। মাদক কিংবা মানবপাচারের অভিযোগ তুলে যাকে-তাকে ধরে নিয়ে যেতেন। আটকে রেখে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে আদায় করতেন অর্থ। টাকা নিয়েও অনেককে ক্রসফায়ারের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

একসময়ের দাপুটে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী এখন মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে কনডেম সেলে। আসুন জানি তিনি কীভাবে হয়ে উঠলেন ‘ইনস্পেক্টর’ লিয়াকত আলী।

এই পুলিশ কর্মকর্তা চাকরিজীবনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রভাব দেখিয়েছেন সর্বত্র। বিশেষ করে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে জড়িয়েছেন ভয়ংকর সব অপরাধে। মাদক কারবার, সিএনজি টার্মিনাল, গ্রাম্য সালিশ, মাছের ঘাট-আড়ত যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই হাত দিয়েছেন। প্রতি মাসে তার নামে উঠত চাঁদা।

স্বেচ্ছাচারিতায় বেপরোয়া হয়ে ওঠা লিয়াকত আলী যেন ছিলেন সব জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। কিন্তু আটকা পড়েন সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদকে হত্যা করে। আদালতের ভাষ্য, মেজর (অব.) সিনহাকে পরিকল্পিতভাবে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন পুলিশের ইনস্পেক্টর লিয়াকত আলী।

আলোচিত এই হত্যা মামলায় গত ৩১ জানুয়ারি আদালত লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড দেয়। এরপর মৃত্যুপরোয়ানা নিয়ে কারাগারের কনডেম সেলে কাটছে তার বন্দিজীবন। এই মামলায় আদালত ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড, ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। রায়ে খালাস পান সাতজন।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই টেকনাফ থানার ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশে লিয়াকত আলী মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা করেন। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টে এ ঘটনার পর আলোচনায় উঠে আসেন বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের তখনকার পরিদর্শক লিয়াকত আলী। তিনি সিনহার গায়ে চারটি গুলি করেন।

কারাগারে কীভাবে সময় কাটে লিয়াকতের

সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড নিয়ে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন লিয়াকত আলী। কারাগার সূত্রে জানা গেছে, কনডেম সেলে অন্য আসামিদের সঙ্গেই থাকছেন লিয়াকত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেও তার প্রতি আলাদা করে বাড়তি নজরদারি নেই। কারণ, এই সেলে সব দাগি অপরাধীদের রাখা হয়। সেভাবেই এখানকার নিরাপত্তা আয়োজন সাজানো।

সাধারণ অন্য কয়েদিদের মতোই খাবার পান লিয়াকত আলী। দিনের বেশির ভাগ সময় সেলে শুয়ে-বসে সময় কাটে তার। পরিবারের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন বলে জানান কারাগারটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।

এত অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন লিয়াকত, তার মধ্যে কি কোনো অনুশোচনার লক্ষণ দেখা যায়- জানতে চাইলে কারাসূত্রটি জানায়, ‘না, তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা বোধ নেই। তবে মাঝেমধ্যে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করেন। আর বন্দি পরিবেশও মানিয়ে নিয়েছেন।’

পুলিশে যোগদান ও লিয়াকতের উত্থান

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব হুলাইন গ্রামের মৃত মো. সাহাব মিয়ার ছেলে লিয়াকত। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। ২০১০ সালে পুলিশে যোগ দেন। প্রথমে ডিবি, পরে সোয়াত ও অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটে কাজ করেন। ২০১৮ সালের শেষ দিকে পুলিশ পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। এ সময় তিনি টেকনাফ থানায় কর্মরত ছিলেন।

একাধিক বিয়ে করেন লিয়াকত

লিয়াকত আলী প্রথমে চন্দনাইশ উপজেলায় বিয়ে করেন। ওই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে বোয়ালখালীতে আরেক বিয়ে করেন। এই ঘরে তার দুই বছরের এক ছেলে রয়েছে।

নিয়মিত মাসোহারা আদায়

২০১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি বাহারছাড়া তদন্ত কেন্দ্রে যোগ দেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত। ওসি প্রদীপের প্রশ্রয়ে এলাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ- মাদক ব্যবসায়ী ও মানবপাচারের অভিযোগ তুলে অনেকের কাছ থেকেই চাঁদা আদায় করতেন লিয়াকত। এলাকার বেশ কয়েকটি ফিশারিজ ঘাট থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন। চাঁদা না পেলে মাছের ভেতর ইয়াবা রয়েছে বলে মাছ রাস্তায় ছিটিয়ে দেওয়াসহ নানাভাবে হয়রানি করতেন। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে ২০-৫০ হাজার টাকা করে আদায় করতেন লিয়াকত।

লিয়াকতের বিরুদ্ধে ভয়ংকর অভিযোগ

ওসি প্রদীপের মতো তার বিরুদ্ধেও যাকে-তাকে ক্রসফায়ারের অভিযোগ রয়েছে। মাদক কিংবা মানবপাচারের অভিযোগ তুলে ধরে নিয়ে যেতেন। আটকে রেখে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে আদায় করতেন অর্থ। টাকা নেয়ার পরও ক্রসফায়ারে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে লিয়াকতের বিরুদ্ধেও। মানব পাচারের অভিযোগে নোয়াখালীপাড়া গ্রামের আবদুল হাকিমের ছেলে আবদুস সালামকে তুলে নেন লিয়াকত। এরপর ওই পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা নেন। সালামকে বন্দুকযুদ্ধের নামে (২৬ এপ্রিল ২০১৯) হত্যা করেন বলে অভিযোগ পরিবারের। এ ঘটনার পর এলাকার সবাই লিয়াকত ভয়ে তটস্থ থাকত।

ঘাট থেকে চাঁদা তোলা

শামলাপুরের প্রতিটি ঘাট থেকে পুলিশের জন্য খরচ নিতেন লিয়াকত আলী। শুরুতে ঘাটপ্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে নিতেন। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না লিয়াকত ও তার সহযোগীরা। মৎস্য ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চাঁদার টাকা বাড়াতে গালিগালাজ করতেন লিয়াকত। পরে চাঁদার টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

তাছাড়া লিয়াকত তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালে পুলিশের খাবারের কথা বলে টাকা ছাড়াই মাছ নিতেন। কিন্তু যত মাছ নিতেন এত মাছ তাদের প্রয়োজন হতো না। সেই মাছ আড়তে বিক্রি করে টাকা নিয়ে যেতেন।

৩৯৯-৫০০ টাকাও চাঁদা নিতেন

শামলাপুর বাজারে প্রায় ৩০টি মাছের আড়ত রয়েছে। এসব আড়তে প্রতিদিন ৩০-৫০ জন ব্যবসায়ী মাছ কিনতে আসেন। এসব ছোট মাছ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা নিতেন লিয়াকত। তাছাড়া প্রত্যেক টমটম গাড়ি থেকে মাসে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা নিতেন। গ্রাম্য সালিশের নামে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে লিয়াকতের বিরুদ্ধে।

 (ঢাকাটাইামস/১৫মে/এসএস/মোআ)