চার বছর ধরে ডিভিডেন্ড দেয় না ডেল্টা লাইফ, কিন্তু কেন?
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড দীর্ঘ চার বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের কোনো ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে থাকা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, ভ্যাট ফাঁকি দেওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে।
এসব অভিযোগের মূলে রয়েছেন মনজুরুর রহমান, যিনি ২০১২ থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত ডেল্টা লাইফের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। অভিযোগ আছে, কোম্পানিতে পরিবারতন্ত্র কায়েম করে তিনি ২৫ লাখ গ্রাহকের আমানত লোপাট করেছেন।
প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি থেকে ১ হাজার ১৪১ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য-প্রমাণও পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় মনজুরুর তার চার সন্তানকেই কৌশলে বানিয়েছেন পরিচালক। এর মধ্যে ২০১৭ সালে মেয়ে আদিবা রহমানকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার চেয়ারে বসিয়েছেন।
দুদকের নথিপত্র বলছে, পরিবারতন্ত্র কায়েমের পরই শুরু হয় অনিয়ম-দুর্নীতি। একপর্যায়ে নানা অভিযোগের মাথায় মনজুরুর রহমান এবং তার সন্তানদের পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ—আইডিআরএ।
এর মধ্যে কোম্পানিটি গত চার বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের কোনো প্রকার লভ্যাংশ দিচ্ছে না। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ এই চার বছর কোনো বিনিয়োগকারীকে লভ্যাংশ দেয়নি তারা।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স বছরের পর বছর তাদের ডিভিডেন্ড না দিয়ে ঠকাচ্ছে। যেখানে এক বছর ডিভিডেন্ড না দিলেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত যেকোনো কোম্পানি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে চলে যাওয়ার কথা সেখানে ডেল্টা লাইফ চার বছর ধরে ডিভিডেন্ড না দিয়েও কীভাবে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করে সেই প্রশ্নও বিনিয়োগকারীদের।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশেন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ নিয়ম অনুযায়ী কোনো কোম্পানি যদি এক বছরের বেশি বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড না দেয় তাহলে সেটি জেড ক্যাটাগরিতে চলে যাবে। তবে করোনা মহামারির কারণে যদি কোনো কোম্পানি দুই বছর ডিভিডেন্ড না দেয় তাহলে তার ক্যাটাগরি পরিবর্তন হবে না। তবে তিন বছরের মাথায়ও যদি সেই কোম্পানি ডিভিডেন্ড দিতে না পারে তাহলে সে কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে ফেলে দেবে।’
‘জেড ক্যাটগরিতে থাকলে সেই কোম্পানি বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। তারা কোনো অ্যাডভান্টেজ পায় না। অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে কমপ্লায়েন্স ইস্যুগুলো আরেও অনেক কঠিন থাকে। তারপর সে কোম্পানি রাইট ইস্যু করতে পারে না, বোনাস ইস্যু করতে পারে না। তাই সব কোম্পানিই চেষ্টা করে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিতে। অন্যথায় সে কোম্পানি জেড ক্যাটাগরিতে চলে যায়’—ঢাবির এই শিক্ষক।
এদিকে এক বছরের বেশি সময় লভ্যাংশ না দিয়েও কীভাবে ডেল্টা লাইফ এ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. শফিকুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী কোনো কোম্পানি যদি এক বছর ডিভিডেন্ড না দেয় তাহলে সেই কোম্পানি জেড ক্যাটাগরিতে চলে যায়। তবে ডেল্টা লাইফের হিসাবটা ভিন্ন। এই কোম্পানির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলছে। আর কোনো কোম্পানি যদি মামলার মধ্যে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তাই তাদের ক্যাটাগরিও পরিবর্তন হয়নি। মামলা মোকদ্দমা শেষ হলে তারপর নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আর ডিভিডেন্ড না দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু কোম্পানিটি নানা অভিযোগে জর্জরিত তাই মনে হয় তারা শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দিতে অনিচ্ছুক। এছাড়া আর কোনো কারণ দেখছি না।’
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকাটাইমসকে এ বিষয়ে বলেন, ’কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো কোম্পানিকে ডিভিডেন্ড দিতে বাধ্য করা যায় না। কোনো কোম্পানি ডিভিডেন্ড না দিলে তাদের ইনসেন্টিভ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। অন্যান্য ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে ডিভিডেন্ড দিতে উৎসাহিত করা যায়।’
চার বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের কেন ডিভিডেন্ড দেওয়া হচ্ছে না জানতে ডেল্টা লাইফের কোম্পানি সচিব উত্তম কুমার সাধুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে গত এক মাসে ডেল্টা লাইফের শেয়ারদর পতনের দিকে রয়েছে। এপ্রিলে কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ১৪৩ দশমিক ৭ টাকা। যা এক মাসে ৩১ দশমিক ২ টাকা কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১১২ দশমিক ৫ টাকায়।
উল্লেখ্য, কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০১৮ সালে বিনিয়োগকারীদের ২৬ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। এর আগের বছর ২৫ শতাংশ নগদ, ২০১৬ সালে ২০ শতাংশ নগদ ও ২০১৫ সালে ১৮ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। সেই চার বছর আগে দেওয়া লভ্যাংশের পর আর লভ্যাংশ দেওয়ার নামগন্ধ নেই। এরপর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আর কোনো এজিএম হয়নি তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেল্টা লাইফের এক বিনিয়োগকারী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে আমি শেষ হয়ে গেছি। ২১৭ টাকা করে ১ হাজার ৫০০ শেয়ার কিনেছিলাম। এর মধ্যে চার বছর ধরে কোনো ডিভিডেন্ড দেয় না। শেয়ার দাম একবার বাড়ে একবার কমে। এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে আমার মতো বহু বিনিয়োগকারী আজ রাস্তায় বসেছি।’
প্রসঙ্গত, একের পর এক অনিয়মের মধ্যে থাকা এই কোম্পানি থেকে প্রকাশ করা হয়নি কোনো আর্থিক বিবরণী। রাজস্ব বোর্ডকে ফাঁকি দিয়েছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। কোম্পানিটির সর্বসাকল্যে অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ১১ কোটি ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার ২৬২ টাকা ও সুদ বাবদ ১৩ কোটি ৫৮ লাখ ১০ হাজার ৭৯৯ টাকাসহ সর্বমোট ২৫ কোটি ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ৬১ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির ১০টি অনিয়মকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছিলো। এছাড়া এসব অনিয়ম ও ব্যর্থতার কারণে প্রতিষ্ঠানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমানের পুনঃনিয়োগের আবেদন বাতিল করেছিল বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা—আইডিআরএ।
ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স গত বছরের ৯ ডিসেম্বর কোম্পানির প্রায় ২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করেছিলো মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা)। ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলা করা হয়েছে বলে জানান ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান।
সেসময় ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক বলেছিলেন, ডেল্টা লাইফের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় ভ্যাট গোয়েন্দা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত করে। তাদের থেকে তথ্য-উপাত্তের আড়াআড়ি যাচাই করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।
তদন্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির সর্বমোট অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ১১ কোটি ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার ২৬২ টাকা এবং সুদ বাবদ ১৩ কোটি ৫৮ লাখ ১০ হাজার ৭৯৯ টাকাসহ সর্বমোট ২৫ কোটি ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ৬১ টাকা রাজস্ব পরিহারের তথ্য উদঘাটিত হয়।
(ঢাকাটাইমস/২১মে/বিএস/ডিএম)