ভেষজ পান পাতার আশ্চর্য ঔষধি গুণ

প্রকাশ | ২৪ মে ২০২২, ১১:৪১ | আপডেট: ২৪ মে ২০২২, ১১:৫৮

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে বা অতিথি আপ্যায়নে খাওয়ার শেষে পানের প্রচলন অনেক আগে থেকেই। প্রাচীন ভেষজ গ্রন্থ আয়ুর্বেদে নিঃশ্বাস দুর্গন্ধমুক্ত রাখার জন্য পান সেবনের উল্লেখ আছে। আর্য ও আরবগণ পানকে তাম্বুল বলে অভিহিত করতেন। এরপর দক্ষিণ এশিয়া থেকে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ তা থেকে আবার  দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পানের চাহিদা বিস্তৃতি লাভ করে।

বর্তমানে পানের বিশ্বব্যাপী বাজার রয়েছে। একসময় পানের বরজ থেকে আয় এতই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো যে, বাংলার সুবেদার আজিম-উস-শান পানচাষকে ‘সাউদিয়া খাস’ নামে একচেটিয়া রাজকীয় ব্যবসায় পরিণত করেন। ১৭৬৫ সালে রবার্ট ক্লাইভ দেওয়ানি লাভের পর তিনিও ১৭৬৭ সালে পান চাষকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসায়ে পরিণত করেন।

পান পিপারাসি পরিবারের লতানো উদ্ভিদ। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের একপ্রকার লতাজাতীয় গাছের পাতা। পানের বৈজ্ঞানিক নাম পিপার বিটল। পানের নানান জাত আছে। সাধারণত দু ধরনের পান বাজারে পাওয়া যায় কপুরি ও মলবারি। কপুরি পান আকারে ছোট আর স্বাদে মৃদু। বাংলা পানের আকার বড় হয় ও স্বাদে তীক্ষ্ণ। বাংলা পানের রস তীক্ষ্ণ, মলনিঃসারক, পিত্ত উৎপাদন করে, গরম এবং কফ হরণ করে। পাকা সাদা পাতলা ও ছোট আকারের পানই সবচেয়ে ভাল গুণের দিক থেকেও শ্রেষ্ঠ। কাঁচা সবুজ পানের চেয়ে পাকা সাদা পানেরই স্বাদ ও গুণ বেশি।

বর্তমানে দেখা মেলে বাহারি রকমের পানের। যেমন আছে আগুন পান, শাহি পান, বেনারসি পান, খিল্লি পান। তেমনি আবার আছে চুইংগাম ও অন্যান্য ‍উপাদান দিয়ে তৈরি চুইংগাম পান, স্ট্রবেরি পান, আছে বিভিন্ন স্বাদের ভ্যানিলা ক্রিম দিয়ে তৈরি ভ্যানিলা পানও। হরেক রকম পানের আছে আবার হরেক রকম স্বাদ। যদিও স্বাদ পাল্টেছে, ভিন্নতা এসেছে তবুও পাল্টায়নি সেই তৃপ্তি ঐতিহ্য।

পান স্বচ্ছ, রুচি উৎপাদক, তীক্ষ্ণ, উষ্ণ, কায়, মল পরিষ্কার করে, কটু, ক্ষারযুক্ত, রক্ত এবং পিত্তকারক, হালকা, বলপ্রদ, কফ, মুখের দুর্গন্ধ, বায়ু নাশক এবং শ্রম দূর করে। পান কামোদ্দীপক, রুচি বৃদ্ধি করে এবং বস্তিকর অর্থাৎ চেহারা সুন্দর করে। পান পাতা সেবনে দেহের চর্বি বা মেদ কমে এবং ওজন কমে বলে জানা গেছে। জেনে নিন ভেষজ পান পাতার ঔষধি গুনাগুণ-

 

হজমে সাহায্য করে

পান খেলে লালাগ্রন্থির নিঃসরণ বেড়ে যায়। লালার কারণেই হজমের প্রথম ধাপের কাজ শুরু হয়। লালার মধ্যে থাকা বিভিন্ন এনজাইম বা উৎসেচক খাদ্যকে কণায় ভাঙতে সাহায্য করে যার ফলে হজম ভালো হয়। শুধু পান পাতা চিবিয়ে খেলেও এ উপকার পাওয়া যায়। বিশেষ করে গুরুপাক বা ভারী খাবার খাওয়ার পর অনেকেরই হজমের সমস্যা হয়। এজন্য যে কোনো উৎসব ও অনুষ্ঠানে খাবার পরিবেশনের শেষে পান পরিবেশন করা হয় যা খেলে ওসব খাবার দ্রুত হজম হয়ে যায়।

 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে

পান রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে গবেষণায় জানা গেছে। পানের ডায়াবেটিস প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে।

 

ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়

পান পাতায় আছে চমৎকার এন্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় ও দেহে ক্যান্সার সৃষ্টি প্রতিরোধ করে। এজন্য রোজ ১০-১২টি পান পাতা পানিতে ৫ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। এরপর তা নামিয়ে ছাঁকতে হবে। একটু ঠান্ডা হলে তাতে কয়েক ফোঁটা মধু মিশিয়ে কুসুম গরম থাকতেই পান করতে হবে। রোজ এটা খেতে পারলে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।

 

জয়েন্টে ব্যথা কমায়

পান পাতায় রয়েছে পলিফেনাল নামে এক ধরনের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান। আর এই উপাদানটি প্রদাহ বা যন্ত্রণা কমাতে কাজে করে। সেই কারণেই চিকিৎসকেরা আর্থ্রাইটিস রোগীদের পান পাতার রস লাগানোর পরামর্শ দেন।

 

মুখের দুর্গন্ধ দূর করে

মুখের ভিতরের ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে পান পাতার বিকল্প নেই। পান খেলে তার রস জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে এসব ব্যাকটেরিয়াকে জন্মাতে দেয় না। ফলে পান পাতা চেবানোর সময় মুখে ভিতর স্যালাইভা উৎপাদন করে যা ওরাল ব্যাক্টেরিয়া রোধ করে এবং পিএইচ লেভেলের ভারসাম্য বজায় রাখে। 

 

যৌন শক্তি বাড়ায়

সেক্স লাইফেও পানের মহিমা অপরিসীম। পান খেলে বাড়ে যৌন আকাঙ্খা। গবেষকরা সম্প্রতি এমনই দাবি করেছেন। জানা যাচ্ছে, পানের মধ্যে থাকা সুপুরি, চুন, লবঙ্গ, গুলকন্দ হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। শুধু মাত্র হজম শক্তিই যে পান বাড়ায় তা নয়, সুগন্ধি হিসেবেও কাজ করে পান। পাশপাশি, পানের মধ্যে থাকা গুলকন্দ কর্ম ক্ষমতা বাড়িয়ে সচল রাখে শরীরকে। নববিবাহিত দম্পতিদের অনেকেই যৌন মিলনে যাওয়ার আগে পান খান। এতে তাদের যৌন ক্ষমতা ও মিলনের স্থায়িত্বকাল বৃদ্ধি পায়।

 

মানসিক চাপ কমায়

মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে। যারা মানসিক চাপে ভুগছেন, তারা পান পাতা খাওয়া শুরু করতে পারেন। কারণ এতে উপস্থিত বেশ কিছু প্রাকৃতিক উপাদান নিমেষে মন ভালো করে দেয়। সেসঙ্গে হতাশা কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে রাতের খাবার শেষ করে এক-দুটি পান পাতা মুখে নিলে দারুণ উপকার পাওয়া যায়।

 

গ্যাস্ট্রিক আলসার নিরাময় করে

পান খেলে পেটে বায়ু কম হয় ও গ্যাস হয় না। এর ফলে গ্যাস্ট্রিক ও তা থেকে আলসার সৃষ্টির সুযোগ কমে যায়। পানের রস হজমে সাহায্য করায় তা পেটে বদ গ্যাস তৈরি রোধ করে। ফলে পেট ফাঁপে না ও গ্যাস্ট্রিক হয় না।

 

উঁকুন মরে

মাথায় উঁকুন হলে গোসলের কিছুক্ষণ আগে পান পাতার রস মাথায় লাগিয়ে বসে থাকলে উঁকুন সবংশে মরে যায়। এ কাজে ঝাল পান হলে ভালো হয়।

 

ফোঁড়া ফাটায়

পান পাতার চকচকে সবুজ পিঠে ঘি মাখিয়ে একটু সেঁক দিয়ে গরম করে ফোঁড়ার ওপর লাগিয়ে দিলে দ্রুত ফোঁড়া পেকে ফেটে যায়। আবার পাতার উল্টো পিঠে ঘি মাখিয়ে একইভাবে বসিয়ে রাখলে তা পুঁজ টেনে বের করে আনে। ঘিয়ের বদলে ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহার করেও একই ফল পাওয়া যায়।

 

কান পাকা সারায়

কান পেকে পুঁজ হয়ে গেলে সেসব কানে পান পাতার রস গরম করে ১-২ ফোঁটা কানের ভেতরে দিলে এ সমস্যা চলে যায়।

 

চর্মরোগ সারায়

দেহের কোথাও দাদ হলে বা চুলকানি পাঁচড়া হলে সেখানে ঘষে পান পাতার রস লাগিয়ে দিলে কয়েক দিনের মধ্যে তা সেরে যায়।

 

নখকুনির কষ্ট সারায়

নখকুনিতে নখের কোণায় ব্যথা হয়। এ অবস্থায় সেখানে কয়েক ফোঁটা পানের রস দিলে ব্যথাটা চলে যায়।

 

আঁচিল দূর করে

আঁচিল হলে সে আঁচিলের ওপর কয়েক দিন পানের রস লাগালে তা ধীরে ধীরে খসে পড়ে ও সেখানে আর আঁচিল তৈরি হয় না।

 

মাথা ব্যথা দূর করে

মাথা ব্যথা হলে কপালে পানের রস লেপে দিলে দ্রুত মাথাব্যথা কমে যায়।

 

ক্ষুধা বৃদ্ধি করে

পাকস্থলী গড়বড় হলে সবই উল্টে যায়। খিদেও লাগে না। পাকস্থলীতে অম্লমান বা পিএইচের মাত্রা স্বাভাবিক না থাকলেই এরূপ হয়। পান তা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। ফলে শুধু পান পাতা চিবিয়ে খেলেও ক্ষুধা বাড়ে।

 

এন্টিসেপটিকের কাজ করে

কোথাও কেটে গেলে দ্রুত সেখানে পানের রস লাগিয়ে দিলে জীবাণু সংক্রমণের ভয় থাকে না। পান পাতা পলিফেনল বিশেষত চাভিকল নামক রাসায়নিক উপাদানে পূর্ণ। এটা জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে। এ ছাড়া সেখানে ফোলাও বন্ধ করে, ব্যথার উপশম করে। শরীরের যেসব অংশ প্রায় সময়ই ঘামে ভেজা থাকে সেখানে নানা রকম ছত্রাক জন্ম নেয় ও দাদের মতো চর্ম রোগের জন্ম দেয়। পানের রস সেখানে লাগালে তা এন্টিসেপটিকের কাজ করে ও ছত্রাক জীবাণু ধ্বংস করে।

 

মেছতা দূর করে

পান অনেক ধরনের চর্মরোগ ভালো করার ক্ষমতা রাখে। মেছতা, এলার্জি, চুলকানি, দেহে দুর্গন্ধ সৃষ্টি ইত্যাদিও উপশম করতে পারে। এরূপ অবস্থায় ২টি পান পাতা ছেঁচে রস বের করতে হবে। এর সাথে একটু হলুদের গুঁড়া বা কাঁচা হলুদের রস মিশিয়ে মেছতা ও এলার্জির কারণে ফুলে ওঠা জায়গাগুলোতে লাগাতে হবে। এতে এসব সমস্যা ধীরে ধীরে কয়েক দিনের মধ্যে চলে যাবে।

 

দাঁতে ব্যথা কমায়

দাঁতে ব্যথা হলে ২ কাপ পানিতে ২-৩টি পান পাতা সিদ্ধ করতে হবে। জ্বাল দিতে দিতে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে তা দিয়ে কুলকুলি করতে হবে। এতে দাঁতে ব্যথা কমে যাবে।

 

জন্মরোধ করে

পান গাছের শিকড় বেটে রস করে খেলে সন্তান হয় না। জন্ম নিরোধক বড়ি না খেয়েও জন্মনিয়ন্ত্রণে পান গাছে শিকড় সেবন করা যায়। বিভিন্ন দেশের গবেষণায় এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

(ঢাকাটাইমস/২৪ মে/আরজেড)