সম্রাটের কাকরাইলের অফিস এখন...

প্রকাশ | ১৬ মে ২০২২, ০৭:৪৯ | আপডেট: ১৬ মে ২০২২, ০৯:৫০

আবদুল হামিদ, ঢাকাটাইমস
ফাইল ছবি

রাজধানীর কাকরাইলে রাজমণি নামের প্রেক্ষাগৃহের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের অফিস ছিল। সিনেমা জগতের মানুষের পদচারণে মুখর ছিল জায়গাটি। তাদের দেখতে আসত সাধারণ মানুষ। সিনেমা শিল্পের ভাটার টানে ধীরে ধীরে অনেক অফিস উঠে যায়। তখন ভিড়ের মানুষ বদলায়। বাড়তে থাকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভিড়। এখানে আস্তানা গাড়েন আরেক ‘তারকা’। তীর্থ হয়ে ওঠে রাজমণির পাশের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার। এই ভবনেই যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের কার্যালয়।

আবারও মানুষ বদলায়। এবার ধীরে নয়, হঠাৎ বজ্রপাত। যে মানুষেরা এখানে আসতেন, তাদের চোখেমুখে ভয়-আতঙ্ক। রাজমণির নিত্যসরগরম গলিপথটি অনাগত বিপদের ফিসফিসানির জোয়ারে ভাসে। ম্রিয়মাণ হয়ে আসে আলো। প্রতিদিনের পরিচিত মুখগুলোর পা পড়ে না আর। যে ‘নক্ষত্র’ ঘিরে গ্রহ-উপগ্রহগুলো ঘুরপাক খেত, সেই সম্রাট আটক হয়ে কারাগারে। 

কিছু দিন সেখানে শোভা পেতে দেখা গেছে সম্রাটের মুক্তির দাবিতে ব্যানার-ফেস্টুন। সেসবও একদিন রোদে-বৃষ্টিতে ক্ষয়ে পড়ে। যারা এখানে এসে নেতার কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, তাদেরও আর পা পড়ে না এই বাটে। দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ নির্জন পড়ে থাকা ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারের নাম পাল্টে যায়। হাজী লতিফ ট্রেড সেন্টার। আবার আলো জ্বলে। চলচ্চিত্র অফিস কিংবা সম্রাটের কার্যালয় নয়, ভবনটি এখন পুলিশের বিশেষ শাখার কার্যালয় হিসেবে প্রাণ পেয়েছে।

এই ভবনে যে সম্রাটের একটা ফ্লোর কেনা আছে, তার কী হলো? সম্রাট তো মুক্তি পেয়েছেন, তার খবরে কি 
সেখানে তার অনুসারী নেতাকর্মীর আনাগোনা আছে?

প্রায় আড়াই বছর কারাভোগের পর সম্প্রতি তিন শর্তে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কুত সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট। তার কাকরাইলের রাজনৈতিক কার্যালয়ের চিত্র দেখতে সরেজমিনে যান ঢাকাটাইমসের প্রতিনিধি।

প্রথমেই ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার খুঁজতে গিয়ে বিড়াম্বনা পড়তে হয়। পরে সম্রাটের অফিসের কথা বললে দেখিয়ে দেন এক চা-বিক্রেতা। কিন্তু ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারের কোনো বিলবোর্ড দেখতে না পেয়ে আরেকজন দোকানির কাছে জানতে চাইলে তিনি দেখিয়ে দেন হাজী লতিফ ট্রেড সেন্টার, যা আগে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার ছিল।
সাবেক ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার ভবনের সামনে হাজী লতিফ ট্রেড সেন্টার নাম ধারণ করে একটি বিলবোর্ডে ঝুলছে। ভবনের সামনের পথ থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে যে সিঁড়িটি, তার মাথায় ভবনের প্রবেশপথ। ভিতরে প্রবেশ করতেই বাধ সাধলেন দুই ব্যক্তি। পরিচয় জেনে নিয়ে বললেন এটা ট্রেড সেন্টার না, পুলিশের সিটি স্পেশাল ব্রান্সের অফিস। এখানে আর কোনো সংস্থার অফিস নেই।

বর্তমানে হাজী লতিফ ট্রেড সেন্টার দায়িত্বে থাকা ফায়সাল হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, এখানে সম্রাটের অফিস থাকার সময়, বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে পুরো ভবন ঢাকা থাকত। এজন্য এই ভবনকে কেউ ট্রেড সেন্টার হিসাবে চেনে না, সবাই সম্রাটের অফিস হিসাবেই চেনেন। এখনো সম্রাটের জামিন ও মুক্তির কথা শুনলে তার অনুসারীরা এই ভবনের এসে ভিড় করেন। বছরখানেক আগে এই ভরনে নতুন ভাড়াটিয়া হয়ে আসে এসবি। তারা পুরো ভবনটিই ভাড়া নিয়ে তাদের অফিসের কাজে ব্যবহার করছেন।

গত ১০ এপ্রিল রমনা থানায় অর্থ পাচারের মামলায় সম্রাটের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত। ওই দিন ঢাকার আরেকটি আদালত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের আরো একটি মামলায় জামিন দেন তাকে। পরে গত ১১ মে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ উপার্জনের দুটি মামলায় জামিন পান এই সাবেক যুবলীগ নেতা।

র‌্যাব অভিযান চালানোর পর এই ভবনে কেউ আসত না জানিয়ে ফায়সাল হোসেন বলেন, প্রায় দেড় বছর পুরো খালি পড়ে ছিল ভবনটি। এক বছর হয় পুলিশ নয়তলা ভবনের পুরোটায় ভাড়া নিয়েছে।
তবে এই ভবনের চর্তুথ তলা পুরোটা সম্রাটের কেনা। গ্রেপ্তারের পর তাকে সঙ্গে নিয়ে এই তলাতেই অভিযান চালায় র্যা ব। পরে এটি সিলগালা করে দেয় সংস্থাটি। চতুর্থ তলাটা এখনো ওই অবস্থাতেই আছে। 
চতুর্থ তলাটি সম্রাটের কেনা হলেও পরে আস্তে আস্তে পুরো ভবনটা তার নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল বলে জানান পাশের একজন দোকানি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ভবনটির পাঁচ ও সাত তলার কনফারেন্স রুম নিজে ডেকোরেশন করে ব্যবহার করেন সম্রাট। বিভিন্ন দিবসে পার্টির পক্ষে এখান থেকে সারা রাজধানীতে ভোজের আয়োজন করতেন যুবলীগের এই সাবেক নেতা।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সম্রাট ও তার সহযোগী তৎকালীন যুবলীগ নেতা এনামুল হক আরমানকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গ্রেপ্তারের ঢাকায় এনে সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে তার কাকরাইলের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। এ সময় তার কার্যালয় থেকে দুটি কেঙ্গারুর চামড়া, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র জব্দ করা হয়। বিরল প্রজাতির বন্য প্রাণীর চামড়া রাখায় সম্রাটকে তাৎক্ষণিক ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর অস্ত্র ও মাদক রাখায় পরে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা হয়। এরপরে সিআইডি তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক।

যেখান থেকে বেকায়দায় পড়তে থাকেন সম্রাট

দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবপাড়ায় খেলাধুলার আড়ালে জুয়া, ক্যাসিনো চলছিল। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে প্রথম ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই দিন র্যা বের হাতে গ্রেপ্তার হন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। একই দিন অভিযান চলে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে। পরে কলাবাগান ক্রীড়া চক্র, ধানমন্ডি ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবেও ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান চালানো হয়। 

তাৎক্ষণিকভাবে সিলগালা করে দেওয়া হয় ইয়ংমেনস, ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, আরামবাগ, দিলকুশা ও ভিক্টোরিয়া ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের ক্যাসিনো খেলার মিলনায়তন এবং ধানমন্ডি ক্লাবের বার। 
ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো-কাণ্ডের অন্যতম হোতা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব ও দুদক পৃথকভাবে ৫৭টি মামলা করে। তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৪২টির। আর ১৫টি মামলার তদন্ত এখনো চলছে।

রাজধানীতে ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে আর ধরা পড়েন টেন্ডার কিং আরেক যুবলীগ নেতা জিকে শামীম। গ্রেপ্তার খালেদ ও শামীম জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাটের অবৈধ ক্যাসিনো সাম্রাজ্য নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। প্রকাশ্যে চলে আসে সম্রাটের ক্যাসিনো জগৎ।

অভিযানের শুরুর দিকে সম্রাট ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। প্রথম ছয় দিন তিনি কাকরাইলের এই ভবনের নিজের কার্যালয়ে ছিলেন। পাহারায় থাকত কয়েক শ যুবক। তারপর হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যান তিনি। দিন পনেরো পরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের একটি গ্রাম থেকে সম্রাট ও যুবলীগের বহিষ্কৃত আরেক নেতা এনামুল হক আরমানকে আটক করে র‌্যাব। 

গত ১১ মে জামিন পান সম্রাট। তখন তিনি কারা হেফাজতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধনি ছিলেন। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে তার চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসকরা বলছেন, তার হৃদযন্ত্রে জটিলতা আছে। সোমবার ১৬ মে মেডিক্যাল বোর্ড বসে সিদ্ধান্ত জানাবে সম্রাটকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হবে কি না। তবে তার পরিবার চাইলে অন্য কোথাও চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে যেতে পারবে।
(ঢাকাটাইমস/১৬মে/মোআ)