গণমাধ্যমকর্মী আইন মধুর বোতলে বিষ!!

প্রকাশ | ১৬ মে ২০২২, ২০:৩১ | আপডেট: ১৭ মে ২০২২, ১৭:৫৬

গোলাম মোস্তফা

সব গণমাধ্যমকে এক ছাতার নিচে আনতে সরকার একটি বিল গত সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে সরকার সব ধরনের গণমাধ্যমকর্মীর জন্য চাকরির শর্তাবলি আইনি কাঠামোয় আনতে যাচ্ছে। সাংবাদিকদেরও এটাই ইচ্ছা- সবাই এক ছাতার নিচে আসুক। সবাই একই রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করুক, একই রকম আইন-শৃঙ্খলা মেনে চলুক।

বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইন গণমাধ্যমের ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটেছে। এসব গণমাধ্যমে নিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তদারকির জন্য বিশেষায়িত কোনো আইন দেশে এখন পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। এর আগে শুধু প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের জন্য আইন ছিল। দ্য নিউজ পেপার এমপ্লয়িজ কন্ডিশন সার্ভিস অ্যাক্ট ১৯৭৪-এর অধীনে ছিলেন তারা। অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমের জন্য আইন ছিল না। পরে এসব সাংবাদিকদের শ্রমআইনের অধীনে আনা হয়।

সব গণমাধ্যম কর্মী এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে এক ছাতার নিচে আনার সরকারের চেষ্টাকে সাংবাদিকরা সাধুবাদ জানালেও কিছু ধারা একেবারে গণমাধ্যম কর্মীবিরোধী হওয়ায় তারা এ আইনকে প্রতিরোধে মাঠে নেমেছে। আইনের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন ধারা বাতিলে তারা নানা আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। খসড়া বিলে সরকার সাংবাদিক-স্বার্থবিরোধী কী কী ধারা-উপধারা সংযোজন করেছে, সে সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা যাক।

প্রথমেই আলোকপাত করি সাংবাদিকদের কাজের কর্মঘণ্টা নিয়ে। প্রস্তাবিত গণমাধ্যম কর্মী আইনে দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসেবে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে এযাবৎ স্বৈরাচার আইয়ুব খাঁ প্রবর্তিত প্রথম ওয়েজ বোর্ড থেকে সাংবাদিকরা দৈনিক ৬ ঘণ্টা হিসেবে সপ্তাহে ৩৬ ঘণ্টা কাজ করে আসছেন। ২০১৮ সালেও আইনটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপনকালে দৈনিক ৬ ঘণ্টা হিসেবে সপ্তাহে ৩৬ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নির্ধারিত ছিল। এখন কী এমন প্রয়োজনে সাংবাদিকদের কর্মঘণ্টা বাড়ানোর দরকার পড়ল তা বুঝে আসছে না।
দেশ এগোচ্ছে। ৫০ বছরে দেশের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে পাঁচগুণ। তবে কেন সাংবাদিকদের স্বস্তি দেওয়ার নামে অস্বস্তিতে ফেলানো? হাতেগোনা দু-একটি পত্রিকা ৯০-এর পর ওয়েজ বোর্ডের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার নামে কর্মঘণ্টা ৬ ঘণ্টার জায়গায় ৭ ঘণ্টা (এটা নাকি করপোরেট সংস্কৃতি!) চালু করেছে। গণমাধ্যমের কাজ মাথার কাজ। সৃষ্টিশীল কাজ। প্রতিমুহূর্তে জনগণের সামনে পরীক্ষা দেওয়ার কাজ। এ কারণেই সৃষ্টিশীল কাজে বিশ্বজুড়ে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের রেওয়াজ আছে। বাংলাদেশেও সরকারি কর্মচারীরা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে থাকেন। গবেষণায় দেখ গেছে, সাপ্তাহিক কাজের সময় সপ্তাহে ৩০-৩২ ঘণ্টা রাখা হলে কাজের ফল ভালো পাওয়া যায়। সে কারণে বর্তমানে আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের সপ্তাহে তিন দিন ছুটি নিতে উৎসাহিত করে আসছে।

এবার আসি সাংবাদিকদের গ্রাচুইটি প্রসঙ্গে। সাংবাদিকদের নেই কোনো পেনশন, নেই প্রভিডেন্ট ফান্ডেরও কোনো ঠিক-ঠিকানা। চাকরি শেষে গ্রাচুইটিই তাদের একমাত্র ভরসা। সংসদে উত্থাপিত আইনে বেতনকাঠামোয় সেই গ্রাচুইটি কমিয়ে দুটির বদলে একটির প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ বিচারপতি সাজ্জাদ জানের প্রথম ওয়েজ বোর্ড থেকেই সাংবাদিকরা বছরে দুটি করে গ্রাচুইটি পেয়ে আসছেন। স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন, যে অধিকার সাংবাদিকরা এত দিন পেয়ে আসছেন, তা কমানো কাদের স্বার্থে? কোন যুক্তিতে? বর্তমান সরকার নাকি সাংবাদিকবান্ধব সরকার, এক্ষেত্রে এই আপ্তবাক্য কতটুকু ধোপে টিকছে? প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সাংবাদিক সুরক্ষার নামে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে কিছু দান-খয়রাত করা কি ভিক্ষা দেওয়ার নামান্তর নয়? যা নিয়ে সব সময় ঢাকঢোল পিটানো হয়।

এই আইনে ৫৯ বছর বয়স হলেই স্বেচ্ছা অবসরের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সাংবাদিকতা একটি সৃজনশীল পেশা। তাই বয়সের সীমারেখা বেঁধে দেওয়া এ পেশায় একেবারেই খাটে না। গণমাধ্যমকর্মীরা আমৃত্যু চাকরি করেন- এমনটাই বিশ্বের সর্বত্র দেখা যায়। কোনো সাংবাদিক যত দিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার মতো শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবেন; তার বিরুদ্ধে যদি কোনো আর্থিক দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনজনিত কোনো প্রমাণিত অভিযোগ না থাকে, তত দিন তাকে অবসর দেওয়া ঠিক নয়। কারণ সাংবাদিকতা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা। যত বয়স বাড়ে ততই তিনি অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হন। তাদের অকাল অবসর সাংবাদপত্র শিল্পকে কানাগলিতে ঢোকাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সাংবাদিকদের অবসরের এ যুক্তি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বিলে আছে, প্রতি পাঁচ বছর পর গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ওয়েজ বোর্ড গঠন করা হবে। প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সরকার এটা গঠন করবে। এই বোর্ড প্রয়োজনে সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, বেসরকারি টেলিভিশন, বেতার ও নিবন্ধিত অনলাইন মাধ্যমের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বেতনকাঠামো নির্ধারণ করবে। এটি হবে স্বাধীন ওয়েজ বোর্ড। সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ওয়েজের নিম্নতর হার সংশ্লিষ্ট সব গণমাধ্যম মালিকের ওপর অবশ্যই পালনীয় হবে। এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায়, সব গণমাধ্যমের জন্য আইন হবে একটা; ভিন্ন ভিন্ন গণমাধ্যমের জন্য বেতনকাঠামো ভিন্ন হবে কেন? তারা কি বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য ভিন্ন ভিন্ন দামে কেনার সুযোগ পান? পদবিন্যাস বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন হতে পারে, বেতনকাঠামো ভিন্ন হবে কোন যুক্তিতে? এমনিতেই মালিকরা নাচুনি বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি শোনার আইনি সুযোগ রাখা হলে তাদের পা কি আর কোনোদিন মাটিতে পড়বে?

আসলে শুধু গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের জন্যই নয়, সব বাঁধা আয়ের পেশাজীবীর জন্যই মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিবছর বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পাকা বন্দোবস্ত করা উচিত। এ ব্যবস্থা করা হলে সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট কিংবা গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণের আর কষ্ট সরকারকে করতে হবে না। সরকার যেহেতু দেশের সবার কাছ থেকেই ট্যাক্স আদায় করে, সেহেতু এ দায়িত্বটা জনবান্ধব সরকারকেই স্বেচ্ছায় পালন করা উচিত বলে আমি মনে করি। কাজটা করতে পারলে দেশের অনেক রোগ এমনিতেই সেরে যাবে।

খসড়া অনুযায়ী, আইনটি পাস হলে সংবাদকর্মীরা আর শ্রম আইনের অধীনে থাকবেন না। আইনি কাঠামোতে সাংবাদিকরা ‘গণমাধ্যমকর্মী’ হিসেবে স্বীকৃত হবেন। কিন্তু সমস্যা যেটা হবে- এই আইনটির ফলে সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার হারিয়ে যাবে। দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য তারা আর আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারবেন না। ফলে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আইনটি পাস হলে নতুন সংগঠন হবে সাংবাদিক কল্যাণ সমিতি। ট্রেড ইউনিয়নের মতো সামান্য সুযোগটাও যদি না থাকে, তা হলে তাদের আর কী থাকল?

ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ-সুবিধা হরণ করে প্রস্তাবিত আইনে দেনা-পাওনা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য এক বা একাধিক বিভাগীয় এলাকায় গণমাধ্যম আদালত, গণমাধ্যম আপিল আদালত স্থাপনের সুযোগ রাখা হয়েছে। শুনতে কথাগুলো বেশ ভালোই লাগে। কানকে বেশ তৃপ্তিই দেয়। কিন্তু বাস্তবে তো আমরা সর্বত্রই দেখি শুভংকরের ফাঁকি। গণমাধ্যম আইনে ৬০ দিন, সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে। শ্রম আইনেও ৬০ দিন বলা আছে, কিন্তু বাস্তবে ১০ বছরের নিচে কোনো মামলা নিষ্পত্তির রেকর্ড নেই। সে জন্য কেউ আর সহজে মামলা করতে চায় না। আসলে পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের কোনো আদালতের অস্তিত্ব আছে বলে জানা নেই। সব বিষয় শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রম আদালতেই নিষ্পত্তি করার বিধান রাখা উচিত। বরং বিশেষ প্রয়োজনে শ্রম আদালতে সংবাদমাধ্যম সংক্রান্ত মামলা শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা যেতে পারে।

এবার আসি ছুটির বিষয়ে। খসড়া বিলে নৈমিত্তিক ছুটি ১০ দিনের স্থলে বাড়িয়ে ১৫ দিন করা হয়েছে। প্রত্যেক গণমাধ্যম কর্মী চাকরির ১৮ ভাগের এক ভাগ সময় অসুস্থতাজনিত ছুটি প্রাপ্য হবেন। অর্জিত ছুটি ৬০ দিনের বদলে ১০০ দিন করা হয়েছে। ১১ দিনে এক দিন করে জমা হবে। কর্মীর কল্যাণে কাজ করলে আসলে অর্জিত কোনো ছুটিই কাটা যাবে না। চাকরিকালীন যত অর্জিত ছুটি প্রাপ্য হবেন, তার সবই জমা রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়ার সময় এ অর্জিত ছুটির পয়সা পাই পাই করে কর্মীকে পরিশোধ করতে হবে। নানা অজুহাতে অনেক প্রতিষ্ঠানই অর্জিত ছুটি ভোগ করতে দিতে চায় না। সব অর্জিত ছুটি জমা রাখার বিধান করা হলে প্রতিষ্ঠান মালিকরা এ বিষয়ে আর টালবাহানা করার সাহস পাবেন না।

আলোচ্য বিলে গণমাধ্যম মালিকদের অতিরিক্ত কর্মী ছাঁটাই করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। করোনা মহামারিকালে দেশের প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ঢালাওভাবে কর্মী ছাঁটাই, বেতন-বোনাস কমিয়ে দেওয়া, বেতন বন্ধ রাখার মতো ঘটনা ঘটে। এই 'অতিরিক্ত কর্মী' বলতে কোন প্রেক্ষিতে কী বুঝানো হয়েছে, তা নিশ্চিত করা না হলে গণমাধ্যম কর্মীদের চাকরির সুরক্ষা নিশ্চিত করা আদৌ সম্ভব নয়। এ ছাড়া অসদাচরণের সংজ্ঞা না দিয়েই এই অপরাধে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিপজ্জনক বিধানও রাখা হয়েছে এতে। ১০ বা ততোধিক গণমাধ্যম কর্মীকে একসঙ্গে চাকরি অবসানের ক্ষেত্রে 'সার্বিক নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সরকারকে অবহিত করার' মতো ধারার সন্নিবেশ বানরের হাতে ধারালো অস্ত্র দেওয়ার সমতুল্য। এটা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য রীতিমতো অপমানজনক, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার নয়।
 
গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থবিরোধী এ রকম বহু ধারা-উপধারা সংসদে উত্থাপিত বিলে সন্নিবেশিত আছে, যা সাংবাদিকতার মতো সৃজনশীল পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, সাংবাদিকদের করবে কোণঠাসা।

সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। কষ্টকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও একটি সৃজনশীল পেশা। কিছু মতলববাজ লোক ছাড়া অধিকাংশ সাংবাদিক অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার, দুর্নীতি প্রকাশ করে সমাজকে শুদ্ধ করা বা রাখার মহান ব্রত নিয়েই এ পেশায় এসেছেন এবং এসে থাকেন। কিছু অসৎ-ধান্ধাবাজ লোকের জন্য বর্তমান সময়টা অন্ধকার সময়। সে জন্য সরকারও মধুর বোতলে বিষ রেখে সাংবাদিকদের খাওয়ানোর অপচেষ্টা করে যাচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক।