পোস্টারে ঢাকা রাজধানীর দেয়াল, সৌন্দর্য রক্ষার আইনটির প্রয়োগ নেই কেন?

প্রকাশ | ২২ মে ২০২২, ১০:০১ | আপডেট: ২২ মে ২০২২, ১৪:০৯

পুলক রাজ, ঢাকাটাইমস

বাড়ির মালিক ছয়মাস পর পর দেয়ালে রং লাগায় আর মানুষ সেই দেয়াল পোস্টার দিয়ে ভরিয়ে দেয়। আর আমি গালি শুনি মালিকের। প্রতিদিন বারণ করা সত্ত্বেও দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে যায় দেয়ালদস্যুরা।
ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন মগবাজারের একটি বাসার দারোয়ান মনছুর মিয়া।

এই দারোয়ান বলেন, যারা পোস্টার লাগিয়ে চলে যাচ্ছে তাদেরতো কোনো লোকসান হচ্ছে না। লোকসান হচ্ছে বাড়ির মালিকের। মালিক দেয়াল সুন্দর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে রং লাগিয়ে টাকা খরচ করছেন। আবার সেই দেয়াল পোস্টার লাগানো হচ্ছে।’ 

সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, মগবাজার, রামপুরা, কাকরাইল, সেগুনবাগিচা, ফার্মগেট, বনানী, নিউমার্কেট, মতিঝিল, গাবতলী, শ্যামলী, মিরপুর, সায়েদাবাদ, মহাখালীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, সিনেমা হলের সামনে এবং মানুষের বাসা-বাড়ির দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে তান্ত্রিক কবিরাজদের লিফলেট-পোস্টারসহ সিনেমার অশ্লীল পোস্টারও লাগানো হয়েছে।

দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ প্রণয়নের ১০ বছর পরও তা প্রয়োগ হচ্ছে না। 

আলী নূর নামে ঢাকার একজন ব্যাচেলর বাসিন্দা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পোস্টারে ছয়লাব, দেয়ালদস্যুদের কবলে ঢাকা। অনুমতি ছাড়া দেয়ালে যেকোনো ধরনের পোস্টার  লাগানো অপরাধ বলে মনে করি আমি। রাজধানী জুড়ে প্রতিনিয়ত যেকোনো সংগঠনের নির্বাচন, সম্মেলন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পোস্টার সাঁটাতে দেখা যায়। একটার ওপর আরেকটা পোস্টার লাগিয়ে চলে যায়। দেয়ালের একজন মালিক যে আছে তাদের কোনো বোধ থাকে না। আমাদের দেশেই বিশৃঙ্খলভাবে প্রচার প্রচারণার জন্য ছবি বা লেখা দিয়ে যত্রতত্র পোস্টার লাগানো হয়।’

সাংস্কৃতিক কর্মী দোলন হোসেন নামে একজন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সঙ্গে একজন নারীকে নিয়ে সিনেমা হলের সামনে দিয়ে গেলে লজ্জা লাগে। এত অশ্লীল ছবির পোস্টার লাগিয়েছে দেয়ালে দেয়ালে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের জন্য এসব পোস্টার খুব ক্ষতিকারক। কারণ এসব পোস্টার দেখার পর উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মন-মানসিকতা অন্য দিকে মোড় নেয়।’

বাপ্পি তালুকদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সিনেমার প্রচারের জন্য অশ্লীল ছবি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে পোস্টার। এবং নিয়মিত এই অশ্লীল ছবির পোস্টার রাজধানীর স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন দেয়ালে লাগানো হয়েছে। এ ধরনের পোস্টার ভদ্র সমাজের মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু এমনভাবে পোস্টার লাগানো হয় চোখে পড়ার মতোই। আমি মনে করি এসব পোস্টারে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের চরমভাবে প্রভাবিত করে।’

পথচারী সাদ্দাম হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘তান্ত্রিক কবিরাজদের পোস্টার দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে হিজিবিজি করে সৌন্দর্য নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর প্রায় বাড়িরই দেয়াল ভরে গেছে এসব পোস্টারে। এমন অবস্থা হয়েছে, একেক গলি একেকজনের দখলে থাকে। গাছ, কবুতর, সাপ,কঙ্কালসহ নানা রকম বিভিন্ন কালারের ছবি দিয়ে পোস্টার লাগানো হয়েছে মানুষের বাসা-বাড়ির দেয়ালে।’

জুয়েল আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ কোনো কিছুরই নিয়ম এত সহজে মানতে চায় না। উন্নত দেশগুলোতে পোস্টার লাগাতে হলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে পোস্টার লাগানোর জন্য সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি নিয়ে অর্থের বিনিময়ে পোস্টার লাগিয়ে প্রচার করতে পারে। তবে নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পোস্টার সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা উল্টো, যে যার মতো দেয়াল খালি থাকুক আর ভরা থাকুক যত্রতত্র পোস্টার দিয়ে ভরিয়ে দেয়।’

আইন ভঙ্গে যে শাস্তি

‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ)আইন-২০১২’র ৪ ধারায় বলা হয়েছে, এই আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা স্থান নির্ধারণ করিয়া দিতে পারিবে এবং উক্তরূপে নির্ধারিত স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে। তবে শর্ত থাকে যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে উল্লেখিত নির্ধারিত স্থান ব্যতিত অন্য কোন স্থানে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে।’

আইনের ‘৩’ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধারা ৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ব্যতিত অন্য কোনো স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে না।

আইনের ‘৬’ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ১৫ (পনের) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াল লিখন বা পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।

৩ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো সুবিধাভোগীর অনুকূলে ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে অন্যূন ১০ (দশ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ৩০ (ত্রিশ) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত সুবিধাভোগীকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াল লিখন বা পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এসব পোস্টার রাতে কিংবা গোপনে লাগায় বলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। দক্ষিণ সিটির সব ওয়ার্ডের জন্য ২ জন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। তারা নিয়মিত দক্ষিণ সিটির এলাকার অবৈধ পোস্টার, বিলবোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেই সমস্যা যত দ্রুত সম্ভব নির্মূল করতে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রাজধানী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পোস্টার, ব্যানারের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর অবস্থান রয়েছে। অবৈধ পোস্টারিংয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ওয়ার্ডে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি এবং আমাদের প্রচার প্রচারণাও অব্যর্থ রয়েছে।’

(ঢাকাটাইমস/২০মে/পিআর/এফএ)