গাজীপুরের বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর

পদে ফিরব কি না আল্লাহ জানে, আর নেত্রী জানেন

প্রকাশ | ২৪ মে ২০২২, ০৭:৪৬ | আপডেট: ২৪ মে ২০২২, ০৯:১৯

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে দলীয় ও মেয়র পদ হারিয়ে অনেকটাই যেন কর্মহীন হয়ে পড়েন একসময়ের আলোচিত জনপ্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম। গুটিয়ে রেখেছেন রাজনৈতিক সব তৎপরতা থেকে। প্রায় একাকিত্বে সময় কাঁটছে তার। 

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের (গাসিক) বহিষ্কৃত এই মেয়র নিজ দায়িত্ব (দলীয় ও মেয়র পদ) ফিরে পাবেন কি না এ নিয়েও যেন কিছুটা নিস্পৃহ। চেয়ে আছেন সৃষ্টিকর্তা ও দলীয় সভানেত্রীর দিকে। 

ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে কথা প্রসঙ্গে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘পদে ফিরব কি না আল্লাহ জানে, আর নেত্রী জানেন।’

একসময় শত শত নেতাকর্মী আর বিভিন্ন পেশার মানুষের আনাগোনায় সরগরম থাকত মেয়র জাহাঙ্গীরের বাড়ি, রাজনৈতিক অফিস আর মেয়র কার্যালয় (নগর ভবন)। রাজনৈতিক আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুই চলত সেখানে। তাদের সঙ্গে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত জাহাঙ্গীরের। তখন সময় হয়ে উঠত না পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাঁটানোর। 

কে কার আগে মেয়রের সঙ্গে দেখা করবেন, তা নিয়ে একরকম নীরব-সরব প্রতিযোগিতাই দেখা যেত। কিন্তু সেসব দৃশ্য এখন আর নেই। একদম নিরিবিলি তার বাসাটি। শহরের হারিকেন মোড়ের বিশাল বাড়িতে এখন আর নেতাকর্মীদের ভিড় নেই। প্রয়োজন ছাড়া জাহাঙ্গীর আলমও বাইরে কম বের হন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটে বেশির ভাগ সময়।

নেতাকর্মীরা দেখা করতে আসেন না? জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আসে। সবাই যোগাযোগ রাখে, ফোনে। আমার রাজনৈতিক অফিস থেকে বেডরুম পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল।’

বলার অপেক্ষা রাখে না, গাজীপুরে জাহাঙ্গীরের জনপ্রিয়তার কমতি ছিল না। ২০১৩ সালে এই সিটির নির্বাচনে মেয়র পদে দলের মনোনয়ন না পাওয়ার পরও যেমন দেখা গেছে তার জনপ্রিয়তা, তেমনি ২০১৮ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়ে প্রমাণ করেছেন। তার যে ইতিবাচক দিকটি সবচেয়ে বেশি প্রচার পেয়েছে, তা হলো, অকাতরে সাহায্য-সহযোগিতা। 

পদ হারানোর পর মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তা তদন্তে গঠিত হয়েছে কমিটি। তারা কি কিছু পেয়েছে? জাহাঙ্গীর বলেন, ‘তদন্ত কমিটি কিছু পাবে না, এটা আমি জানি। হয়তো কোনো কারণে আমাকে আটকাবে…।’

তবে তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, তিনি মানুষের জন্য কাজ করেছেন এবং এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। কাজেই ভাগ্যের কাছে ছেড়ে দিয়ে রেখেছেন সব।

বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর বলেন, ‘তদন্ত কমিটি আমার কী করবে! আমি তো সিটি করপোরেশনের কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে দিইনি। সেন্ট্রাল গভরমেন্ট আর সিটি করপোরেশন কাউন্সিল হাউজে যেটা সিদ্ধান্ত হয়, সেই অনুযায়ী কাজ হয়। আমার ভোটাররা আছেন, দেশের মানুষ আছেন, তারা দেখেছেন আমি তাদের জন্য কী করেছি। এখন আমার ভাগ্যে যা হয়, তাই মেনে নিব।’

গত এপ্রিলে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। সেখান থেকে সৌদি আরব গিয়ে ওমরাহ পালন করেন। এরপর ৯ মে দেশে ফেরেন তিনি।

ছাত্ররাজনীতি দিয়ে জাহাঙ্গীর আলমের রাজনীতিতে আসা। এরপর জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নির্বাচিত হন গাজীপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। ২০১৮ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে গাজীপুর সিটির মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।

যেভাবে ফেঁসে যান জাহাঙ্গীর

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ওই অডিওতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্যের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

এ ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা মেয়র জাহাঙ্গীরকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান। 
বসে থাকেননি জাহাঙ্গীরের অনুসারী নেতাকর্মী ও সমর্থকরাও। ফলে গাজীপুরের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মেয়র-সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের কয়েক দফা সংঘর্ষও ঘটে। 

গত বছরের ৩ অক্টোবর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। ১৮ অক্টোবরের মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হয়। তিনি জবাবও দেন। ভাইরাল হওয়া অডিওটি ‘সুপার এডিট’ করা বলে বারবার দাবি করেন জাহাঙ্গীর।

এদিকে ওই অডিওর জের ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের সম্পর্ক কার্যত ছিন্ন হয়ে যায়। গাজীপুরে সরকারি নানা কার্যক্রমে জাহাঙ্গীরকে প্রকারান্তরে এড়িয়ে চলার ঘটনাও ঘটতে থাকে। তার উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে অনড় থাকেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। 

এরপরই জোরালো হয় মেয়র পদ থেকে জাহাঙ্গীরের অপসারণের গুঞ্জন। জাহাঙ্গীরও বুঝে যান তার আর থাকা হচ্ছে না মেয়র পদে। সে আশঙ্কার কথা তিনি বলেছেনও গণমাধ্যমকে। এমনকি একটা সময় তাকে গ্রেপ্তারের আতঙ্কও পেয়ে বসেছিল।  

২৫ নভেম্বর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ থেকে জাহাঙ্গীরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর তার অনিয়ম ও দুর্নীতির খোঁজে কাজ শুরু করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। এখনো তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যায়নি।

(ঢাকাটাইমস/২৪মে/এসএস/মোআ)