সরকারি কর্মকর্তাদের নম্বর ক্লোনিং, কেন থামানো যাচ্ছে না অপরাধীদের?

প্রকাশ | ২৩ মে ২০২২, ০৮:৫৪ | আপডেট: ২৩ মে ২০২২, ০৮:৫৮

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস

মোবাইল নম্বর ক্লোনিং করে টাকা চাওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। বিশেষ করে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মোবাইল নম্বর ক্লোনিং করার খবর প্রায় শোনা যায়। পুলিশের ভাষ্য, প্রতারকদের ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। আর বিটিআরসি বলছে, কারও নম্বর যেন ক্লোন করা না যায় সে বিষয়ে তারা কাজ করছে।

সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি ফোন নম্বর ক্লোনিং করার বিষয়ে মূলত কাজ করে থাকে সাইবার ইউনিটগুলো। তাদের কাছে কতগুলো ফোন নম্বর ক্লোনিং করা হয়েছে এর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এসব দেখার জন্য আলাদা ডেস্ক রয়েছে।

এ ব্যাপারে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে মোবাইল নম্বর ক্লোনিংয়ের অভিযোগ আমরা পেয়ে থাকি। এসব নিয়ে কাজও করা হচ্ছে। আর সরকারি কর্মকর্তাদের নম্বর ক্লোনিংয়ের বিষয়ে কাজ করার জন্য আলাদা একটি ডেক্স রয়েছে।

সম্প্রতি নোয়াখালী জেলা প্রশাসক (ডিসি) দেওয়ান মাহবুবুর রহমানের ব্যবহৃত সরকারি মুঠোফোন নম্বর ক্লোন করে বিভিন্নজনকে কল করে টাকা দাবি করে একটি চক্র। ওইদিন দুপুর ১২টার পর থেকে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের কল করে লাখ টাকা দাবি করা হয়।

পরে এ বিষয়ে বেলা ২টার দিকে জেলা প্রশাসকের ফেসবুক পেজে একটি সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ডিসির নম্বর ক্লোন করে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, চৌমুহনী ও সেনবাগ পৌরসভার মেয়রকে কল করেন। পরে টিআর, কাবিখা প্রকল্প দেওয়ার কথা বলে জরুরি ভিত্তিতে এক লাখ টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠাতে বলেন।

জেলা প্রশাসনের ওই সূত্রটি জানায়, জেলা প্রশাসকের নম্বর দেখে অনেকেই তা বিশ্বাস করেন। এর মধ্যে চৌমুহনী পৌরসভার মেয়র খালেদ সাইফুল্লাহ এক লাখ টাকা জোগাড়ও করেন। পরে কৌতূহলবশত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ফোন দিয়ে জানতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছিলেন। পরে তিনি টাকা পাঠানো থেকে বিরত থাকেন।

ব্যবহৃত সরকারি মুঠোফোন নম্বর ক্লোনের বিষয়ে জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার মোবাইল নম্বর ক্লোনিং করা হয়েছিল। তবে কোনো ধরনের প্রতারণা করার সুযোগ পায়নি। অনেকে সতর্ক হয়ে আমাকে ফোন করেছিল। পরে আমি তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম।

এ ঘটনায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক। কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটার ফলোআপ নিতে হবে। তবে শুনেছি ওই প্রতারক চক্রকে এরই মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে।’

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক (ডিসি) জহুরুল ইসলামের সরকারি মোবাইল নম্বরটিও ক্লোন করেছিল একটি প্রতারক চক্র। এক সাবেক চেয়ারম্যানের কাছে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা দাবি করা হয়। পরে এক প্রতারক মোবাইল ক্লোনিংয়ের  বিষয়টি নিজেই জানিয়ে ফোন করে ডিসিকে।

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, ওইদিন সন্ধ্যায় ডিসি অফিসে কাজ করছিলেন। হঠাৎ তার সরকারি মোবাইল নম্বরে একটি ফোন আসে। নম্বরটি দেখে পাশে থাকা একজন কর্মকর্তাকে ফোনটি ধরতে দিলে ওই প্রতারক নিজেই জানান ‘আপনার মোবাইল নম্বরটি ক্লোন করা হলো।’

কি কারণে কেন ক্লোন করা হয়েছে এবং ক্লোন করা নম্বরটি কার জানতে চাইলে ‘পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের নম্বর’ বলে জানায় ওই প্রতারক। এরপর ফোনটি কেটে দিলে সাইবার টিমকে ডিসির নম্বর ক্লোনের বিষয়টি অবহিত করে অভিযোগ করা হয়।

এ ব্যাপারে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এ ঘটনায় পঞ্চগড় সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল। তবে ওই ঘটনার কোনো ফলোআপ তথ্য জানা নেই।’

জেলা প্রশাসকের নম্বর ক্লোনিংয়ের ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো জানতে চাইলে পঞ্চগড় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল লতিফ মিয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘না, এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করা যায়নি।’
চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবদুল জলিলের দাপ্তরিক মোবাইল নম্বর ক্লোন করে দুর্গাপুর, পবা ও বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) কাছে টাকা চায় একটি প্রতারক চক্র। তবে কন্ঠস্বর চিনতে পারায় প্রতারকরা তেমন সুবিধা করতে পারেনি।

বাঘার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পাপিয়া সুলতানা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাকে ফোন করে একটা মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়। বলা হয়, এটা ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার নম্বর। এই নম্বরে যেন যোগাযোগ করি। কিন্তু কণ্ঠস্বর এবং কথা শুনেই আমি ডিসি স্যারের নম্বর ক্লোন করার বিষয়টি বুঝতে পারি। এই ঘটনা জানাজানির পর ডিসি স্যার সবাইকে সতর্ক হতে বলেন। ফলে আর কেউই প্রতারকদের খপ্পরে পড়েননি।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তখন ঘটনাটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়েছিল। তবে পরে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না আমার জানা নেই।’

এ ব্যাপারে রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এটা অনেকদিন আগের কথা, আমার মনে নেই।’

মোবাইল নম্বর ক্লোনিংয়ের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা ভুক্তভোগীদের সব সময়ে সচেতন করে থাকি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসির তথ্য মতে, কিছু হ্যাকার অ্যাপসের মাধ্যমে সিম ক্লোনিংয়ের কাজে জড়িত। তারা যাতে এই ধরনের কাজ না করতে পারে সেজন্য বিটিআরসি প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড অপারেশন্স বিভাগের  পরিচালক মো. গোলাম রাজ্জাক।

ঢাকাটাইমসকে গোলাম রাজ্জাক বলেন, ‘এভাবে আর কারো মোবাইল নম্বর যাতে ক্লোনিং করতে না পারে সেজন্য আমরা কাজ করছি। একবারে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও প্রতারকরা যেন বেপরোয়াভাবে মোবাইল নম্বর ক্লোনিং করতে না পারে সেই বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।’

(ঢাকাটাইমস/২৩মে/ডিএম)