রেখেছি তোমারে মনে

ফারুক আফিনদী
| আপডেট : ১৯ মে ২০২২, ১৭:০৮ | প্রকাশিত : ১৯ মে ২০২২, ১৫:১৩
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর

‘বড়জোড় সাতমাস বাঁচবেন’ তিনি। ‘রায়’ এমনই ছিল। সেই রায়ই কার্যকর হয়ে গেলো। যদিও এখনো সময় আরও বাকি। এবং তার কথার মতোই ‘আকস্মিকভাবেই’ চলে গেলেন তিনি। তিনি একুশের অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।

আর ‘বড়জোড় সাতমাস বাঁচার’ ‘রায়’টি দিয়েছিলেন দুজন ডাক্তার। যখন গাফ্ফার চৌধুরী হাসপাতালে।

২০২১ সালের শেষ দিকে কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়ে চার চারবার হাসপাতালযাপন করেন গাফ্ফার চৌধুরী। বাসায় ফিরে কলম ধরেন বাংলা, বাংলাদেশ ও আসাম্প্রদায়িকতার কলমসৈনিক।

ওই বছরের ২১ নভেম্বর পত্রিকায় (ইত্তেফাক) কলাম লিখে ব্যক্ত করেন চলে যাওয়ারই কথা। স্বদেশের জন্য আকুলতার কথা। প্রণতি জানান দেশেকে। আর্তি জানান, ‘রেখো মা দাসেরে মনে’।

মনে তো রাখেবেই তাঁকে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ। আর এদেশের মানুষ।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ২১ নভেম্বরে কলামটি ছিল তা-ই, ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ শিরোনামে। আমরা আজ এই মহানের সেই কলামের কিছু অংশ পুনঃপাঠ করবো-

শুরুটা যার এমন, যেন মৃত্যু গোপন ডাক পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

গাফ্ফার চৌধুরী শুরু করেন এভাবে-

‘স্বপ্নের সেই আমার স্বদেশ আর দেখব না হয়তো। তাই ১৫ হাজার মাইল দূরে বসে স্বদেশকে প্রণতি জানাই: রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে। ৫০ বছরের বেশি রাজনৈতিক কলাম লিখছি। অনেকের মনে আঘাত দিয়েছি। তাদের কাছেও ক্ষমা চাই।’

আজ পাঁচদিন হয় হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে এসেছি। কিডনির জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পরপর চারবার হাসপাতালে যাওয়ায় সেবার আর ঘরে ফেরার আশা ছিল না। দুই দুই ডাক্তার রায় দিয়েছেন—আমার দুই কিডনিই অচল। বাঁচলে বড়জোর সাত মাস বাঁচতে পারি। যতদিন মারা না যাই আমাকে যেন নার্সিং হোমে রাখা হয়। আমার ছেলেমেয়েরা রাজি হয়নি। তারা আমাকে বাসায় নিয়ে এসেছে। যে কদিন বাঁচব তারা আমাকে বাসায় রাখতে চায়। তাই আছি। যে কদিন আছি বিছানায় শুয়ে কাটাতে হবে। এই যে লিখছি তাও বিছানায় শুয়ে কষ্ট করে লিখছি। স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরে আসা সম্ভব হবে কি না, জানি না।’

ডাক্তাররা যখন আমাকে আকস্মিকভাবে জানালেন, সাত মাসের বেশি বাঁচব না, তখন ভয় পেয়েছিলাম। কিছু বন্ধুবান্ধবকে খবরটা জানিয়েছিলাম। এখন বাসায় ফিরে ভয়মুক্ত হয়েছি। মৃত্যুভয় আর নেই। পৃথিবীর দিকে আবার নতুনভাবে চোখ তুলে তাকিয়েছি। বড় সুন্দর লাগছে পৃথিবী। বড় মায়াময় সৌন্দর্যময় পৃথিবী, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব, ছেলেমেয়ের মুখ আর দেখব না। ঢাকায় পত্রিকায় সাপ্তাহিক কলাম লিখব না—এ কথাটাই মনে দুঃখ দিচ্ছে। তবু পাঠক ভাই ও বোনদের কাছে এখনই বিদায় নিচ্ছি না। দেখি না ডাক্তারের কথা সত্য হয় কি না। নাও তো হতে পারে। নিজে যেচে প্রিয় পাঠকদের কাছে বিদায় চাইব কেন? আমি আকস্মিকভাবে চলে যেতে চাই, সবার মনে একফোঁটা অশ্রুকণা তৈরি করে। তারপর ঐ অশ্রুকণার মতোই সবার মন থেকে হারিয়ে যাব।’

এ লেখার পর সাতমাস যেতে আরও বাকি। মৃত্যু এসেই গেল নিয়ে যেতে তাঁকে।

প্রখ্যাত লেখক, কলামিস্ট, ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ এর রচয়িতা, স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক, বরিশালের জলবেষ্টিত গ্রাম উলানিয়ায় জন্ম (১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪ ) নেওয়া আবদুল গাফফার চৌধুরী ৮৬ বছরে বয়সে আজ বৃহস্পতিবার ভোরে লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

এ জীবন কেবলই জীবন নয়, পূর্ণজীবন, যার গান আমাদের গাইতে হবে শুনতে হবে, যার গান বাংলার মানুষ শুনে যায়, গেয়ে যায় হৃদয় থেকে। তাঁকে প্রণতি জানাই। রেখেছি তারে মনে।

রেখেছি তোমারে মনে।

১৯ মে ২০২২, ইস্কাটন গার্ডেন, ঢাকা।

(ঢাকাটাইমস/১৯মে/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :