প্রযুক্তির উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

প্রকাশ | ২০ মে ২০২২, ২১:৪২

ড. যশোদা জীবন দেবনাথ

১৩ বছরে প্রযুক্তি খাতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে বাংলাদেশে। পৃথিবী চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। চাইলেই মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। কি পারিবারিক, কি সামাজিক, অর্থনৈতিক, কিংবা রাষ্ট্র, রাজনীতি, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য- সবকিছুর ভালো-মন্দ খোঁজখবর নেয়া যাচ্ছে। এমনকি পৃথিবীকে জানিয়ে দেওয়া যাচ্ছে নিজের মতামতও।

এসব ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের সুফল পাচ্ছে দেশের প্রতিটি মানুষ। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থানসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে না।

এটা সম্ভব হচ্ছে মূলত সারা দেশে একটি শক্তিশালী আইসিটি অবকাঠামো গড়ে ওঠার কারণে, যা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এটা সম্ভব হয়েছে ইন্টার সেবা মানুষের কাছে সহজলভ্য হওয়ার ফলে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ৭৮ হাজার টাকা। বর্তমানে তা ৩০০ টাকার নিচে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার  সুযোগ্য পুত্র ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কারিগর সজীব ওয়াজেদ জয়ের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তে প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশ এক অনন্য উচ্চতায় উঠতে সক্ষম হয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্ম এখন প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ, খেলাধুলা-সংস্কৃতিতে এগিয়ে, দেশের প্রশ্নে তারা আপসহীন। এই প্রজন্ম জাতির পিতার সুমহান আত্মত্যাগ ও দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস জানে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের কথা জানে, শহীদদের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। প্রযুক্তির ছোয়া আত্মসচেতন এই তারুণ্যের শক্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

শুধু শহরেই নয়, জেলা-উপজেলা সদর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছে দিয়েছে সরকার। বিশেষ করে ‘ইউনিয়ন ইনফরমেশন সেন্টার’ বা ‘ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র’ দেশব্যাপী গ্রামের মানুষকে অভাবিত সেবা দিয়ে চলেছে। গ্রামীণফোনের সেই ‘ফোন লেডি’তথা পল্লিফোনের ধারণা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এ-টু-আই (অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন) এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের (আইসিটি) আওতায় ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার তৈরিসহ তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত নানা প্রকল্প ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। আরও কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। উন্নয়ন অংশীদাররাও এসব প্রকল্পকে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে এবং প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নের পরিমাণ বাড়িয়ে গবেষণা-সহায়তাও দিয়ে চলেছে।

আমাদের দেশে কিছুদিন আগেও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যম উন্মুক্ত ও সাশ্রয়ী ছিল না। প্রযুক্তির বিকাশের কোনো চেষ্টা ছিল না, আত্মপ্রত্যয় প্রকাশের সুযোগ ছিল না। গণমাধ্যমের সংখ্যা, আকার-প্রকার, ধরন সব সীমাবদ্ধ ছিল। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, দক্ষতা অর্জন, এসব কোনো কিছুর সুযোগ ছিল না। কোনো রকমে বেঁচে থাকাই ছিল নাগরিকের সংগ্রাম। এখন আমরা স্বপ্ন দেখি এগিয়ে যাওয়ার, উন্নত বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার।

আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে বুঝতে হবে এসবই কিন্তু এসেছে রাষ্ট্রকে টেকসই উন্নয়ন আর প্রগতির পথে চালানোর মানসিকতা নিয়ে নীতি প্রণয়নের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সর্বোচ্চ মহলে ছিল বলে। এই সর্বোচ্চ মহল আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দেশ তো আমরা দেখেছি দ৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যৈন্ত কীভাবে চলেছে। কী পেয়েছি, কী হয়েছে দেখেছি। হতাশা আর কোনো রকমে বেঁচে থাকার আকুতি দেখেছি, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারিনি। স্বপ্ন দেখা শুরু হয় কখন? যখন শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এলো। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে লাগল দেশ। খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো জনগণের।

তারপর আবার পিছলে পড়লাম সোজা সাত বছর। ২০০১ থেকে ২০০৮। এই পিছলে পড়লে কী হয় তার প্রত্যক্ষদর্শী বর্তমান তরুণরা। তারাই বড় ভুক্তভোগী। তাই তরুণদের উদ্দেশে বলব, মানসিকতার উন্নয়নের ওপরে জোর দিতে হবে আমাদের। আবার যেন কেউ ছিনিমিনি না খেলে আমাদের নিয়ে, সেদিকে সজাগ থাকতে হবে সব সময়। সামনে যে আমাদের সংগ্রাম। নিজেকে গড়ার, নাগরিক হিসেবে নিজের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার, নিজেকে দক্ষ করার এবং এর মাধ্যমে সমাজ ও দেশকে আগামী দশকের মধ্যেই উন্নত করার সংগ্রাম।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম করার সৌভাগ্য আমাদের এই প্রজন্মের হয়নি, কিন্তু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী আমাদের এই প্রজন্ম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই ভয়াবহতা, বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পরে পিছিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা, অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা থেকে অনেকাংশেই ৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম দেখেননি।

তার পরবর্তী প্রজন্ম আরও কম দেখেছে এবং সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া প্রজন্ম আরও কম দেখেছে কঠিন সময়কে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশার মানদণ্ডটিও অনেক উচ্চে। প্রত্যাশা আরও বেড়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সম্ভাবনা দেখে। আমাদের এই প্রজন্মের অনেকেই খাদ্যের অভাব দেখেনি। দাম হয়তো বাড়তে-কমতে আমরা দেখছি, কিন্তু রকমারি পণ্যের সমাহারে ভরা দোকান দেখছি। যেটি আগে ভাবাও যেত না।

সব মিলিয়ে আমার মনে হয়, আমাদের এই প্রজন্মের সোল সার্চিং অর্থাৎ আত্ম-উপলব্ধির সময় এসেছে। কোথায় ছিলাম, কোথায় এসেছি, আর কোথায় যেতে চাই? প্রত্যাশা পূরণের জন্য প্রস্তুতির জায়গায় এখন আমাদের হাত দিতে হবে জোরেশোরে।

সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে ঝালিয়ে নিতে হবে। আমাদের অনেকেই রাষ্ট্র, সরকার, আর রাজনীতির মধ্যকার পার্থক্য অনেক সময় ভুলে গেছি। সুশাসন আর নাগরিক সেবা নিতে এখন সহজ প্রক্রিয়া এসেছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই কারও কারও কারণে যেখানে দীর্ঘসূত্রতা আসে, স্থবিরতা আসে, দুর্নীতির মুখে পড়ি, জবাবদিহির জায়গায় নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের অধিকার চর্চা করছি না। পাশাপাশি সরকারের বাইরে বেসরকারি খাতকে আমরা এগিয়ে যেতে দেখছি। সমৃদ্ধির ছোঁয়া দেখেই ক্ষান্ত হচ্ছি, কিন্তু এই সুবিশাল খাতের জবাবদিহি, তাদের দায়িত্ববোধ, আইনের প্রতি আস্থা-শ্রদ্ধা এবং মান্য করার বিষয়টি আমাদের এই প্রজন্মকেই সামনে আনতে হবে।

এই প্রজন্মকে শেখ হাসিনার সরকার একটি সম্পদ দিয়েছে, সেটি হলো তথ্যপ্রযুক্তি। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে যেমনি দক্ষ হওয়া যায়, শিক্ষা নেওয়া যায়, তেমনি সচ্ছতাও নিশ্চিত করা যায়। নাগরিক অধিকার পাওয়ার জায়গায় নিজের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যায়। আমাদের এই প্রজন্মের বোঝা দরকার, আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ। আমাদের এই দেশ এখনো অনেক এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ট ক্রাইসিস তথা অস্তিত্বজনিত ঝুঁকি আর সংকটের মধ্যে বর্ধনশীল অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এই যাত্রায় শক্ত করে হাল ধরার মানসিকতা আমাদের থাকতে হবে।

সংগ্রামটি এখন ভিন্ন। সবচেয়ে ঝুঁকিরও। ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং সম্পদের অসাম্য। এগুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমলে নিতেই হবে। এগুলো প্রতিহত করতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর সংগ্রামের জন্য এই প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে, প্রস্তুত হতে হবে।

মানবিকতা, ন্যায়বিচার, ন্যায়পরায়ণতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সহনশীলতা, জ্ঞানচর্চা, দক্ষতা অর্জন- এগুলো আমাদের আগামী দিনের সংগ্রামের পাথেয় হিসেবে এই প্রজন্মকে সঙ্গে নিতে হবে। শুধুই নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতি, রাজনৈতিক দলের পরিবর্তনে সরকারের পরিবর্তন- এসব প্রত্যাশায় সীমাবদ্ধ থাকলে আগামী দিনের যাত্রা হোঁচট খাবে।

লেখক: সদস্য, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপকমিটি, আওয়ামী লীগ।