শিক্ষার মান উন্নয়নের কিছু কথা

প্রদীপ কুমার বিশ্বাস
| আপডেট : ১৯ মে ২০২২, ১৭:৩০ | প্রকাশিত : ১৯ মে ২০২২, ১৬:৩৬

দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষার সীমান্ত। শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন হঠাৎ করে নিশ্চিত করা যাবে না। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সরকার এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা এখানে প্রধান নিয়ামক শক্তি। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক অগ্রগতি হলেও তা মানসম্মতভাবে হয়নি। এতকাল আমরা শুধু যেকোনোভাবেই শিক্ষার প্রসারে মনোনিবেশ করেছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাত্র ৩ শতাংশ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাকি ৯৭ শতাংশ বেসরকারি। আমরা যেনতেনভাবে সনদ অর্জনের সক্ষমতাকেই শিক্ষা ভেবে নিয়েছি।

শিক্ষা হচ্ছে শিশুর উর্বর মস্তিকে বীজ বপনের মতো। প্রক্রিয়াগতভাবে এখানে যা-ই বপন করবে, তাই ফলবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানসম্মত শিক্ষার ধারণা একটি ব্যাপক বিষয়। শিক্ষা আদান-প্রদান একটি জটিল প্রক্রিয়া, এর সংক্ষিপ্ত কোনো পদ্ধতি নেই। মানসম্মত শিক্ষার ধারণায় শিশুরা সিলেবাস শেষ করল কি না সেটি মুখ্য বিষয় নয়, শিক্ষার্থীরা কী শিখল সেটি গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদন বলেছে, বাংলাদেশে পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের এক-চতুর্থাংশ বাংলা পড়তে পারে এবং এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী গণিতে দক্ষতা অর্জন করছে মাত্র। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শিক্ষার মান নিম্ন। বাংলাদেশে ১১ বছরের শিশু অন্যান্য দেশের তুলনায় লেখাপড়ায় সাড়ে চার বছর পিছিয়ে আছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ছাড়া শিক্ষার গুণ ও মান নিশ্চিত হবে না।

মূলত প্রাথমিক শিক্ষার মান মাধ্যমিক স্তর নিয়ন্ত্রণ করে এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় দুর্বলতা উচ্চশিক্ষায় প্রভাব ফেলে। জিপিএ-৫ পেয়েও অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছে না। শিক্ষার মানের অবস্থা বোঝার জন্য এটিও একটি বড় দৃষ্টান্ত। পরিবারের পরেই শিক্ষার মূল জায়গা শ্রেণিকক্ষ, আর শিক্ষকরা হলেন শ্রেণীকক্ষের প্রাণ। অথচ বেসরকারি শিক্ষকরা প্রচণ্ডভাবে বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট। শ্রেণিকক্ষে ফলপ্রসূ শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকদের সম্মান, মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা দিতেই হয়। শিক্ষানীতি ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে না।

শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের ৯৯ শতাংশ শিশু স্কুলে ভর্তি হয়। অথচ আমরা কোনোমতেই শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করতে পারছি না। আমরা শিক্ষার হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছি, এখন প্রয়োজন গুণগত মানের শিক্ষার প্রতি গভীরভাবে নজর দেয়া। একজন ভালো শিক্ষক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ক্লাস নিলেও তা শিক্ষার্থীর মাঝে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে, আবার সুরম্য অট্টালিকায় বসেও তা সম্ভব হয় না। বিগত বছরগুলোতে দেশে শিক্ষা উপকরণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন যথেষ্ট হয়েছে।

শিক্ষায় অংশগ্রহণ, সর্বজনীনতা, লিঙ্গসমতা বিশ্বনন্দিত হয়েছে- এ কথা ঠিক; আবার নতুন চ্যালেঞ্জও এসেছে শিক্ষার গুণগত মান অর্জনের প্রশ্নে। পাসের হার সব সময় শিক্ষার মানের যথার্থ নির্দেশক হতে পারে না। সংখ্যা নয়, গুণই হবে শিক্ষার সমকালীন মাপকাঠি। গতানুগতিকতার জায়গা নিয়েছে দক্ষতা ও জ্ঞান; অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীকে বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকতে হলে তাকে অর্জন করতে হবে যোগাযোগশৈলী, ইংরেজি-বাংলায় স্বাচ্ছন্দ্য, গণিতে পারদর্শিতা ও তথ্যপ্রযুক্তিতে উৎকর্ষ। শিক্ষার্থী হবে কল্পনাপ্রবণ, সৃজনশীল, বিশ্লেষণাত্মক। তার ভূষণ হবে নীতি, আদর্শ ও দেশপ্রেম।

অপরদিকে শিক্ষকতা পেশায় রাজনৈতিক বিবেচনায়, স্বজনপ্রীতি ও অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই বহু অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এঁদের বাদ দেয়া যাবে না বরং প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তুলতে হবে। অতিসত্বর শহরের ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষার সুযোগের সমতা বিধান করতে হবে। শিক্ষকতায় এসেও পেশাগত বিভিন্ন বৈষম্যের কারণে একাগ্রচিত্তে পেশার প্রতি মনোযোগী হতে পারছেন না। শিক্ষকতা পেশার শুরু থেকে অবসর পর্যন্ত বহুবিধ বৈষম্যে ভুগছেন শিক্ষকরা। বিভিন্ন বৈষম্যের কারণে শিক্ষকদের মাঝে চরম ক্ষোভ আছে। এতেও শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূর করে শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়ন করা সম্ভব।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাঞ্চন নগর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ,

ঝিনাইদহ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :