বয়স হলে প্রোস্টেট ক্যানসার কেন হয়? যেসব নিয়ম মানবেন

প্রকাশ | ২৪ মে ২০২২, ০৯:২২ | আপডেট: ২৪ মে ২০২২, ১০:৫২

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা অসুখ বাসা বাঁধতে পারে আমাদের শরীরে। আবার বয়স বাড়লে কমতে থাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। পুরুষদের শরীরে দানা বাঁধে এমন একটি সবচেয়ে সাধারণ ক্যানস্যার হল প্রোস্টেট ক্যানস্যার।

৫০ বছরের উর্ধ্ব প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি পুরুষের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানস্যারের প্রকোপ দেখা যায়। প্রাথমিক পর্যায় এই ক্যানসারের কোনও লক্ষণ ধরা পড়ে না। শরীরের অন্য অংশে ছড়ানোর পর এর লক্ষণ প্রকাশ্যে আসে। এ কারণে কিছু নির্দিষ্ট সমস্যার প্রতি পুরুষদের সজাগ দৃষ্টি দিতে বলেন চিকিৎসকরা। তবে অন্য আর সব ক্যানসারের তুলনায় প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসায় সফলতার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়।

প্রোস্টেট ক্যানসার মূত্রাশয়ের নীচের অংশ এবং মলদ্বারের সামনের অংশটিকে বোঝায় এবং এই অঞ্চলটি ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রোস্টেট ক্যানসার প্রোস্টেট গ্রন্থিকে প্রভাবিত করে - এমন একটি কাঠামো যা শুক্রাণুর সাথে মিশে শুক্রাণু মিশ্রিত করে এমন তরল তৈরির জন্য দায়ী। ক্যানসারটি পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ, তবে এটির প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে চিকিত্সা করা সম্ভব। নিয়মিত পরীক্ষা, বিশেষত ৫০ বছরের বেশি বয়সী আপনার জন্য, ক্যানসার ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই পর্যাপ্ত পর্যায়ে এই ধরনের ক্যানসার সনাক্ত করতে সক্ষম হওয়া জরুরী।

প্রোস্টেট পুরুষ মানুষের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা বীর্য উৎপন্ন করে থাকে। এছাড়াও প্রোস্টেট গ্রন্থি যৌন হরমোন উৎপাদনে সহায়তা করে থাকে যা একজন পুরুষের স্বাভাবিক যৌন জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রস্টেট গ্রন্থির অবস্থান তলপেটে মূত্রথলির ঠিক নিচে (মূত্রথলীর গলায়) যা মূত্রনালীকে ঘিরে থাকে। আর তাই প্রোস্টেট ক্যানসার অনেক সময়ই মূত্রথলির ক্যানসার হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকে যদিও মূত্রথলী এবং প্রোস্টেট শরীরের দুটি ভিন্ন অংশ।

ক্যানসার হলো মূলত অস্বাভাবিকভাবে কোষ কলার বৃদ্ধি পাওয়া যার প্রভাব একসময় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রোস্টেট ক্যানসার বলতে প্রোস্টেট গ্রন্থির অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। তবে প্রস্টেট গ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দুই রকমের হতে পারে। যেমন:

ক্ষতিকারক নয় এমন বেড়ে যাওয়া যাকে মেডিকেলের ভাষায় বেনিজাইন বলা হয়। এই ধরনের প্রোস্টেট বৃদ্ধিকে বেনিজাইন প্রোস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া বলা হয়ে থাকে যা মূলত ক্যানসার নয়।

ক্ষতিকারক বৃদ্ধি যাকে মেডিকেলের ভাষায় মেলিগন্যান্ট গ্রোথ বলা হয় যা একসময়ে রক্ত ও লসিকা তন্ত্রের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এমনকি তা একসময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা প্রস্টেট ক্যানসারের সুস্পষ্ট কারণ জানতে সক্ষম হন নি। তবে কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যা রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত। যেমন:

পুরুষের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশেষত ৫০ বছরের পর থেকে প্রোস্টেট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। সাধারণত ৪৫ বছরের কম বয়সী পুরুষের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় না তবে ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যেতে পারে।

কালো বর্ণের মানুষদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি সম্ভাবনা রয়েছে।

কারো বংশে অথবা নিকটাত্মীয়দের মধ্যে প্রোস্টেট ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে তাদের ক্ষেত্রে অধিক সম্ভাবনা রয়েছে।

যাদের যৌন রোগ রয়েছে যেমন সিফিলিস, গনোরিয়া ইত্যাদি।

যে সব পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি হিসেবে শল্যচিকিৎসা গ্রহণ করেন তাদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে।

অতিরিক্ত পরিমাণে লাল মাংস, চর্বি জাতীয় খাবার, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত ওজন, ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস ইত্যাদি।

সাধারণত যাদের শরীরে প্রোস্টেট গ্রন্থি নেই তাদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যান্সার হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। যেমন: মহিলাদের শরীরে কোন প্রোস্টেট গ্রন্থি নেই। তবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ক্ষেত্রে অনেকেই পুংলিঙ্গ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে থাকে। অর্থাৎ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অথচ যাদের শরীরে প্রস্টেট গ্রন্থি রয়েছে তাদের বেলায় প্রস্টেট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

প্রোস্টেট ক্যানসারের প্রাথমিক অবস্থায় তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশিত হয় না। কিন্তু ক্যানসার চিকিৎসায় সফলতা পাওয়ার জন্য প্রথম অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি। আর তাই এই ব্যাপারে আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির নির্দেশনা হলো ৫০ বছরের পর থেকে প্রত্যেক পুরুষের জন্য নিয়মিত কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো উচিত।

 

প্রোস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ

প্রোস্টেট গ্রন্থি মূত্রনালীকে ঘিরে রয়েছে আর তাই প্রস্টেট ক্যানসারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম প্রস্রাব সম্পর্কিত লক্ষণাবলী দেখা যায়।‌ এছাড়াও প্রোস্টেট গ্রন্থির সাথে যেহেতু পুরুষের যৌন সক্ষমতার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে তাই বিভিন্ন ধরনের যৌন সমস্যা হতে পারে। যে সমস্ত লক্ষণাবলী প্রোস্টেট ক্যানসারকে নির্দেশ করে তা নিচে তুলে ধরা হলো।

ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পাওয়া বিশেষত রাতের বেলায় বেশি।

প্রস্রাবের শুরুতে অথবা প্রস্রাব চলাকালীন সময়ে ব্যথা বোধ হওয়া।

প্রস্রাবের সাথে রক্তপাত হওয়া।

প্রস্রাব শেষ করার‌ পরেও ফোঁটায় ফোঁটায় প্রস্রাব নির্গত হওয়া।

লিঙ্গ উত্থানে সমস্যা।

বীর্যপাতের সময় ব্যথা হওয়া।

বীর্যের সাথে রক্ত যাওয়া।

এছাড়াও বসে থাকার সময় তলপেটে ব্যথা অনুভব হতে পারে

 

এছাড়াও প্রোস্টেট ক্যানসারের শেষ অবস্থায় সর্বাঙ্গীন যে সমস্ত লক্ষণাবলী দেখা যায় তা নিম্নরূপ:

 

কোমড়, উরু ও কাঁধে ব্যথা বোধ হয় কারণ চুড়ান্ত পর্যায়ের প্রোস্টেট ক্যানসার শরীরের হাড়ে আক্রমণ করে থাকে।

খাবার হজমে সমস্যা হয়।

শরীরের ওজন কমে যায়।

তৃষ্ণা ও অস্থিরতা বেড়ে যায়।

পায়ে পানি জমে ইত্যাদি।

 

প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসক রোগীর কাছ থেকে সমস্ত রোগ লক্ষণাবলী ও বংশ ইতিহাস সংগ্রহ করেন। অতঃপর শারীরিক পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। ডাক্তার প্রোস্টেট ক্যানসারের ক্ষেত্রে পায়ুপথে গ্লভস পড়া আঙ্গুল প্রবেশের মাধ্যমে প্রোস্টেটের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করেন।

ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও কার্যকরী পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে বায়োপসি অন্যতম। প্রোস্টেট ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট গ্রন্থি থেকে কোষকলা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসার সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়‌। আর এই পদ্ধতিকেই মেডিকেলের ভাষায় বায়োপসি বলা হয়ে থাকে।

 

প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধের উপায়

প্রোস্টেট ক্যানসার একটি জটিল ও ভয়াবহ ব্যাধি। এর চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও রয়েছে নানাবিধ জটিলতা আর তাই সবচেয়ে সহজ ও সঠিক সিদ্ধান্ত হলো প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে সচেষ্ট হওয়া। কিভাবে প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়? কিছু সহজ ও কার্যকরী উপায় রয়েছে যা প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন:

গবেষণায় দেখা গেছে যে ধুমপান প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আর তাই ধুমপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে

কিছু কিছু খাবার রয়েছে যা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় এমন খাবারগুলো কম পরিমাণে খাওয়া উচিত।

যেমন: লাল মাংস, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার ইত্যাদি

তেমনি কিছু কিছু খাবার রয়েছে যা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

 যেমন: মাছ, টমেটো, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি বেশি বেশি পরিমাণে খেতে হবে

 ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে যা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। আর তাই প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে ব্যায়াম করা উচিত

একাধিক এবং অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্কের ফলে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

চিকিৎকদের মতে, নিয়মিত যৌন ক্রিয়া তথা বীর্যপাতের ফলে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং শরীর থেকে শুক্রাণু ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান বেড়িয়ে যায় যা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। উল্লেখ্য যে সমস্ত পুরুষ মানুষ মাসে ৪ থেকে ৭ বার বীর্যপাত করেন তাদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানসারের অধিক ঝুঁকি রয়েছে।

এছাড়াও হস্তমৈথুনের মাধ্যমে বীর্যপাতের বিষয়টিকেও নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। কারণ কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত পরিমাণে হস্তমৈথুন করার ফলে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আর তাই পরিণত বয়সে বিয়ে করে নেওয়া উচিত।

(ঢাকাটাইমস/২৪ মে/আরজেড)