গরমে শরীর ঠান্ডা রাখে ভেষজ উদ্ভিদ যব

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৮ মে ২০২২, ১২:৫৭ | প্রকাশিত : ১৮ মে ২০২২, ১১:২৫

প্রাচীনকাল থেকে যব অত্যন্ত কার্যকরী ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। যবের অপর নাম বার্লি। পুষ্টিমানের দিক থেকে যব গমের চেয়ে উন্নত। পোয়াসিয়া পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ও শস্য বা বিরুৎ-জাতীয় উদ্ভিদ বার্লি বা যব। যার বৈজ্ঞানিক নাম হরডিয়াম ভালগের । এটি গম-জাতীয় এক ধরনের শস্যদানা। স্বল্পজীবী ঘাস-জাতীয় উদ্ভিদ থেকে সংগ্রহ করা হয় বার্লি।

এক সময় যব দিয়ে তৈরি রবিনসন বার্লি অত্যন্ত জনপ্রিয় শিশু খাদ্য ছিল। যব বা বার্লি কিছুটা লবণাক্ততা সহনশীল ফসল। যব দিয়ে রুটি তৈরি করা হয়। ছাতু হিসেবেও যবের খাওয়ার চল রয়েছে। শিশুখাদ্য হিসেবে রবিনসন, ওভালটিন, হরলিকস, হ্যামিলটন ও আলবার্টা যবের মূল উপাদান থেকে তৈরি করা হয়।

যবের মধ্যে রয়েছে ৬১.৮ শতাংশ শর্করা, ১৩.১ শতাংশ আমিষ, অদ্রবনীয় আঁশ ৮.৮৫ শতাংশ, আর্দ্রতা ৭.৫৫ শতাংশ, দ্রবনীয় আঁশ ৮.৮৫ শতাংশ, পেনটোসান ৪.২৮ শতাংশ, লিপিড ২.৯২ শতাংশ, ছাই ১.৮৯ শতাংশ ও অন্যান্য উপাদন ৪.২৬ শতাংশ।

বিশ্বে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনে যবের স্থান চতুর্থ। ভুট্টা, ধান ও গমের পরেই যবের অবস্থান। তবে এর উৎপাদন প্রতিবছর অব্যাহতভাবে কমছে। বাণিজ্যিকভাবে প্রধান যব উৎপাদনকারী দেশগুলো হলো কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেন। ইথিওপিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম যবের উদ্ভব হয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের আদি হরপ্পান সভ্যতার সময়- ধান, গম, মটর ও ছোলার ডাল, তিসি, সরিষা, তুলা, খেজুর ও আঙুরের সঙ্গে যব চাষের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটা একটা খরা-সহিষ্ণু ফসল।

বর্তমানে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে সীমিত পরিমাণে এর চাষাবাদ হয়। এটি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা যায়। বিভিন্ন খাদ্যশিল্পে যবের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অথচ উৎপাদিত যব দেশের চাহিদা পূরণ হয় না। এজন্য আমদানি করতে হয়। বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের দেশে বার্লি চাষ বিস্তারের সম্ভাবনা রয়েছে।

সাধারণত চরাঞ্চলে অনুর্বর জমিতে স্বল্প ব্যয়ে যবের চাষ করা হয়। পানি জমে না এমন বেলে দোআশ ও দোআশ মাটি বার্লি চাষের জন্য উপযুক্ত। জমিতে ‘জো’ আসার পর মাটির প্রকার ভেদে ৩-৪ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হয়।

বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে রবি মৌসুমে সেখানে অন্য কোনো ফসল ফলে না। এসব স্থানে যবের আবাদ করা যেতে পারে। কারণ যব যথেষ্ট লবণ সহ্য করতে পারে। আশার কথা, তামাক চাষ বাদ দিয়ে সে জমিতে বার্লির আবাদ বিস্তার করা যেতে পারে।

যব থেকে তৈরি ছাতু খুবই উপাদেয় একটি খাদ্য। যদিও আমাদের দেশে যবের ছাতুর প্রচলন নেই। স্বাদের দিক থেকে যব কিছুটা নোনতা ও উষ্ণ প্রকৃতির। যবে রয়েছে মালটোজ, গ্লুকোজ, স্যাকারিন, লেসিথিন, এল্যানটয়েন, এমাইলেস, ভিটামিন-বি প্রভৃতি।

যবের ছাতু কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি সম্বন্ধীয় সাম্প্রতিক এক আকর্ষণীয় গবেষণায় দেখা গেছে এটা সার্বিকভাবে কোলেস্টেরল কমায় এবং খারাপ কোলেস্টেরলের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। গবেষণায় বলা হয়, বিশেষভাবে উচ্চ কোলেস্টেরল যুক্ত মানুষের উপর এই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ব্রিটেনের স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ আবেরডিনের গবেষণার প্রধান লেখক ফ্র্যাঙ্ক থিস বলেন, “সার্ভিং হিসেবে ৬০ গ্রাম যবের ছাতু খেলে উল্লেখযোগ্যভাবে কোলেস্টেরল কমাতে পারে।”

বিশাল আকারের তথ্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক পর্যালচনায় দেখা গেছে, যবের ছাতু খাবারে তৃপ্তি বাড়ায়, খাদ্যের গুণগতমান রক্ষা করে, শরীর ঠাণ্ডা করে, বল ও পুষ্টি বৃদ্ধি করে, শুক্র বৃদ্ধি করে ও হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করাসহ হৃদপিণ্ড সম্বন্ধীয় এবং সাধারণ বিপাকীয় ব্যবস্থা ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া দেহের ঘাম, শরীরের দাহ (জ্বালা), কফ ও পিত্ত নাশ করে।

যবের ছাতু খেলে রক্তের টক্সিক উপাদান বেরিয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ছোট-বড় নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যায় কমে। বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজের ঘাটতি পূরণ করে।

ক্লান্তি দূর হয়, অ্যানাজি পাওয়া যায়, শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাও বাড়ে যবের খেলে। রক্তচাপ ও কোলেস্টরেল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ার কারণে যবের ছাতুতে উপস্থিত শর্করা খুব ধীরে ধীরে রক্তে মিশে থাকে। ফলে ডায়াবেটিস রোগীরাও যবের ছাতু খেতে পারেন। ডায়বেটিস রোগীদের পক্ষে যবের আটা বেশি উপকারী। যবের আটা খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায় না।

এমনকি প্রোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় আমাদের ত্বক এবং চুলের সৌন্দর্য বাড়াতে সাহায্য করে যবের ছাতু।

প্রতিদিনের নাস্তায় দুধের সঙ্গে যবের ছাতু মিশিয়ে খেলে ক্ষুধা কম লাগার পাশাপাশি পেট ভরা রাখে। তাছাড়া মোটা হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখাতে পারে।

যবের রুটি সহজে হজম হয়, শরীরের বল ও শুক্র বৃদ্ধি করে, কফ নাশ করে, বায়ুওমল বৃদ্ধি করে।

গবেষণায় দেখা গেছে যবের ছাতুর বেটা-গ্লুক্যান আঁশ খাবারে পরিতৃপ্তি থাকতে সাহায্য করে এবং উপকারী ‘গাট’ ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

২৯টি গবেষণা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যবের ছাতু অন্ত্রের কিছু রোগের ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে। যেমন কোষ্ঠকাঠিন্য এবং প্রদাহজনীত পেটের রোগ।

ইউনানী শাস্ত্রে যব ঠাণ্ডা আর রুক্ষ। যব স্বাদহীন, মলবন্ধ কারক, রক্তপিত্ত কমিয়ে দেয়। নাড়ির গতি ধীর করে, তৃঞ্চা শান্ত করে। পিত্তবৃদ্ধি, কাশি, মাথাব্যথা, হার্টের অসুখ, দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, জ্বর রোগে যব ব্যবহার করা হয়। বৈজ্ঞানিক মতে, যব অশক্ত আর অসুস্থ মানুষের আর্দশ পথ্য।

যারা মোটা হয়ে যাচ্ছেন তারা যাদি চাল গমের বদলে যবের আটার রুটি খান মেদবৃদ্ধি কমবে। ওই রুটি খেতে হবে টক দইয়ের সঙ্গে কিংবা মেথির শাক বা নটেশাকের তরকারি দিয়ে। সঙ্গে মুগের ডাল ও খেতে পারেন।

প্লীহা ও পাকস্থলীর কর্মক্ষমতা বাড়াতে এবং অজীর্ণ রোগ দূর করতে যব খুব ভালো কাজ করে যবের ছাতু। গরমের সময় বিভিন্ন প্রকার শারীরিক সমস্যা নিরসনে প্রতিষেধক হিসেবে এটা কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

যবের ছাতু কোলেস্টেরল এবং রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখে।

খাদ্য আঁশ ছাড়াও মলিবডেনাম, ম্যাঙ্গানিজ ও সেলেনিয়ামের খুব ভালো উৎস যব। এটা কপার, ভিটামিন বি১, ক্রোমিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম এবং নাইসনেরও ভালো উৎস। তাছাড়াও এতে প্রচুর লিগন্যান (অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট) থাকে যা ক্যানসার ও হৃৎরোগের ঝুঁকি কমায়। যব ভিজিয়ে রাখার পর অংকুরোদ্গম করে খেলে এ থেকে বেশি পরিমাণ ভিটামিন, খনিজদ্রব্য, প্রোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়।

যবের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে দেশজ চাহিদা পূরণ করে আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান ও সৌদি আরবে যব রফতানি করা যাবে। যব একটি উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে গণ্য। যবের উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/১৮ মে/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

কিডনি রোগ বাড়ছে শিশুদেরও! যেসব লক্ষণ দেখলেই সতর্কতা জরুরি

সস্তার পেয়ারার গুণে বশে থাকে ডায়াবেটিস-উচ্চ রক্তচাপসহ নানা জটিল রোগ

যে পাঁচ সমস্যায় আক্রান্তরা গুড় খাওয়ার আগে একবার ভাবুন, নইলে...

সাজেদুর রহমান শাফায়েতের স্বপ্ন পৃথিবী ঘুরে দেখা

খাওয়ার পরপরই চা পান উপকার না ক্ষতি? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

জ্বরের মধ্যে যে পাঁচ খাবার খেলেই বিপদ! জানুন, সাবধান হোন

গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ডায়াবেটিস রোগীদের! সুস্থ থাকবেন যেভাবে

মুখে দুর্গন্ধের কারণে হা করতেও অস্বস্তি লাগে? সমাধান কী জানুন

লিভার ভালো রাখে লাউ! ওজন এবং উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

কিডনি ভালো রাখে আমের পাতা! উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :