সেই সম্রাট, এই সম্রাট

প্রকাশ | ১৫ মে ২০২২, ১৪:৩১ | আপডেট: ১৫ মে ২০২২, ১৫:২১

সৈয়দ ঋয়াদ, ঢাকাটাইমস

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। এই পদে থেকে শুধু ঢাকা মহানগর নয়, বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ ক্যাসিনো, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে ছিল তার একচ্ছত্র প্রভাব।

ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় রাজধানীর অফিসপাড়াখ্যাত মতিঝিল, পুরান ঢাকা, গুলিস্তান ও পল্টনে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

মূলত ১৯৯৩ সালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৫৩ নং ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক হওয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে সম্রাটের পথ চলা শুরু।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুবলীগের দৃশ্যপটে চলে আসেন তিনি। সেই সময় বড় বড় নেতাদের হাত ধরে শহরে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি।

২০০৩ সালে মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সংগঠনে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেন। বিএনপি সরকারের আমলে এই পদে থাকলেও সমস্যা হয়নি তার। ওয়ান ইলেভেনের পট পরিবর্তনের পর যখন আবারো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন কেন্দ্রীয় যুবলীগে প্রভাবশালী হয়ে উঠেন এই মুকুটহীন সম্রাট।

২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ সালে যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ওমর ফারুক চৌধুরী। তার হাত ধরে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট যুবলীগের রাজনীতিতে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন। সেই বছরই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় সম্রাটকে।

মহানগর যুবলীগ সভাপতি পদে আসীন হয়েই দল ক্ষমতায় থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেন এই যুবলীগ নেতা। রাজউক, সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত, সেক্রেটারিয়েটসহ সরকারি সব অফিসে টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতেও হয়ে উঠেন একচ্ছত্র। যেকোনো কাজেই ‘ভাইয়ের লোক’ পরিচয়ে চাঁদাবাজি করতো সম্রাটের লোকেরা।

এসবের বাইরেও মহানগর দক্ষিণের ক্যাসিনো ব্যবসাও ছিল সম্রাটের একক নিয়ন্ত্রণে, মতিঝিলের ইয়ংমেনস ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, দিলকুশা ও মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের জুয়ার টাকার একটি অংশ চলে যেতো এই যুবলীগ নেতার ব্যক্তিগত তহবিলে। সেই সঙ্গে যুবলীগের পদ বাণিজ্যেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন ওমর ফারুক চৌধুরীর ডান হাত।

মূলত দেশের সবচেয়ে আলোচিত ক্যাসিনো অভিযানের আগেই সম্রাটের অনৈতিক নানা কাজের অভিযোগ চলে যায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী  ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার কাছে।

প্রধানমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে নাম প্রকাশ না করে ‘আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম’ নামের দাতব্য প্রতিষ্ঠানে সম্রাটের চাঁদা চাওয়ার বিষয়টিতে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘নেতাকর্মীরা এখন লাশের কাছ থেকেও চাঁদা নেয়।’

সম্রাটের বিষয়ে খোদ দলীয়প্রধানের ক্ষোভ প্রকাশের পরও তাকে গ্রেপ্তার না করার বিষয়ে অনেক আওয়ামী লীগ নেতাই অবাক হয়েছিলেন। সবার কাছেই বিস্ময়ের বিষয় ছিল সম্রাটের খুঁটির জোর নিয়ে। কারণ ২০১৯ সালে ক্যাসিনো অভিযানে অনেক নেতাকর্মী আটক হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন সম্রাট।

২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযানের মাধ্যমে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানের নেতৃত্ব দেয় এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব)।

ওই অভিযানেই সাতজন ক্যাসিনো গডফাদারসহ ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগ দক্ষিণের সে সময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইয়ংমেনস ক্লাবের পরিচালক খালেদ মাহমুদ ভূইয়াকে।

ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে যুবলীগের অনেক নেতাকর্মীকে আটক করলেও মূলহোতা সম্রাটকে গ্রেপ্তার না করা নিয়ে অনেকের মধ্যেই তীব্র সমালোচনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তখন একটি কথা চাউড় হয়েছিল সম্রাটের বিরুদ্ধে ‘শুট এট সাইট’ এর অর্ডার রয়েছে। যে কারণে প্রাণ বাঁচাতে সম্রাট আওয়ামী লীগের কোনো নেতার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

তবে খালেদ মাহমুদ ভূ্ইয়াকে গ্রেপ্তার করার পর ক্যাসিনোকাণ্ডে সম্রাটের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ  তথ্য পায় র‌্যাব। অভিযান শুরুর উনিশ দিনের মাথায় ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর ক্যাসিনোকাণ্ডের মূল হোতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহচর হিসেবে পরিচিত মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সভাপতি এমরানুল হক আরমানকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

গ্রেপ্তারের পর সেদিনই সম্রাটকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়, একই দিন র‍্যাব রাজধানীর কাকরাইলে সম্রাটের ব্যক্তিগত কার্যালয় এবং দুই বাসভবনে একযোগে তল্লাশি চালায়। র‍্যাব সেই  অভিযানে সম্রাটের বাসা থেকে অবৈধ অস্ত্র, মাদক এবং ক্যাঙ্গারুর চামড়া উদ্ধার করেছিল। অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী চামড়া রাখার অভিযোগেই ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ছয় মাসের জেল দেয়, এই মামলাতেই কারাগারে পাঠানো হয় তাকে।

সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার ক্যাসিনোতে প্রায় ২২২ কোটি টাকা পাচার, ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক রাখার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুদক, র‌্যাব ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সর্বমোট চারটি মামলা দায়ের করে।  সম্রাটকে কারাগারে পাঠানোর মধ্য দিয়ে যুবলীগের রাজনীতিতে সেই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

তার অনেক সহকর্মী-সহচরও অভিযানের ভয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। তবে সম্রাটকে আটকের কিছুদিন পরই তার মুক্তি চেয়ে ব্যানার পোস্টার ফেস্টুন শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রায় ৩২ মাস জেলে থাকার পর গত ১১ মে চার মামলায় তিনটি শর্তে জামিন পান সম্রাট। আদালতের শর্তগুলো হচ্ছে- পাসপোর্ট জমা, স্বাস্থ্য পরীক্ষার আপডেট ও আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে হবে তাকে। সম্রাটের জামিনের পরই তার কর্মী-অনুরাগী যারা গত পৌনে তিন বছর শীতনিদ্রায় ছিলেন, তারা বের হতে শুরু করেছেন। শত শত কর্মী ফুলের তোড়া দিয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে লাইন ধরেছেন হাসাপাতালের করিডোরে। কারামুক্ত সম্রাটের সঙ্গে ছবি তুলছেন। তাদের অনেকেরই আশা  সম্র্রাট আবার রাজনীতিতে ফিরবেন।

সম্র্রাটের রাজনীতিতে ফেরা না ফেরার বিষয়ে আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন। নিজের নাম না প্রকাশ করার  শর্তে  তিনি বলেন, সম্রাট সাজাপ্রাপ্ত আসামি, শর্ত সাপেক্ষে জামিনে মুক্ত, তিনি নির্দোষ নন। যদি আদালতে নির্দোষ প্রমাণ হয় সেটা  এক বিষয়। 

বর্ষীয়ান এই নেতা বলেন, ক্যাসিনোকাণ্ডের পর তার আওয়ামী রাজনীতিতে ফেরার আমি কোনো চান্স দেখি না। যদি আওয়ামী রাজনীতিতে সম্র্রাট ফিরে আসে সেটা শুদ্ধ রাজনীতির চর্চার পথকে ব্যাহত করবে। তখন সম্র্রাটদের রোখা যাবে না।

(ঢাকাটাইমস/১৫মে/এসআর/আরকেএইচ)